সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের টাকার পাহাড় জমেছে
মোহাম্মাদ আবুবকর সিদ্দীক ভুঁইয়া :সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংকে (সুইস ব্যাংক) বাংলাদেশিদের টাকার পাহাড় জমেছে। ২০২১ সালে এই অর্থের পরিমাণ ছিল ৮৭ কোটি ১১ লাখ ফ্র্যাংক। স্থানীয় মুদ্রায় যা ৮ হাজার ২৭৫ কোটি টাকা (প্রতি সুইস ফ্র্যাংক ৯৫ টাকা হিসাবে)।এই টাকা অন্তত ২১টি বেসরকারি ব্যাংকের পরিশোধিত মূলধনের সমান। আগের বছরের চেয়ে এই আমানত প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা বেড়েছে। ২০২০ সালে যা ছিল ৫ হাজার ৩৪৩ কোটি টাকা। এক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ভারতের পরেই বাংলাদেশের অবস্থান।বৃহস্পতিবার সুইস ন্যাশনাল ব্যাংকের প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য জানা গেছে। তবে কোনো বাংলাদেশি তার নাগরিকত্ব গোপন রেখে টাকা জমা করলে তার তথ্য এ প্রতিবেদনে নেই। পাচার হওয়া অর্থ ফেরাতে সরকারের প্রণোদনা নিয়ে দেশব্যাপী যখন আলোচনা-সমালোচনা চলছে, এই সময়ে সামনে এলো সুইস ব্যাংকের রিপোর্ট।অর্থনীতিবিদরা বলছেন, অনিশ্চয়তাসহ নানা কারণে বিত্তবানরা দেশকে নিরাপদ মনে করছেন না। ফলে বিভিন্ন উপায়ে অর্থ পাচার হচ্ছে। ঋণের নামে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের টাকা, বিভিন্ন প্রকল্পের অর্থ এবং ঘুস-দুর্নীতির টাকা দেশ থেকে পাচার হয়ে যাচ্ছে।
এ অবস্থা বন্ধের জন্য সুশাসন জরুরি। আর আলোচ্য সময়ে সুইস ব্যাংকে সারা বিশ্বের আমানত বেড়েছে। আমানত রাখার ক্ষেত্রে এ বছরও বিশ্বে প্রথম অবস্থানে যুক্তরাজ্য। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, শুধু সুইস ব্যাংক নয়, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার রিপোর্টেও বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচারের তথ্য আসছে।বিষয়টি গভীর উদ্বেগজনক। কারণ সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশের যে টাকা রাখা হয়েছে, সেটা মূলত দুর্নীতির। তিনি বলেন, বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচারের মূলত তিনটি কারণ। এর মধ্যে প্রধান হচ্ছে দুর্নীতি। দুর্নীতি বেড়েছে বলেই অর্থ পাচারও বেড়েছে।এছাড়া দেশে বিনিয়োগের পরিবেশ না থাকা, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও নিরাপত্তাহীনতার কারণেও অর্থ পাচার বাড়ছে। তার মতে, পাচার রোধ করতে হলে দুর্নীতি কমিয়ে আনার বিকল্প নেই।পাশাপাশি নাগরিক জীবনেও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা জরুরি। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি বাংলাদেশ আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিটের (বিএফআইইউ) প্রধান মাসুদ বিশ্বাস।
