মূল চ্যালেঞ্জ বাণিজ্য সক্ষমতা বাড়ানো
আলোকিত বার্তা:স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বের হলে বাংলাদেশের কিছু বাণিজ্য ও অন্যান্য সুবিধা স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাতিল হয়ে যাবে। সবচেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জে পড়বে রপ্তানি বাণিজ্য। গরিব দেশ হিসাবে রপ্তানিতে ইউরোপ ও আমেরিকায় অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য সুবিধা (জিএসপি) পাওয়া যেত, তা বন্ধ হয়ে যাবে।এক্ষেত্রে সক্ষমতা বাড়িয়েই বিশ্ববাণিজ্যে প্রতিযোগী দেশগুলোর সঙ্গে টিকতে হবে-এমন মন্তব্য করেছেন অর্থনীতিবিদরা। তাদের আরও অভিমত-বিভিন্ন পণ্যে মেধাস্বত্বের জন্য মূল্য পরিশোধ এবং আইনকানুনে শৃঙ্খলা আনতে হবে। তবে এলডিসি উত্তরণের কিছু সুবিধাও রয়েছে। প্রথমত, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে এটি বড় ধরনের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। দ্বিতীয়ত, এর ফলে দেশের ভাবমূর্তি বৃদ্ধি এবং বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।শনিবার সঙ্গে আলাপকালে দেশের শীর্ষ অর্থনীতিবিদরা উল্লিখিত মন্তব্য করেন। প্রসঙ্গত, সক্ষমতা বিবেচনায় বিশ্বের দেশগুলোকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়। এর মধ্যে রয়েছে উন্নত, উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত দেশ। ৪৭টি স্বল্পোন্নত দেশের মধ্যে বর্তমানে বাংলাদেশও রয়েছে। কিন্তু জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসির (সিডিপি) সভায় শুক্রবার বাংলাদেশকে এলডিসি উত্তরণের চূড়ান্ত সুপারিশ করা হয়। এর ফলে বাংলাদেশ ২০২৪ সালে এই তালিকা থেকে বের হওয়ার কথা। কিন্তু করোনার প্রভাব মোকাবিলায় আরও ২ বছর বেশি সময় চেয়েছে বাংলাদেশ। অর্থাৎ ২০২৬ সালের পর বাংলাদেশ আর এলডিসি তালিকায় থাকছে না। মূলত তিনটি সূচকের ভিত্তিতে এই মূল্যায়ন করা হয়। এগুলো হলো-মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ এবং অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা। এর মধ্যে যে কোনো দুটি সূচকে মানদণ্ড পরিপূর্ণ করতে হবে। নিয়ম অনুসারে উন্নয়নশীল দেশ হতে হলে তিন বছর গড় মাথাপিছু আয় লাগবে ১ হাজার ২৩০ ডলার; কিন্তু বাংলাদেশের মাথাপিছু গড় আয় ১ হাজার ৮২৭ ডলার। মানবসম্পদ উন্নয়নে সূচকের মানদণ্ড ৬৬। বিপরীতে বাংলাদেশের অর্জন ৭৫ দশমিক ৪। আর অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচক ৩২ এর নিচে থাকতে হবে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান ২৭। অর্থাৎ তিন সূচকেই মানদণ্ড পরিপূর্ণ করেছে বাংলাদেশ। অন্যদিকে এ বছর নেপাল ও লাওসকে এলডিসি উত্তরণের সুপারিশ করা হয়েছে। তবে ২০১৮ সালে মিয়ানমারকে একই সুপারিশ করা হলেও সামরিক আইন জারির কারণে তা প্রত্যাহার করা হয়েছে।
জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, এলডিসি উত্তরণের সবচেয়ে ইতিবাচক দিক হলো, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে বাংলাদেশের জন্য বড় স্বীকৃতি মিলেছে। আর্থসামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশ যে এগিয়ে যাচ্ছে, তা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়া গেল। এতে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি বাড়বে। বাংলাদেশের ব্র্যান্ডিং হলো। ক্রেডিট রেটিংয়ে এগিয়ে যাবে। বিদেশে সার্বভৌম বন্ড ছাড়তে পারবে। এলডিসি উত্তরণে তিনটি চ্যালেঞ্জ রয়েছে। প্রথমত, বিশ্ববাণিজ্যে বর্তমানে বিভিন্ন সুবিধা পাচ্ছি আমরা। এগুলো বন্ধ হয়ে যাবে। দ্বিতীয় মেধাস্বত্বের জন্য আমাদেরকে অর্থ দিতে হয় না। এটিও থাকবে না। তৃতীয়ত, আইনকানুনে কিছু শৃঙ্খলা আনতে হবে। এক্ষেত্রে বিভিন্ন খাতে ভতুর্কি ও প্রণোদনা দেওয়ার সুযোগ কমে আসবে। সামগ্রিকভাবে এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বিভিন্ন সক্ষমতা, উৎপাদনশীলতা এবং অংশীদারত্ব বাড়াতে হবে। এক্ষেত্রে অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা এই আলোকে সাজাতে হবে। আগামী ৫ বছরকে প্রস্তুতিকাল হিসাবে বিবেচনা করতে হবে।বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, এটি বাংলাদেশের জন্য বড় একটি স্বীকৃতি। এর ফলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি বাড়বে। তবে অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। বিদেশি বিনিয়োগ বাড়তে পারে। বিশেষ করে বাণিজ্য সুবিধা কমবে। ব্যবসা-বাণিজ্যে এর প্রভাব পড়বে। আর এ অবস্থার উত্তরণে বেশকিছু কাজ করতে হবে। বিশেষ করে আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করতে হবে। স্বচ্ছতা ও জবাবহিদিতা বাড়াতে হবে। তিনি বলেন, ২০২৬ সাল খুব বেশি দূরে নয়। ফলে আমাদের দ্রুত কাজ করতে হবে।
