দুর্নীতির প্রবণতা দেশের সব সম্ভাবনাকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে - Alokitobarta
আজ : শুক্রবার, ২১শে নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ৬ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

দুর্নীতির প্রবণতা দেশের সব সম্ভাবনাকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে


মোহাম্মাদ আবুবকর সিদ্দীক ভুঁইয়া:কিছু লোভী মানুষের সীমাহীন দুর্নীতির প্রবণতা দেশের সব সম্ভাবনাকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে। যা মানুষের মধ্যে হতাশার সৃষ্টি করছে। সাধারণ মানুষ রাষ্ট্রের কার্যক্রমে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা প্রত্যাশা করে। এক্ষেত্রে কমিশনের কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এগুলো উত্তরণের মাধ্যমে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এগিয়ে যেতে যায়। এ লক্ষ্যে ‘ভবিষ্যৎ অভিযাত্রায় কমিশনের কর্মপরিকল্পনা’ রয়েছে। এই কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করলে দুদকের কার্যক্রমে বহুমাত্রিকতার পাশাপাশি দুর্নীতি দমন ও প্রতিরোধের সক্ষমতা বহুগুণ বৃদ্ধি পাবে। ফলে দুদকের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা আরও বাড়বে।দুদকের ‘বার্ষিক প্রতিবেদনে (২০২০ ও ২০২১) উঠে এসেছে এমন চিত্র। প্রতিবেদনটি আজ রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের কাছে উপস্থাপন করা হবে। দুদক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ্, কমিশনার (অনুসন্ধান) ড. মো. মোজাম্মেল হক খান ও কমিশনার (তদন্ত) জহুরুল হক প্রতিবেদনটি হস্তান্তর করবেন। দুদক প্রতিবছর ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনা ও অতীত কাজের ফলাফল, দায়িত্ব পালনে প্রতিবন্ধকতা ও তা নিরসনের উপায় রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে সরকারের কাছে পেশ করে থাকে। এবার করোনার কারণে দুই বছরের বার্ষিক প্রতিবেদন একসঙ্গে তৈরি করা হয়েছে।প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ‘অর্থ/সম্পদ পাচার রোধ এবং পাচারকৃত অর্থ/সম্পদ বিদেশ থেকে দেশে ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে দুদকের অগ্রণী ভূমিকা দেখতে চাইলে দুদকে পর্যাপ্ত আইনি ক্ষমতা প্রদান করতে হবে।’জানতে চাইলে দুদক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ্ বলেন, দুর্নীতি একটি বৈশ্বিক সমস্যা হিসেবে বিবেচিত। বিশ্বের কোনো রাষ্ট্রই পুরোপুরি দুর্নীতিমুক্ত নয়। তবে এর ব্যাপকতার তারতম্য রয়েছে। বাংলাদেশও এই বৈশ্বিক বাস্তবতার ব্যতিক্রম কোনো দেশ নয়। আগামী ২০৪১ সালের মধ্যে শিল্পায়নের মাধ্যমে উচ্চ আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার লক্ষ্যে দুর্বার গতিতে দেশ এগিয়ে চলছে। সেই লক্ষ্য বাস্তবায়নে সক্রিয় অংশীদার হিসেবে দুদক দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে।ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, দুর্নীতিবাজদের আইনের আওতায় এনে বিচারের মুখোমুখি করতে হবে। কমিশন প্রভাবমুক্ত হয়ে কাজ করতে পারলে রাষ্ট্রের অনেক কাজেই স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা সৃষ্টি হবে। দুর্নীতিমুক্ত দেশ গড়তে হলে দুদকের মতো দুর্নীতিবিরোধী সংস্থার কর্মতৎপরতার কোনো বিকল্প নেই। তিনি আরও বলেন, মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২-এর সংশোধনী এনে দুদকের কাছ থেকে অনুসন্ধান ও তদন্তের ক্ষমতা নেওয়ার পর পাচারকৃত অর্থ দেশে ফেরত আনার প্রক্রিয়া ভেঙে পড়েছে। কাজেই আইনি ক্ষমতা ফিরিয়ে দিয়ে দুদকের হাতকে আরও শক্তিশালী করা প্রয়োজন।

