নানা দুর্বলতা নিয়েই তৈরি হচ্ছে উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব
আলোকিত বার্তা:নানা দুর্বলতা নিয়েই তৈরি হচ্ছে উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি)।গোড়ায় গলদ থাকায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নির্ধারিত মেয়াদ ও ব্যয়ের মধ্যে বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না প্রকল্পগুলো। সেই সঙ্গে শুরুতেই নানা ধরনের অপ্রয়োজনীয় ও অতিরিক্ত ব্যয় প্রস্তাব করায় পরে অনিয়ম ও দুর্নীতির সুযোগ তৈরি হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কোনো কোনো প্রকল্প তৈরিতে মানা হচ্ছে না নিয়মনীতিও।এ কারণে শেষ পর্যন্ত জনগণের করের টাকা যেমন গচ্ছা যাচ্ছে, তেমনই প্রকল্পের সুফল থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে সাধারণ মানুষ। প্রকল্প তদারকির একমাত্র সরকারি সংস্থা বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এ চিত্র। এছাড়া কয়েক মাসে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো থেকে প্রস্তাবিত নতুন ও সংশোধিত প্রকল্প পর্যালোচনায়ও একই তথ্য মিলেছে।আইএমইডি’র সাবেক সচিব আবুল মনসুর মো. ফয়জুল্লাহ সোমবার বলেন, এদেশের ৮০ ভাগ উন্নয়ন প্রকল্পই সংশোধন করতে হয়। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে প্রকল্প তৈরির সময়ই অনেক সময় সম্ভাব্যতা সমীক্ষা করা হয় না। আবার সমীক্ষা করলেও সেটি যথাযথভাবে করা হয় না। ফলে পরে সবকিছুই তালগোল পেকে যায়। তাছাড়া বাস্তব কারণেও কিছু প্রকল্প সংশোধন করতে হয়। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই প্রকল্প তৈরিতেই সমস্যা থাকে।২০১৫-১৬ অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) পর্যালোচনা করে প্রতিবেদন তৈরি করেছে আইএমইডি। সেখানে বলা হয়, এডিপি বাস্তবায়নের এক নম্বর সমস্যাই হচ্ছে প্রয়োজনীয় সম্ভাব্যতা সমীক্ষা ছাড়াই সরকারি খাতে অনেক প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। সংস্থাটি বলেছে, যথাযথ সম্ভাব্যতা সমীক্ষার মাধ্যমে প্রকল্প গ্রহণ করার বিষয়ে সর্বোচ্চ পর্যায়ের নির্দেশনা রয়েছে। তা প্রতিপালনে মন্ত্রণালয়, বিভাগ বা সংস্থাগুলো যথাযথ ব্যবস্থা নিচ্ছে না। এদিকে আগে ২৫ কোটির বেশি টাকার প্রকল্প হলেই সম্ভাব্যতা সমীক্ষা করা বাধ্যতামূলক ছিল। এখন তা ৫০ কোটি টাকা করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, প্রকল্প তৈরির বিদ্যমান কাঠামো আধুনিক প্রকল্প ব্যবস্থাপনার তুলনায় অতিপুরনো। এতে গতানুগতিকভাবে আর্থিক খাতের ওপরই বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়। কিন্তু ডিপিপি বা টিপিপিতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যেমন, ফ্রন্ট-ইন্ড প্ল্যানিং, স্টেকহোল্ডার অ্যানালাইসিস অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট, সিডিউল ম্যানেজমেন্ট, রিস্ক ম্যানেজমেন্ট, কোয়ালিটি ম্যানেজমেন্ট এবং প্রজেক্ট সাকসেস ক্রাইটেরিয়া ইত্যাদি বিষয় যথাযথভাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয় না।