বাংলাদেশিদের আমানত : ২০২১ সালে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের আমানতের স্থিতি ৮৭ কোটি ১১ লাখ ফ্র্যাংক। আগের বছর অর্থাৎ ২০২০ সালে ছিল যা ৫৬ কোটি ২৯ লাখ ফ্যাংক। ২০১৯ সালে ৬০ কোটি ৩০ লাখ ফ্র্যাংক।২০১৮ সালে ৬১ কোটি ৭৭ লাখ ফ্র্যাংক। ২০১৭ সালে ছিল ৪৮ কোটি ১৩ লাখ ফ্র্যাংক। ২০১৬ সালে ৬৬ কোটি ১৯ লাখ ফ্র্যাংক। ২০১৫ সালে ৫৫ কোটি ০৮ লাখ ফ্র্যাংক। ২০১৪ সালে যা ছিল ৫০ কোটি ৬০ লাখ ফ্র্যাংক।২০১৩ সালে ৩৭ কোটি ২০ লাখ এবং ২০১২ সালে ছিল ২২ কোটি ৯০ লাখ ফ্র্যাংক। স্বর্ণালঙ্কার, শিল্পকর্ম এবং অন্যান্য মূল্যবান জিনিসপত্র জমা রাখলে তার আর্থিক মূল্যমান হিসাব করে আমানতে যোগ হয় না।তবে শুধু সুইস ব্যাংক নয়, অন্যান্য সংস্থা থেকেও টাকা পাচারের তথ্য আসছে। আন্তর্জাতিক ৬টি সংস্থার রিপোর্টে বাংলাদেশ থেকে টাকা পাচারের তথ্য আসছে।এগুলো হলো-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংস্থা গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি (জিএফআই), সুইস ব্যাংক, যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম ফর ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম (আইসিআইজে) ।
এছাড়া পানামা প্যারাডাইস ও পেনডোরা পেপারস, জাতিসংঘের উন্নয়ন প্রোগ্রামের (ইউএনডিপি) রিপোর্ট এবং মালয়েশিয়া প্রকাশিত সে দেশের সেকেন্ড হোম রিপোর্টও আছে। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও সিঙ্গাপুরে বেশকিছু বাংলাদেশির অর্থ পাচারের তথ্য মিলেছে।ডিসেম্বরে প্রকাশিত জিএফআইর প্রতিবেদনে বলা হয়, ৬ বছরে দেশ থেকে ৪ হাজার ৯৬৫ কোটি ডলার পাচার হয়েছে। প্রতি ডলার ৯২ টাকা হিসাবে স্থানীয় মুদ্রায় সাড়ে ৪ লাখ কোটি টাকা।
বিশ্বের অন্যান্য দেশের আমানত : সুইস ব্যাংকে আমানত রাখার দিক থেকে এ বছর প্রথম অবস্থানে যুক্তরাজ্য। ২০২১ সালে দেশটির আমানতের পরিমাণ ৩৭ হাজার ৫২০ কোটি ফ্র্যাংক।মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ১৭ হাজার ৭৩৩ কোটি, সিঙ্গাপুর ৫ হাজার ৬৩ কোটি, চীন ১ হাজার ৯৩ কোটি ফ্র্যাংক, রাশিয়া ২ হাজার ১৩৭ কোটি, সোদি আরব ১ হাজার ৪৫ কোটি, থাইল্যান্ড ৪৩২ কোটি, তাইওয়ান ১ হাজার ৪৩ কোটি, জাপান ২ হাজার ৬০ কোটি, তুরস্ক ৭৪২ কোটি এবং মালয়েশিয়া ২১৫ কোটি ফ্র্যাংক।দক্ষিণ এশিয়ার ৮ দেশের মধ্যে ৫টির আমানত বেড়েছে এবং কমেছে তিনটি দেশের। এরমধ্যে পাকিস্তানের আমানত ৬৪ কোটি থেকে বেড়ে ৭০ কোটি ৭৯ লাখ ফ্র্যাংকে উন্নীত হয়েছে।আগের বছর ভারতের আমানত ছিল ২৫৫ কোটি। এবার তা বেড়ে ৩৮২ কোটিতে উন্নীত হয়েছে। এছাড়াও নেপাল ৩৬ থেকে কমে ২৯ কোটি, আফগানিস্তান ৫ কোটি থেকে কমে ২ কোটি, ভুটান ২ লাখ থেকে ৩ লাখ, মালদ্বীপ ২৫ লাখ থেকে বেড়ে ৩৩ লাখ, শ্রীলংকা ১৩ কোটি ৩১ লাখ থেকে মাত্র ৫৬ লাখ এবং মিয়ানমারের ৩৯ লাখ থেকে কমে ২৭ লাখ ফ্র্যাংক আমানত রয়েছে।
টাকার পাচার বলার কারণ : সুইস ব্যাংক মূলত তাদের প্রতিষ্ঠানের কাছে থাকা বিদেশিদের আমানতের তথ্য প্রকাশ করে । কিন্তু বাংলাদেশি আইনে কোনো নাগরিকের বিদেশি ব্যাংকে আমানত রাখার সুযোগ নেই। টাকা নিতে হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি লাগে।বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানায়, এখন পর্যন্ত কাউকে বিদেশে টাকা জমা রাখার বিশেষ অনুমোদনও দেওয়া হয়নি। এছাড়া কোনো প্রবাসীও সরকারকে জানাননি যে তিনি সুইস ব্যাংকে টাকা জমা রেখেছেন। ফলে সূত্র বলছে, সুইস ব্যাংকে জমা পুরো টাকাটাই দেশ থেকে পাচার করা হয়েছে।