চ্যালেঞ্জ : এলডিসি উত্তরণের পর সবচেয়ে সমস্যায় পড়বে রপ্তানি খাত। কারণ, গরিব দেশ হিসাবে বাংলাদেশ বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) আওতায় শুল্কমুক্ত বাণিজ্য সুবিধা পায়। ইউরোপীয় ইউনিয়নের আঞ্চলিক বা দ্বিপক্ষীয় ভিত্তিতেও এই ধরনের শুল্ক সুবিধা পেয়ে থাকে। বিদ্যমান নিয়ম অনুযায়ী, ২০২৬ সালে এসব সুবিধা বন্ধ হয়ে যাবে। এতে বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের পণ্যের ওপর নিয়মিত হারে শুল্ক বসবে। সম্প্রতি প্রকাশিত ডব্লিউটিওর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই বাড়তি শুল্কের কারণে রপ্তানি বছরে ৫৩৭ কোটি ডলার বা সাড়ে ৪৫ হাজার কোটি টাকা কমতে পারে। বড় চ্যালেঞ্জে পড়বে ওষুধশিল্প। এলডিসি থেকে বের হলে ওষুধশিল্পের ওপর মেধাস্বত্ব বিধিবিধান আরও কড়াকড়ি হবে। এলডিসি হিসাবে বাংলাদেশের ওষুধ প্রস্তুতকারক কোম্পানিগুলোকে আবিষ্কারক প্রতিষ্ঠানকে মেধাস্বত্বের জন্য অর্থ দিতে হয় না। নতুন করে মেধাস্বত্বের (পেটেন্ট) ওপর অর্থ দিতে হবে। দ্বিতীয়ত, বর্তমানে ওষুধের ৯৭ শতাংশ কাঁচামাল বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। কিন্তু এলডিসির কারণে এসব পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা রয়েছে। এসব সুবিধা প্রত্যাহার হয়ে যাবে। এতে ওষুধের দাম বাড়বে। একই সমস্যায় পড়বে আইটি খাত। কারণ, বর্তমানে এখানেও মেধাস্বত্বের ওপর অর্থ দিতে হয় না। এলডিসি থেকে উত্তরণ হওয়া দেশগুলোর অর্থনৈতিক সক্ষমতা বেশি বলে ধরে নেওয়া হয়। তখন আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থাগুলোর কাছ থেকে সহজ শর্তের ঋণ পাওয়ার সুযোগ সীমিত হতে পারে। এ কারণে বাংলাদেশও এ ধরনের সমস্যায় পড়তে পারে। এছাড়া এলডিসি হিসাবে যে কোনো দেশ তার দেশে উৎপাদিত পণ্য বা সেবার ওপর নগদ সহায়তা ও ভর্তুকি দিতে পারে। বাংলাদেশ এখন কৃষি ও শিল্প খাতের নানা পণ্য বা সেবায় ভর্তুকি দেয়। এসব ভর্তুকি ও নগদ সহায়তা দেওয়া বন্ধ করার চাপ আসবে। এমনকি বাংলাদেশ এখন যে রপ্তানি আয় বা রেমিট্যান্স আনায় নগদ সহায়তা দেয়, তা নিয়ে আপত্তি উঠতে পারে। এলডিসি থেকে বের হলে জাতিসংঘে চাঁদার পরিমাণ বেড়ে যাবে। বাংলাদেশকে আগের চেয়ে বেশি খরচ করতে হবে। এছাড়া স্বল্পোন্নত দেশগুলোর সরকারি কর্মকর্তারা জাতিসংঘের বিভিন্ন সভায় যোগ দিতে সৌজন্য টিকিট পান। গরিব দেশের কর্মকর্তা হিসাবে এই টিকিট দেওয়া হয়। ২০২৬ সালের পর এ ধরনের বিনা পয়সার টিকিট মিলবে না। আবার আন্তর্জাতিক সংস্থা ও উন্নত দেশগুলো স্বল্পোন্নত দেশের শিক্ষার্থীদের নানা ধরনের বৃত্তি দেয়। এলডিসি থেকে উত্তরণ হলে এ ধরনের বৃত্তির সংখ্যা কমবে।
সম্ভাবনা : এলডিসি থেকে উত্তরণ হলে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে। গরিব দেশের তকমা থাকবে না। অর্থনৈতিক সক্ষমতার কারণে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক ঋণদাতা সংস্থাগুলোর কাছ থেকে বেশি সুদে অনেক বেশি ঋণ নেওয়ার সক্ষমতা বাড়বে। বেশি ঋণ নিতে পারলে অবকাঠামো ও মানবসম্পদ উন্নয়নে আরও বেশি খরচ করতে পারবে বাংলাদেশ। আবার অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা মোকাবিলায় যথেষ্ট সক্ষমতা থাকায় বিদেশি বিনিয়োগও আকৃষ্ট হবে।১৯৭১ সালে প্রথম স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা করা হয়। বাংলাদেশ ১৯৭৫ সালে এই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়। সবকিছু ঠিক থাকলে ৫ বছর পর এলডিসি থেকে বের হয়ে অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের কাতারে চলে যাবে বাংলাদেশ। সাধারণত সিডিপির চূড়ান্ত সুপারিশের ৩ বছর পর জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে চূড়ান্ত স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এ পর্যন্ত মালদ্বীপ, বতসোয়ানা, ইকুয়েটোরিয়াল গিনি ও সামোয়া-এই চার দেশ এলডিসি থেকে বের হয়েছে।