এ কারণে প্রকল্প পরিকল্পনা প্রণয়নে দুবর্লতা পরিলক্ষিত হয়। স্বল্পসময়ে এবং কম অভিজ্ঞতাসম্পন্ন জনবল দিয়ে প্রকল্প প্রস্তাব তৈরিই এ সমস্যার প্রধান উৎস। আরও যেসব সমস্যা তুলে ধরা হয়েছে সেগুলোর অন্যতম হচ্ছে প্রকল্পের লজিক্যাল ফ্রেমওয়ার্ক যথাযথভাবে প্রণয়ন করা হয় না। অনেক ক্ষেত্রে প্রকল্প বাস্তবায়নে ডিপিপি বা টিপিপিতে উল্লিখিত ওয়ার্ক প্ল্যান এবং প্রকিউরমেন্ট প্ল্যান যথাযথভাবে অনুসরণ করাও হয় না।এ প্রসঙ্গে বিশ্ব ব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন যুগান্তরকে বলেন, কেন প্রকল্প বারবার সংশোধন করতে হয়, এর প্রকৃত কারণ খুঁজতে হবে। প্রতি সপ্তাহে একনেকে যদি প্রকল্প পাসের চাপ থাকে, তাহলে তো প্রকল্প তৈরিতে তাড়াহুড়ো থাকবেই। তাছাড়া মন্ত্রণালয়গুলোও তাড়াহুড়ো করে উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করে। এর কারণ হচ্ছে প্রকল্প করতে না পারলে তো বাড়তি সুযোগের পথ বন্ধ হয়ে যাবে।এক্ষেত্রে তৃতীয় পক্ষ হিসেবে পরিকল্পনা কমিশনকে কঠোর হতে হবে। আর বিদেশ প্রশিক্ষণ নিয়ে এখন জনপ্রশাসনের উচিত একটি জরিপ পরিচালনা করা। এ পর্যন্ত এই খাতে কত টাকা ব্যয় হয়েছে, কত কর্মকর্তা বিদেশ গেছেন, কী শিখে এসেছেন, সেগুলো কাজে লেগেছে কি না-এসব বিষয় তুলে ধরা উচিত। এ রকম ব্যয় প্রস্তাবে অনিয়ম ও দুর্নীতির ব্যাপক সুযোগ তৈরি হয়।বেশ কয়েকটি প্রকল্প পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ‘ঢাকা-টঙ্গী সেকশনে ৩য় ও ৪র্থ ডুয়েল গেজ লাইন এবং টঙ্গী-জয়দেবপুর সেকশনে ডুয়েল গেজ ডাবল লাইন নির্মাণ’ প্রকল্পটি অনুমোদন দেয়া হয় ৮ বছর আগে। এ দীর্ঘ সময়ে রেলপথ নির্মাণে বিশদ নকশা, টেন্ডারিং সার্ভিসসহ মূল কাজের অনেকই হয়নি। সার্বিক অগ্রগতি হয়েছে মাত্র ৩৬ শতাংশ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রকল্পটির গোড়াতেই গলদ থাকায় এ অবস্থা দাঁড়িয়েছে। এখন চুক্তির বাইরে নতুন করে অতিরিক্ত অর্থ দাবি করছে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান। এরই পরিপ্রেক্ষিতে বাড়তি অর্থ দেয়ার বিধান আছে কি না, তা খতিয়ে দেখছে রেলপথ মন্ত্রণালয়।
