সক্ষমতা বাড়লেও সংকট আস্থায় - Alokitobarta
আজ : শুক্রবার, ২১শে নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ৬ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

সক্ষমতা বাড়লেও সংকট আস্থায়


এবি সিদ্দীক ভুঁইয়া :প্রতিকূলতার পরও গত ১৭ বছরে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সক্ষমতা বেড়েছে বহুগুণ। তবে সক্ষমতা বাড়লেও সাধারণ মানুষের আস্থা পুরোপুরি অর্জন করতে পারেনি স্বাধীন সংস্থাটি। এ সময়ের মধ্যে নানা বিষয় নিয়ে কাজ করেছে। মানুষের আস্থা ফেরানোর চেষ্টাও চলেছে। এ লক্ষ্যে বেশকিছু উদ্যোগও নিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। তবে সব ক্ষেত্রে সফলতার প্রমাণ মেলেনি। উদ্যোগগুলোর অন্যতম হচ্ছে দুর্নীতিবাজদের ফোনে আড়ি পাতা ও গোয়েন্দা তৎপরতা বৃদ্ধি। এছাড়া কর্মকর্তাদের উচ্চতর প্রশিক্ষণ, ই-ফাইলিং ব্যবস্থা, আধুনিক ইন্টারোগেশন ব্যবস্থাও চালু করা হয়েছে। একই সঙ্গে চালু করা হয়েছে সম্পদ ব্যবস্থাপনা ইউনিটও।২০০৪ সালের এই দিনে (২১ নভেম্বর) তৎকালীন দুর্নীতি দমন ব্যুরো বিলুপ্ত করে দুর্নীতি দমন কমিশন গঠন করা হয়। চড়াই-উতরাই পেরিয়ে ১৭ বছর পার করেছে রাষ্ট্রীয় এ সংস্থাটি। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষ্যে কমিশনকে দল-মতের ঊর্ধ্বে থেকে দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে আরও সোচ্চার হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

জানতে চাইলে দুদক কমিশনার ড. মোজাম্মেল হক খান বলেন, দুদক গত ১৭ বছরে যা করেছে, তাতে সাধারণ মানুষের কাছে একটি নতুন ইমেজ তৈরি হয়েছে। আগে অনেকেই দুদককে ‘নখদন্তহীন ব্যাঘ্র বলেছে।’ তবে দুদকের সে অবস্থা নেই। এখন আর কেউ সে কথা বলেনও না। বর্তমানে দুদকে জনবলের ঘাটতি রয়েছে। দুর্নীতির অনুসন্ধান ও তদন্তে নিয়োজিত আছেন প্রায় ২০০ কর্মকর্তা। এতে একজন কর্মকর্তার ওপর প্রায় ৩০টি অনুসন্ধান ও তদন্তের দায়িত্ব রয়েছে। ফলে আইনে দেওয়া সময় অনুসারে অনুসন্ধান ও তদন্ত শেষ করতে কর্মকর্তারা হিমশিম খাচ্ছেন। বর্তমান কমিশন জনবল ঘাটতি পূরণের চেষ্টা করছে। কমিশনার বলেন, দুদকে স্থান সংকট অনেক পুরোনো বিষয়। কিন্তু দীর্ঘদিনেও এর সমাধান হয়নি। সরকারি অন্য সংস্থার সঙ্গে ভাগাভাগি করে কাজ করতে হচ্ছে। এতে কমিশনের কর্মপরিবেশ নষ্ট হয়। বর্তমান ভবন ভেঙে এখানে আধুনিক বহুতল ভবন নির্মাণ করলে আগামী দিনে কাজে দেবে। এছাড়া ফরেনসিক ল্যাবটিও এখন পর্যন্ত তৈরি হয়নি। এ বিষয়েও কমিশন কাজ করছে। বর্তমানে কমিশনের মামলায় সাজার হার প্রায় ৭০ ভাগ। শতভাগ সাজার হার করতে এবং কর্মকর্তাদের দক্ষতা বাড়াতে একটি ট্রেনিং ইনস্টিটিউট করার পরিকল্পনা রয়েছে কমিশনের।তিনি বলেন, সরকারের নির্বাচনি প্রতিশ্রুতিগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স।’ সরকারের এই সহযোগিতামূলক মনোভাব দুদকের কাজে আরও সহায়ক হবে। দেশ থেকে দুর্নীতি পুরোপুরি নির্মূল করতে হয়তো আমরা পারব না। তবে দুর্নীতি দমনের প্রশ্নে আমরা জিরো টলারেন্স নীতিতে রয়েছি এবং আগামী দিনে থাকব। এতে আগামী দিনে দুদকের অবস্থান আরও ভালো হবে। দুর্নীতিবাজদের বিচারের মুখোমুখি করে সাধারণ মানুষের আস্থা অর্জনে বর্তমান কমিশনের নিরলস প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে।

