২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলা সাজাপ্রাপ্ত আসামিকে ডিভিশনের প্রস্তাব!
আলোকিত বার্তা:২১ আগস্টের ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা মামলার সাজাপ্রাপ্ত আসামিকে ডিভিশন দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে কারা অধিদপ্তর। আদালতের দেওয়া আড়াই বছর আগের একটি আদেশ নিষ্পত্তির জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগে চিঠি দিয়েছেন কারা মহাপরিদর্শক (আইজি-প্রিজন) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মোমিনুর রহমান মামুন।সম্প্রতি পাঠানো এ সংক্রান্ত চিঠিতে মামলা নম্বরসহ ধারা উল্লেখ করা হলেও কোথাও চাঞ্চল্যকর ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার কয়েদির কথা বলা নেই। এছাড়া কারাবিধি অনুযায়ী এ ধরনের মামলার সাজাপ্রাপ্ত আসামির কোনো ধরনের ডিভিশন পাওয়ার সুযোগই নেই। তা সত্ত্বেও এভাবে এতদিন পর এ ধরনের চিঠি কেন পাঠানো হলো তার সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা চেয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। বিষয়টি নিয়ে রীতিমতো তোলপাড় অবস্থা চলছে মন্ত্রণালয় ও কারা অধিদপ্তরজুড়ে।
কারাগার সূত্র জানায়, ২০ জুন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো আইজি প্রিজন স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে বলা হয়, ডিএমপির সাবেক ডিসি (দক্ষিণ) খান সাইদ হাসান কাশিমপুর কারাগার-২ কয়েদি হিসাবে বন্দি আছেন। যার কয়েদি নং ৬২১৯/এ। তার আবেদন এবং আদালতের আদেশ অনুযায়ী তাকে কারাগারে ডিভিশন প্রদান করা হবে কিনা, সে বিষয়ে সরকারের সদয় সিদ্ধান্ত চাওয়া হয়।এছাড়া চিঠির দ্বিতীয় প্যারায় বলা হয়, ‘বর্ণিত কয়েদিকে বিজ্ঞ আদালত কর্তৃক দণ্ডবিধির ২১২ ও ২১৭ ধারায় সাজা প্রদান করত কারাবিধি মোতাবেক ডিভিশন দেওয়ার বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আদেশ দেওয়া হয়েছে। উক্ত কয়েদিকে ডিভিশন প্রদানের বিষয়ে কারাবিধি ১ম খণ্ডের ৬১৭ ধারা মোতাবেক সরকারের সিদ্ধান্ত জানানো প্রয়োজন।’
এদিকে এ চিঠি পাওয়ার পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা নড়েচড়ে বসেন। তারা চিঠির বিষয়বস্তু ও ৬১৭ ধারা পর্যালোচনা করে নিশ্চিত হন, কারাবিধি অনুযায়ী সাজাপ্রাপ্ত এ আসামি কোনোভাবে ডিভিশন পাওয়ার যোগ্য নন। যদিও আইজি প্রিজনের চিঠির কোথাও ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার কথা উল্লেখ করা হয়নি। প্রস্তাবটি পর্যালোচনা করতে গিয়ে স্বাভাবিকভাবে মামলার বিষয়টি সামনে আসে এবং মন্ত্রণালয় নিশ্চিত হয়, এ কয়েদি চাঞ্চল্যকর ও ন্যক্কারজনক নৃশংস গ্রেনেড হামলা মামলার সাজাপ্রাপ্ত আসামি। যিনি পলাতকও ছিলেন।
কারাবিধি ৬১৭ তে সাজাপ্রাপ্ত বন্দির ডিভিশনের বিষয়ে বিস্তারিত নির্দেশনা দেওয়া আছে। সেখানে ৬১৭(১)-এর ক, খ ও গ-তে বলা আছে- কারা ডিভিশন পাবেন। আবার ৬১৭(১)-এর এ, বি, সি, ডি এবং ই-তে স্পষ্টভাবে বলা আছে- কারা পাবেন না। যার প্রথমেই বলা আছে- নৃশংসতা, নৈতিকস্খলন এবং ব্যক্তিগত প্রতিহিংসামূলক অপরাধ; দ্বিতীয়ত, মারাত্মক বা পূর্বপরিকল্পিত হিংস্রতার অপরাধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকলে ডিভিশন পাবে না। এখানে বলার অপেক্ষা রাখে না যে, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার অপরাধটি ছিল স্মরণকালের ইতিহাসে বড় ধরনের একটি নৃশংস ঘটনা। ফলে এ মামলার কোনো আসামির কারাবিধি অনুযায়ী ডিভিশন পাওয়ার সুযোগ নেই।
এ রকম গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নকে সামনে রেখে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা বিভাগ থেকে আইজি প্রিজনকে ১১ জুলাই পালটা চিঠি দেওয়া হয়। সেখানে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যাখ্যা ও মতামত চাওয়া হয়েছে। উপরন্তু বলা হয়েছে, ৬১৭ বিধির আলোকে সরকারের কাছে সিদ্ধান্ত চাওয়া হয়েছে। অথচ এ বিধির বিষয়াবলি ব্যাখ্যা করে কোনো মতামত প্রদান করা হয়নি।এ বিষয়ে জানতে চাইলে আইজি প্রিজন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মোমিনুর রহমান মামুন রোববার বলেন, ‘সংশ্লিষ্ট কয়েদিকে ডিভিশন দেওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেওয়ার এখতিয়ার আইজি প্রিজনের হাতে নেই। তাই ৬১৭(৪) কারাবিধির আলোকে সরকার তথা মন্ত্রণালয়ের কাছে এ বিষয়ে সদয় সিদ্ধান্ত চাওয়া হয়েছে। এ উপবিধিতে সেটিই বলা আছে।
এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আদালত এ বিষয়ে আড়াই বছর আগে আদেশ দিয়েছিলেন, এটা সঠিক। তবে তিনি জুনে চিঠি দিয়েছেন ৭ ফেব্রুয়ারি কাশিমপুর কারাগার-২ থেকে আসা একটি চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে। জেল সুপারের পাঠানো চিঠিতে বন্দির২ আবেদনপত্র ও আদালতের আদেশের কপি সংযুক্ত করে বিষয়টি নিষ্পত্তির জন্য অনুরোধ করা হয়।এরপর তার কাছে এ সংক্রান্ত নথি উপস্থাপন করা হয় ২৮ ফেব্রুয়ারি। কিন্তু তিনি তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত না দিয়ে ৩ মাস পর্যালোচনা করে জুনে মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছেন।’ এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি দাবি করেন, ‘বিষয়টির সঙ্গে যে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার রায় জড়িত তা তিনি জানতেন না। যারা তার কাছে নথি উপস্থাপন করেছেন তারা এটি গোপন করেছেন।’এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা বিভাগের দায়িত্বশীল কোনো কর্মকর্তা মন্তব্য করতে চাননি।জানা যায়, ২০১৯ সালের ২৮ জানুয়ারি ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইন্যুনাল-১ এর আদালতে সাবেক ডিআইজি খান সাঈদ হাসান এবং সাবেক পুলিশ সুপার মো. ওবায়দুর রহমান খানের জামিন ও ডিভিশনের বিষয়ে শুনানি হয়। শুনানি শেষে বিচারক (জেলা ও দায়রা জজ) শাহেদ নূরউদ্দিন জামিন আবেদন নাকচ করে আসামিদ্বয়কে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন।
এছাড়া ডিভিশন প্রদানের বিষয়ে বিচারক তার আদেশে বলেন, ‘দরখাস্তকারী আসামি মো. ওবায়দুর রহমান খান ও খান সাঈদ হাসানের জেল কোডের বিধি ৬১৭ অনুসারে কারাগারে ডিভিশন-১ প্রদানের প্রার্থনা সংবলিত দরখাস্ত দেখলাম। আসামি পক্ষে নিযুক্ত বিজ্ঞ কৌঁসুলি ও বিজ্ঞ স্পেশাল পিপির বক্তব্য শুনলাম। জেল কোডের বিধানুসারে আসামিগণকে ডিভিশন দেওয়ার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য কারা কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেওয়া হলো।’২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশে নৃশংস গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। বর্বরোচিত ওই হামলায় আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক সম্পাদক ও প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভি রহমানসহ ২৪ জনকে অকালে জীবন দিতে হয়।আহত হন শতাধিক নেতাকর্মী ও গণমাধ্যম কর্মী। যাদের মধ্যে অনেকে পঙ্গুত্ববরণ করে কঠিন জীবন পাড়ি দিচ্ছেন। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী, তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা ভয়াবহতম ওই হামলায় প্রাণে বেঁচে গেলেও তার শ্রবণশক্তি চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।এ ঘটনায় মতিঝিল থানায় পৃথকভাবে তিনটি মামলা করা হয়। দীর্ঘ প্রতীক্ষা শেষে ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর ঢাকার এক নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক শাহেদ নূর উদ্দিন মামলার রায় ঘোষণা করেন।
৫২ জন আসামির মধ্যে তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুসহ ১৯ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। যাবজ্জীবন দেওয়া হয় আরও ১৯ জনকে। এছাড়া বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয় আরও ১১ জনকে।বাকি ৩ জনের অন্য মামলায় ফাঁসি কার্যকর হওয়ায় তাদের এ মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। এ মামলায় পলাতক ১৮ জনের মধ্যে দুজন ছিলেন উল্লিখিত ডিআইজি খান সাঈদ হাসান ও পুলিশ সুপার ওবায়দুর রহমান খান।ঘটনার সময় তারা ডিএমপিতে কর্মরত ছিলেন। পরে রায় ঘোষণার পর তারা আদালতে আত্মসমর্পণ করেন।