কমিশনের ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনা : প্রতিবেদনে ‘ভবিষ্যৎ অগ্রযাত্রায় কমিশনের কর্মপরিকল্পনা’কে মূলত তিনটি অংশে ভাগ করা হয়েছে। এগুলো হলো-প্রথমত, মানি লন্ডারিং দমন ও প্রতিরোধ কার্যক্রমে বিদ্যমান সমস্যা ও উত্তরণের উপায়। দ্বিতীয়ত, পাচারকৃত সম্পদ পুনরুদ্ধারে দুদকের কার্যক্রমে সীমাবদ্ধতা ও তা দূরীকরণের উপায়। তৃতীয়ত, গোয়েন্দা কার্যক্রম। এই তিনটি অংশে বিদ্যমান সমস্যা ও এর সমাধানে কমিশনের পরিকল্পনা রাষ্ট্রপতির কাছে উপস্থাপন করা হয়েছে। এর প্রথম দুটি অংশই মানি লন্ডারিং বা অর্থ পাচার সংক্রান্ত। শেষেরটি দুদকের গোয়েন্দা শাখা সংক্রান্ত।

মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ : কমিশনের কর্মপরিকল্পনার প্রথম এ অংশে তদন্তকারী কর্মকর্তাদের সার্ভিলেন্স পরিচালনা ও আন্ডারকভার অপারেশন পরিচালনার ব্যবস্থা না থাকাসহ বিদ্যমান ১০টি সীমাবদ্ধতার কথা তুলে ধরা হয়েছে। এসব সীমাবদ্ধাতা দূরীকরণে কমিশন ১০টি পরিকল্পনার কথা প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে। এগুলো হলো-প্রো-অ্যাক্টিভ অনুসন্ধানের উদ্যোগ গ্রহণ করা। সার্ভিলেন্স, কমিউনিকেশন ইন্টারসেপশন ও আন্ডারকভার অপারেশন পরিচালনার জন্য নীতিমালা প্রণয়ন করা এবং বিশেষায়িত লোকবল নিয়োগ করা। বিভিন্ন সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য মানি লন্ডারিং অনুবিভাগে পৃথক পৃথক ডেস্ক স্থাপন করা। যেসব দেশে অর্থ পাচার হয়, সেসব দেশের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক চুক্তি সম্পাদন করা। বিভিন্ন বিষয়ে উচ্চতর প্রশিক্ষণ দেওয়া। বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে সমঝোতা স্মারক সই করা। অফিসিয়াল ইমেইল চালু করা এবং দুর্নীতি প্রতিরোধে আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্কে যোগদান করা।

সম্পদ পুনরুদ্ধার : কমিশনের কর্মপরিকল্পনার দ্বিতীয় এ অংশে পাচারকৃত সম্পদ পুনরুদ্ধারে দুদকের কার্যক্রম, সীমাবদ্ধতা ও তা দূরীকরণের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এতে বলা হয়, বিদ্যমান মানি লন্ডারিং আইন অনুসারে ২৭টি সম্পৃক্ত অপরাধের মধ্যে দুদক শুধু ‘ঘুস ও দুর্নীতি’ সম্পৃক্ত মানি লন্ডারিংয়ের অপরাধ তদন্ত করতে পারে। বাকি ২৬টি সম্পৃক্ত অপরাধ সংশ্লিষ্ট মানি লন্ডারিংয়ের তদন্ত এনবিআর, সিআইডিসহ একাধিক সংস্থার মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে। বিভিন্ন গবেষণা বা তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বাংলাদেশ থেকে পাচারকৃত অর্থের প্রায় ৮০ ভাগ আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মাধ্যমে সংঘটিত হয়ে থাকে। আর বাণিজ্যের মাধ্যমে অর্থ পাচার তদন্তভার জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) ওপর ন্যস্ত করা হয়েছে। এক্ষেত্রে দুদক তাদের সীমিত আইনি ক্ষমতার কথাসহ চারটি সীমাবদ্ধতার কথা প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে। এসব সীমাবদ্ধতা দূরীকরণের জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে চারটি প্রস্তাব করা হয়েছে। এগুলো হলো-অর্থ পাচার রোধে এবং পাচারকৃত অর্থ দেশে ফেরতের ক্ষেত্রে দুদককে অগ্রণী ভূমিকায় দেখতে চাইলে দুদককে পর্যাপ্ত আইনি ক্ষমতা দিতে হবে। বিদেশ থেকে তথ্য সহজে প্রাপ্তির জন্য বিভিন্ন দেশের দুর্নীতি দমন সংস্থার সঙ্গে সমঝোতা স্মরক স্বাক্ষর করা। বিদেশ থেকে সম্পদ পুনরুদ্ধার কার্যক্রম বেগবান করতে হলে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে ডেডিকেটেড লোকবল নিয়োগ করা এবং দেশ-বিদেশে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। আধুনিক প্রযুক্তি ও আন্তর্জাতিক আইন সম্পর্কে কর্মকর্তাদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দেওয়া।