বিটিসিএল’-এর ‘বিদ্যমান অপটিক্যাল ফাইবার ক্যাবল নেটওয়ার্কের উন্নয়ন ও রিং টাইপ নেটওয়ার্কে রূপান্তর’ প্রকল্পে অনুমোদনের আগেই প্রকল্পের ব্যয় বেড়েছে ২৪৩ শতাংশ। প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভায় ব্যয় প্রস্তাব করা হয়েছিল ৩৬৮ কোটি ৪০ লাখ টাকা। কিন্তু পরে পুনর্গঠিত ডিপিপিতে (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব) ৮৯৬ কোটি টাকা বাড়িয়ে মোট ব্যয় প্রস্তাব করা হয় ১ হাজার ২৬৫ কোটি ১৪ লাখ টাকা। এ নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছে পরিকল্পনা কমিশন। বলেছে, মাত্র এক বছরের মধ্যেই প্রকল্পের কার্যপরিধি ও ব্যয় এত বৃদ্ধির বিষয়টি যৌক্তিক প্রতীয়মান হয় না।ওয়েস্ট জোন এলাকায় বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থার সম্প্রসারণ ও আপগ্রেডেশন’ প্রকল্পে তিন বছরে ভৌত অগ্রগতি মাত্র ৩৪ দশমিক ৫ শতাংশ। আর্থিক অগ্রগতি ২৬ শতাংশ। ধীরগতির কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, ডিপিপি তৈরিতে পরিকল্পনায় ঘাটতি ছিল। এছাড়া বাস্তবায়ন পর্যায়ে ছিল বিভিন্ন সমস্যা। আইএমইডির সাম্প্রতিক এক নিবিড় পরিবীক্ষণের খসড়া প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে আসে।সংশ্লিষ্টরা বলছেন, উন্নয়ন প্রকল্পে অপ্রয়োজনীয় ও অতিরিক্ত ব্যয় প্রস্তাব এখন স্বাভাবিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাম্প্রতি ঘাসের চাষ শিখতে ৩২ কর্মকর্তার বিদেশ সফরের প্রস্তাব করা হয় ‘প্রাণিপুষ্টির উন্নয়নে উন্নত জাতের ঘাসের চাষ সম্প্রসারণ ও লাগসই প্রযুক্তি হস্তান্তর’ প্রকল্পে। এজন্য প্রত্যেকের পেছনে ১০ লাখ টাকা করে মোট চাওয়া হয় ৩ কোটি ২০ লাখ টাকা।এছাড়া সরকারি কর্মকর্তাকে খিচুড়ি রান্না শিখতে বা অভিজ্ঞতা অর্জন করতে বিদেশে পাঠানোর প্রস্তাব করে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর (ডিপিই)। স্কুল ফিডিং কর্মসূচির আওতায় প্রশিক্ষণের জন্য তাদেরকে বিদেশ পাঠানোর এই উদ্যোগ। এজন্য বরাদ্দ চাওয়া হয় ৫ কোটি টাকা।একই অবস্থা ‘কপোতাক্ষ নদের জলাবদ্ধতা দূরীকরণ (দ্বিতীয় পর্যায়)’ প্রকল্পেও। জলাবন্ধতা নিরসনে খাল খনন প্রকল্পে বিদেশ সফরের জন্য দেড় কোটি টাকার প্রস্তাব করা হয়। সেই সঙ্গে ছিল বেশকিছু খাতে অপ্রয়োজনীয় ব্যয় প্রস্তাবও। সম্প্রতি ‘রিচিং আউট অব স্কুল চিলড্রেন (রক্স)’ দ্বিতীয় পর্যায় প্রকল্পের তৃতীয় সংশোধনীতে ৬টি সংস্থার প্রতিনিধির বিদেশ সফরের প্রস্তাব করা হয়।প্রকল্পটির আওতায় এর আগে বৈদেশিক সফর খাতে বরাদ্দ ছিল ১৪ কোটি ৭১ লাখ টাকা। এখন তৃতীয় সংশোধনী প্রস্তাবে অতিরিক্ত আরও ১০ কোটি ১৫ লাখ টাকা বরাদ্দ ধরা হয়।পরিকল্পনা কমিশনের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ইকোনমিক ক্যাডার বিলুপ্ত করায় এর একটি ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে বা পড়বে প্রকল্প প্রস্তাব মূল্যায়নের ক্ষেত্রে। কেননা একটি বিশেষায়িত ক্যাডার হওয়ায় তারা প্রকল্প মূল্যায়নের খুঁটিনাটি বিষয়গুলো তুলে ধরতে পারতেন। এখন প্রশাসন ক্যাডারের লোকজন এসে সেইভাবে বুঝতে পারছেন না। ফলে মূল্যায়নও সঠিক হবে না।