টাকা পাচার : সাম্প্রতিক সময়ে দেশ থেকে টাকা পাচারের পরিমাণ বেড়েছে। মূলত কয়েকটি মাধ্যমে টাকা পাচার হয়। এরমধ্যে রয়েছে-আমদানিতে মূল্য বেশি দেখানো (ওভার ইনভয়েসিং), রপ্তানিতে মূল্য কম দেখানো (আন্ডার ভয়েসিং), হুন্ডি, ভিওআইপি ব্যবসা। গত কয়েক বছরে সরাসরি বিদেশে ডলার নিয়ে যাওয়ার তথ্য বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।পাচারের অর্থ ফেরানোর উদ্যোগ : এদিকে প্রস্তাবিত ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে অর্থ পাচারকারীদের বিশেষ সুযোগ দিয়েছে বাংলাদেশ। কেউ ৭ শতাংশ কর দিয়ে বিদেশে পাচার করা অর্থ ফিরিয়ে এনে বৈধ করতে পারবে।তবে বিষয়টি সমালোচনা করছে দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক সংস্থা (টিআইবি) এবং দেশের শীর্ষস্থানীয় অর্থনীতিবিদরা। বর্তমানে দেশে একজন নিয়মিত করদাতা ২৫ শতাংশ পর্যন্ত কর দেন। সে হিসাবে অর্থ পাচারকারীদের প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে।
মোট আমানত : প্রতিবেদন অনুসারে আলোচ্য সময়ে বিশ্বের সব দেশের আমানত বেড়েছে। আলোচ্য বছরে সুইজারল্যান্ডের ২৫৬টি ব্যাংকে আমানতের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৪০ হাজার কোটি ফ্র্যাংক। আগের বছর অর্থাৎ ২০২০ সালে ছিল ১ লাখ ৩৬ হাজার কোটি ফ্র্যাংক।এ হিসাবে এক বছরে আমানত কমেছে ৪ হাজার কোটি ফ্র্যাংক। এছাড়া ২০১৯ সালে ছিল ১ লাখ ৩০ হাজার কোটি ফ্র্যাংক। ২০১৮ সালে যা ছিল ১ লাখ ২৭ হাজার কোটি ফ্র্যাংক। ২০১৭ সালে ছিল ১ লাখ ৩৫ হাজার কোটি ফ্র্যাংক। এছাড়াও ২০১৬ সালে ছিল ১ লাখ ৩২ হাজার কোটি।২০১৫ সালে সুইস ব্যাংকে বিদেশিদের মোট আমানত ছিল ১ লাখ ৩৩ হাজার কোটি ফ্র্যাংক। ২০১৪ সালে ১ লাখ ৩৮ হাজার কোটি ফ্র্যাংক। ২০১৩ সালে ছিল ১ লাখ ২৩ হাজার কোটি এবং ২০১২ সালে ছিল ১ লাখ ২৯ হাজার কোটি ফ্র্যাংক। অন্যদিকে উন্নয়নশীল দেশগুলোরও আমানত বেড়েছে।আলোচ্য সময়ে উন্নয়নশীল দেশের আমানতের স্থিতি ছিল ১৬ হাজার ৫৬০ কোটি ফ্র্যাংক। আগের বছর যা ছিল ১৬ হাজার ৪৬০ কোটি ফ্র্যাংক।
সুইস ব্যাংক : সুইস ন্যাশনাল ব্যাংক (এসএনবি) হলো সুইজারল্যান্ড সরকারের স্বাধীন কেন্দ্রীয় ব্যাংক। দেশটির রাজধানী বার্ন শহরে অবস্থিত প্রতিষ্ঠানটি বিশেষ আইন দ্বারা পরিচালিত। এর নীতিনির্ধারণ সবই স্বাধীন।২০০ বছরের পুরোনো ইউরোপের এ প্রতিষ্ঠানটি মুদ্রা পাচারকারীদের নিরাপদ স্বর্গ। ব্যাংকটির মুদ্রানীতি এবং সুশৃঙ্খল কার্যক্রম বিশ্বের উন্নত দেশগুলো অনুসরণ করে। তবে পাচারকারীদের আশ্রয়দাতা হিসাবে আন্তর্জাতিক মহলে দেশটি পরিচিতি রয়েছে।ব্যাপক সমালোচনার মুখে ২০০২ সাল থেকে দেশভিত্তিক আমানতের তথ্য প্রচার শুরু করেছে তারা। কিন্তু আমানতকারীদের নাম-ঠিকানা প্রকাশ করছে নাতবে যেসব দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি রয়েছে, সে সব দেশের ব্যক্তিগত পর্যায়ে তথ্য দেওয়া হয়। বাংলাদেশ সূত্র বলছে, তারা কয়েক দফায় সুইস ব্যাংকে চিঠি দিলেও কোনো সাড়া মেলেনি।