গোয়েন্দা তৎপরতা : প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৮ সালের ৮ অক্টোবর দুদকের সাংগঠনিক কাঠামোতে যুক্ত হয়ে কমিশনের গোয়েন্দা ইউনিট কাজ শুরু করে। এই ইউনিট চেয়ারম্যানের তত্ত্বাবধানে ও একজন পরিচালকের নেতৃত্বে কমিশনের মিশন ও ভিশন বাস্তবায়নে নানা সীমাবদ্ধতার পরও নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। এই ইউনিট দেশের অন্যন্য গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে গোয়েন্দা তথ্য আদান-প্রদানের মাধ্যমে নিজেদের তথ্যভাণ্ডার সমৃদ্ধ করে থাকে। দেশব্যাপী এই ইউনিটের কার্যক্রম বিস্তৃত রয়েছে। কিছু চিহ্নিত দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তির কার্যক্রম গোয়েন্দা নজরদারিতে রাখা হয়েছে। যা যথাসময়ে আইনের আওতায় আনা হবে।

অনুসন্ধান, তদন্ত, সাজা ও ক্রোক : দুদক ২০২১ সালে ৪ হাজার ৬১৪টি অভিযোগের অনুসন্ধান শুরু করে। এ সময় ১ হাজার ৪৪টি অনুসন্ধান শেষে ৩৪৭টি মামলা করা হয়েছে। দুদকে ৩ হাজার ৫৭০টি অভিযোগের অনুসন্ধান চলছে ও ৩ হাজার ৪৩৪টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। ২০১৮ সালে দুদকের মামলায় সাজার হার ছিল ৬৩ শতাংশ। ২০১৯ সালে ৬৩, ২০২০ সালে ৭২ এবং ২০২১ সালে সাজার হার ছিল প্রায় ৬০ শতাংশ। দুদক কর্তৃক মানি লন্ডারিং আইনের মামলায় প্রায় শতভাগ সাজা হয়েছে। ২০২০ ও ২০২১ সালে ১ হাজার ৩৫৫টি অভিযোগের অনুসন্ধান করে ৬৯৫টি মামলা করা হয়েছে। একই সঙ্গে এ সময় ১৪৭ কোটি টাকা জরিমানা ও ৫০৬ কোটি টাকার সম্পদ ক্রোক করা হয়েছে।

গৃহীত ব্যবস্থা : ২০১৯ সালের ২৩ জানুয়ারি থেকে চালু হওয়া এনফোর্সমেন্ট ইউনিট দুদক হটলাইনে (নম্বর-১০৬) প্রাপ্ত অভিযোগের বিষয়ে অভিযান পরিচালনার মাধ্যমে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ করে আসছে। এই ইউনিট গত দুই বছরে সারা দেশে ৭৩২টি অভিযান পরিচালনা করেছে এবং কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বিভিন্ন দপ্তরে ১ হাজার ৪৫৪টি চিঠি পাঠিয়েছে। সরকারি পরিসেবা প্রাপ্তিতে হয়রানি লাঘবে কমিশন ২৫টি প্রাতিষ্ঠানিক টিম গঠন করেছে। দুর্নীতি প্রতিরোধের লক্ষ্যে ৫২০টি দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটি গঠন করা হয়েছে। তরুণদের মধ্যে সততা ও নিষ্ঠাবোধ সৃষ্টির লক্ষ্যে ২৭ হাজার ৬২৯টি সততা সংঘ গঠন এবং ৫ হাজার ৭৫৬টি সততা স্টোর প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। কোভিড পরিস্থিতিতেও দুদক কর্মকর্তারা ৫৫টি প্রশিক্ষণ কোর্স সম্পন্ন করেছেন।

Top