জানতে চাইলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, আগের তুলনায় দুদক অনেক দক্ষতা অর্জন করেছে এবং সাধারণ মানুষের কাছে পরিচিতি লাভ করেছে। কিছু কিছু কার্যক্রম দুদক সাফল্যের সঙ্গে গ্রহণ করেছে, যা মানুষের প্রত্যাশা আরও বাড়িয়েছে। প্রতিরোধমূলক কার্যক্রমে দুদক আগের তুলনায় অনেকটাই সাফল্য অর্জন করেছে।তিনি বলেন, দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে দুদকের যে ভূমিকা, তা বিতর্কিত। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সরকারের উচ্চপর্যায়ের লোককে জবাবদিহিতার আওতায় আনার চেষ্টা করেছে। কিছু ক্ষেত্রে তারা সফলও হয়েছে। কিন্তু আবার এর উলটো চিত্রও দেখা গেছে। শুধু চুনোপুঁটি নিয়েই দুদক নাড়াচাড়া করছে। রাঘববোয়ালদের ক্ষেত্রে সম্প্রতি দুদক খুব একটা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে, তা বলা যাবে না। সামর্থ্য অনুসারে দুদকের কাছ থেকে আমরা কিছুই পাইনি, তা-ও বলা যাবে না। তবে যেটুক সামর্থ্য ও সক্ষমতা ছিল, তার পর্যাপ্ত ব্যবহার হয়নি। এছাড়া এই দীর্ঘ সময়ে (১৭ বছরে) মাঝেমধ্যেই দুদকের নেতৃত্বে দৃঢ়চেতার ঘাটতি লক্ষ করা গেছে। সর্বক্ষেত্রে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে যে ভূমিকা রাখা উচিত ছিল, দুদক অনেক ক্ষেত্রেই তা পারেনি।

আস্থা অর্জনে ব্যর্থতা : চলতি বছরের অক্টোবর পর্যন্ত দুদকে ৩৮৭৪টি অভিযোগের অনুসন্ধান চলছে। একই সময়ে ১৫২১টি মামলা তদন্তাধীন রয়েছে। অপরদিকে কমিশনের মোট জনবল আছে ১০৮২ জন। এর মধ্যে অনুসন্ধান ও তদন্তের দায়িত্বে নিয়োজিত মাত্র দুইশ কর্মকর্তা। অর্থাৎ প্রতি কর্মকর্তার কাঁধে প্রায় ৩০টি অনুসন্ধান ও তদন্তের দায়িত্ব রয়েছে। ফলে আইনে বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে অনুসন্ধান ও তদন্ত শেষ করতে হিমশিম খাচ্ছেন কর্মকর্তারা। এতে অনুসন্ধান ও তদন্তের আশানুরূপ অগ্রগতি হচ্ছে না। এসব কারণে ব্যুরোর চেয়ে সক্ষমতা বেশি নিয়েও জনগণের আস্থা পুরোপুরি অর্জন করতে পারছে না বলে জানিয়েছেন কমিশনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।

