কেন্দ্রীয় ঔষধাগার ৫শ’ কোটি টাকা চেয়েছে
আলোকিত বার্তা:করোনা মোকাবেলায় দ্রুত প্রায় ৫শ’ কোটি টাকা অনুমোদন ও ছাড় চেয়েছে সিএমএসডি (সেন্ট্রাল মেডিকেল স্টোর ডিপো বা কেন্দ্রীয় ঔষধাগার)।এর মধ্যে ১শ’ কোটি টাকা থোক বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে।এতে পিসিআর টেস্টের কিট বাবদ ৮৫ কোটি ৭৫ লাখ টাকাও আছে।গত ৫ জুলাই স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালককে লেখা এক চিঠিতে সিএমএসডি পরিচালক আবু হেনা মোরশেদ জামান এ অর্থ চেয়েছেন। মোট ৪৯৮ কোটি ৫৫ লাখ ৯৮ হাজার ২শ’ টাকা তিনি চান।এসব বিষয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্যসচিব, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব এবং স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব অবহিত আছেন বলে চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে এ বিষয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে কিছুই জানানো হয়নি।এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী জাহিদ মালেক শুক্রবার বিকালে টেলিফোনে বলেন, এ বিপুল অঙ্কের টাকা ছাড় করার কোনো কাগজপত্র আমার কাছে আসেনি। এ বিষয়ে এখনও আমাকে কিছুই জানানো হয়নি। তাই আমি কিছুই বলতে পারছি না।
স্বাস্থ্য অধিদফতর ও মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, দরপত্র ছাড়াই সরাসরি পণ্য ক্রয়ের কার্যাদেশ দেয়া হয়েছে। এর আওতায় নানা কারণে বিতর্কিত ব্যবসায়ী মিঠুর সিন্ডিকেটভুক্ত একটিসহ মোট চারটি প্রতিষ্ঠান কাজ পেয়েছে। বাকি তিনটিও স্বাস্থ্য বিভাগে একচেটিয়া কাজ করে আসছে।ঠিকাদারদের বিল দিতেই সিএমএসডির এ তোড়জোড়। সম্প্রতি জেরিন এন্টারপ্রাইজকে ২৩০০ টাকা দরে ১ লাখ ৫০ হাজার স্যানশিওর বায়োটেক ব্র্যান্ডের টেস্ট কিটের কার্যাদেশ দেয়া হয়েছে; যার মূল্য ৩৪ কোটি ৫০ লাখ টাকা।
স্টার্লিং মাল্টি টেকনোলজিস লিমিটেডকে ২১০০ টাকা ইউনিট মূল্যে ২৫ হাজার এন্যাটোলিয়া ব্র্যান্ডের টেস্ট কিটের কার্যাদেশ দেয়া হয়েছে; যার মূল্য ৫ কোটি ২৫ লাখ টাকা।
মাইশা রাও টেলসেট জেভিকে ২৩০০ টাকা ইউনিট মূল্যে ৫০ হাজার বায়োনির ব্র্যান্ডের টেস্ট কিট সরবরাহের আদেশ পেয়েছে; যার মূল্য ১১ কোটি ৫০ লাখ টাকা।ওভারসিজ মার্কেটিং কর্পোরেশন-ওএমসিকে ২৩০০ টাকা দরে ১ লাখ ৫০ হাজার স্যানশিওর বায়োটেক ব্র্যান্ডের টেস্ট কিটের কার্যাদেশ দেয়া হয়েছে; যার মূল্য ৩৪ কোটি ৫০ লাখ টাকা। চারটি কার্যদেশের মোট মূল্য ৮৫ কোটি ৭৫ লাখ টাকা।আলাদা এক চিঠিতে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিবকে সিএমএসডির পরিচালক জানান, কোভিড-১৯ মোকাবেলায় টেস্ট কিট গুরুত্বপূর্ণ। এতদিন সিএমএসডিতে কিছু প্রতিষ্ঠান একচেটিয়া ব্যবসা করলেও তিনি যোগদানের পর তা ভেঙে দিয়েছেন বলে দাবি করেন।