সাংগঠনিক কাঠামোর পরিধি বৃদ্ধি : সাংগঠনিক কাঠামোর পরিসর বৃদ্ধির অনুমোদন দেওয়া হয়েছে তিন বছর আগে। এতদিন পর তা কার্যকর হতে চলেছে। চলমান ২২টি সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের সঙ্গে নতুন করে যুক্ত হচ্ছে ১৪টি সমন্বিত জেলা অফিস। প্রতিটি অফিসের অধীনে থাকছে একাধিক জেলা। আগামী ১ জানুয়ারি থেকে একটি এবং পহেলা জুলাই থেকে ১৩ জেলায় সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের যাত্রা শুরু হবে। এদিকে অনুমোদিত ২১৪০ জনের জায়গায় বর্তমানে দুদকে কর্মরত আছেন ১০৮২ জন। এছাড়া সহকারী পরিচালক ও উপসহকারী পরিচালক পদে মোট ২৮০ জনকে নিয়োগের প্রক্রিয়াটি প্রায় শেষ পর্যায়ে রয়েছে। দুই বছরের মধ্যে বর্তমান জনবলকে দ্বিগুণ করার পরিকল্পনা আছে কমিশনের।

দেশজুড়ে গোয়েন্দা তৎপরতা : চলতি বছরের অক্টোবর পর্যন্ত ৩২৫টি গোপন অভিযোগের অনুসন্ধান গোয়েন্দা ইউনিটের অধীনে চলমান। এর মধ্যে বর্তমান সরকারের মন্ত্রী থেকে শুরু করে অর্ধশতাধিক সরকারি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা আছেন। তাদের বিরুদ্ধে অত্যন্ত গোপনে তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহ হচ্ছে। একজন পরিচালকের নেতৃত্বে প্রতিটি জেলা কার্যালয়ের গোয়েন্দা কর্মকর্তা নিয়োগের মাধ্যমে এর কার্যক্রম দেশব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ২০১৮ সালের ৮ অক্টোবর দুদকের সাংগঠনিক কাঠামোতে যুক্ত হয়ে এই ইউনিট কার্যক্রম শুরু করে। অদ্যাবধি ৫৫০টি অভিযোগে গোপনে অনুসন্ধানের জন্য গৃহীত হয়। এর মধ্যে ২২৫টি নিষ্পত্তি হয়েছে। বাকি ৩২৫টি চলমান। এছাড়া গোয়েন্দা প্রতিবেদনের সুপারিশের ভিত্তিতে কমিশনের চেয়ারম্যানের অনুমোদনক্রমে ১৪২টি অভিযোগ প্রকাশ্য অনুসন্ধানের জন্য পাঠানো হয়েছে। গোয়েন্দা ইউনিট গঠন ও দেশজুড়ে এর তৎপরতা বৃদ্ধি কমিশনের সক্ষমতাকে আরও বহুগুণ বাড়িয়েছে।

দুর্নীতিবাজদের ফোনে আড়ি পাতা : সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, দুর্নীতিবাজদের ফোনে আড়ি পাতার সক্ষমতা দুদকের রয়েছে। তবে এই আড়ি পাতার কার্যক্রমটি সচরাচর করা হয় না। কমিশনের অনুমোদনক্রমে খুবই স্বল্প পরিসরে এ কার্যক্রম করা হয়। প্রতিষ্ঠিত রাঘববোয়াল দুর্নীতিবাজদের ধরতেই ফোনে আড়ি পাতার প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়।

সম্পদ ব্যবস্থাপনা : ব্যুরোর সময় সম্পদ ব্যবস্থাপনা ইউনিট না থাকলেও বর্তমানে পুরোদমে কাজ করছে কমিশনের এই ইউনিটটি। ২০১৯ সাল থেকে এই ইউনিটের যাত্রা শুরু। বিচারাধীন মামলার আওতাধীন সম্পদ জব্দ ও রক্ষণাবেক্ষণ এই ইউনিটের অন্যতম কাজ। এই ইউনিটের তথ্যানুসারে, গত আড়াই বছরে দুদকের মামলার পরিপ্রেক্ষিতে দুর্নীতিবাজদের প্রায় সাড়ে ৪০০ কোটি টাকার সম্পদ বাজেয়াপ্ত করেছেন আদালত। একই সময়ে আদালতের নির্দেশে ২১শ কোটি টাকার সম্পদ ক্রোক ও ফ্রিজ করা হয়েছে।

Top