স্বাস্থ্য অধিদফতর ও অন্যান্য সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে সাপ্লাই চেন অব্যাহত রাখতে প্রধামন্ত্রীর কার্যালয়ের মৌখিক নির্দেশনা ও স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের পরামর্শে ডিপিএম পদ্ধতিতে উল্লেখিত চারটি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেয়া হয়েছে বলে তিনি জানান।চিঠিতে যেসব খাতে দ্রুততম সময়ে বাজেট ছাড়ের কথা বলা হয়েছে সেগুলো হল- কোভিড-১৯ পরিস্থিতি মোকাবেলায় জরুরিভিত্তিতে বিভিন্ন মেডিকেল সামগ্রী কিনতে ২৭৯ কোটি ৪৮ লাখ ৯৮ হাজার ২শ’ টাকা। ইতোমধ্যে কার্যাদেশ দেয়া ৩ লাখ ৭৫ হাজার পিসিআর টেস্ট কিটের মূল্য বাবদ ৮৫ কোটি ৭৫ লাখ টাকা।বিসিএসআইআর থেকে ২ লাখ টেস্ট স্যাম্পল কিট (ভিটিএম ও সোয়াব স্টিক) ক্রয়বাবদ ৩৩ কোটি ৩২ লাখ টাকা এবং কোভিড-১৯ পরিস্থিতি মোকাবেলায় জরুরি থোক বরাদ্দ ১০০ কোটি টাকা। মোট ৪৯৮ কোটি ৫৫ লাখ ৯৮ হাজার ২শ’ টাকা অনুমোদনের অনুরোধ জানানো হয়েছে।
এই বিপুল টাকা বরাদ্দ প্রসঙ্গে তিনি চিঠিতে উল্লেখ করেন, ইতোপূর্বে টেস্ট কিট সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের ৮৫ কোটি ৭৫ লাখ টাকা বিল না পেয়ে আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে এবং নতুন কিট সরবরাহ করবে না।সময়মতো ভিটিএম ও সোয়াব স্টিকের ৩৩ কোটি ৩২ লাখ টাকা বিল না দিলে বিসিএসআইআর ভিটিএম ও সোয়াব স্টিক সরবরাহে নিরুৎসাহিত হবে।জরুরিভিত্তিতে ২৭৯ কোটি ৪৮ লাখ ৯৮ হাজার ২শ’ টাকা পাওয়া না গেলে বড় বাজেটের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মেডিকেল সরঞ্জাম যেমন- হাইফ্লো নেজাল ক্যানোলা, পোর্টেবল এক্সরে মেশিন, অক্সিজেন কনসেনট্রেটর, আইসিইউ শয্যা ইত্যাদি সরবরাহকারীদের চুক্তি অনুযায়ী পর্যায়ক্রমিক আংশিক বিল প্রদান করা যাবে না।ফলে এসব জরুরি মেডিকেল সামগ্রীর সাপ্লাই চেন ব্যাহত হবে।এই টাকা ছাড়ের বিষয়ে তিনি চিঠিতে উল্লেখ করেন, টাকা দ্রুত ছাড় করা না হলে কোভিড-১৯ চিকিৎসা মারাত্মক ব্যাহত হবে এবং তীব্র জনঅসন্তোষ তৈরি হবে এবং সরকারের ভাবমূর্তি দারুণভাবে ক্ষুণ্ন হবে। সর্বোপরি বিপর্যয়কর পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটতে পারে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ শুক্রবার সন্ধায় টেলিফোনে বলেন,এ সংক্রান্ত চিঠি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় হয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ে যাবে। টাকা ছাড় করে অর্থ মন্ত্রণালয়।টাকা ছাড় হয়েছে কিনা সেটি এখনও তিনি জানেন না। বিতর্কিত প্রতিষ্ঠানে কাজ দেয়া প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, কাকে কীভাবে কাজ দেয়া হয়েছে সেটি তার জানা নেই।স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিবকে দেয়া চিঠিতে সিএমএসডি পরিচালক বলেন, স্বাস্থ্য অধিদফতরের চাহিদা এবং আইইডিসিআরের সুপারিশে দর কষাকষির মাধ্যমে আগের একচেটিয়া ব্যবসায়িক আধিপত্য অকেজো করা হয়েছে।ফলে অনেক কম মূল্যে টেস্ট কিট সংগ্রহের কার্যাদেশ দিয়েছি। ইতোমধ্যে অনেক কিট ব্যবহারকারী প্রতিষ্ঠানে বিতরণ করা হয়েছে। সরবরাহকারীরা জানিয়েছেন, আগের পাওনা পরিশোধ না করায় আর্থিক সংকটে তারা ক্ষতিগ্রস্ত। নতুন করে টেস্ট কিট দিতে পারছে না।খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এই চারটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে তিনটি প্রতিষ্ঠান তিনি যোগদানের আগেও টেস্ট কিট সরবরাহ করেছে এবং এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ রয়েছে।
পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক স্বাস্থ্য অধিদফতরের হাসপাতাল শাখার একাধিক কর্মকর্তা বলেন, যে দামে চারটি প্রতিষ্ঠানকে টেস্ট কিট আমদানির কার্যাদেশ দেয়া হয়েছে, কিটের মূল্য এর চেয়ে কম।এক হাজার ৭শ’ টাকা থেকে এক হাজার ৮শ’ টাকায় একই মানের টেস্ট কিট আমদানি করা সম্ভব। তাছাড়া এই চারটির মধ্যে তিনটি প্রতিষ্ঠান আগে থেকেই টেস্ট কিট সরবরাহের কাজ করছে।এক্ষেত্রে একচেটিয়া ব্যবসা বদলানোর কোনো ঘটনা ঘটেনি। সবচেয়ে বড় কথা হল এ কার্যাদেশে বিতর্কিত এবং সমালোচিত একটি প্রতিষ্ঠানকে বড় অঙ্কের টাকার কাজ দেয়া হয়েছে।বড় ধরনের দুর্নীতির অভিযোগে যার একাধিক প্রতিষ্ঠানকে বিগত কয়েক বছর ধরে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কাজ দেয়া থেকে বিরত আছে। তারা বলেন, সিএমএসডির ভূতপূর্ব পরিচালক এ পদ থেকে বিদায় নেয়ার আগে যে লিখিত বক্তব্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পেশ করেন সেখানেও তিনি এ বিষয়টি উল্লেখ করেছেন।তিনি বলেছিলেন- বিতর্কিত এক ঠিকাদারকে কাজ না দেয়ায় তাকে দায়িত্ব ছাড়তে হচ্ছে। অথচ বর্তমান পরিচালক দায়িত্ব গ্রহণ করে সেই বিতর্কিত ব্যক্তির একটি প্রতিষ্ঠানকে কার্যাদেশ দিয়েছেন।
এ প্রসঙ্গে কথা বলতে সিএমএসডির পরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) আবু হেনা মোরশেদ জামানের মোবাইলে ফোন করলে সেটি বন্ধ পাওয়া যায়।সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গত এক যুগ ধরেই স্বাস্থ্য খাতে আধিপত্য বিস্তার করে আসছে বিতর্কিত ঠিকাদার মোতজ্জেরুল ইসলাম মিঠু ও তার সিন্ডিকেট। সাবেক এক স্বাস্থ্যমন্ত্রীসহ ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সিন্ডিকেট করে স্বাস্থ্য খাতে একচেটিয়া রাজত্ব করেন আলোচিত এই ঠিকাদার।মিঠুর লেক্সিকোন মার্চেন্ডাইজ এবং টেকনোক্র্যাট লিমিটেড নামে দুটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে স্বাস্থ্য খাতের প্রায় ৯০ শতাংশ যন্ত্রপাতি সরবরাহ করা হয়। এছাড়া যন্ত্রপাতি সরবরাহ না করে বা খালি বাক্স দিয়েও কোটি কোটি টাকার বিল তুলে নেয়ার ঘটনাও আছে।২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর মোহাম্মদ নাসিম স্বাস্থ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পাওয়ায় কিছুটা বেকায়দায় পড়লেও অল্প কিছুদিনের মধ্যেই মিঠু মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ পর্যায়ের একাধিক কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করে ফেলেন।কেন্দ্রীয় ঔষধাগারের (সিএমএসডি) বিদায়ী পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. শহীদউল্লাহ গত ৩০ মে জনপ্রশাসন সচিবের কাছে লেখা এক চিঠিতে স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতির কিছু তথ্য তুলে ধরেন।তাতে তিনি স্পষ্টভাবেই ঠিকাদার মিঠুর নাম উল্লেখ করেন। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং অধিদফতরের কিছু কর্মকর্তার যোগসাজশে ঠিকাদার মিঠু কীভাবে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন সেই তথ্যও চিঠিতে জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় ঔষধাগারের (সিএমএসডি) বিদায়ী পরিচালক।তারই সিন্ডিকেটভুক্ত প্রতিষ্ঠান জেরিন এন্টারপ্রাইজকে এবার টেস্ট কিট সরবরাহের কার্যাদেশ দিয়েছে সিএমএসডি। স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতি নিয়ে গণমাধ্যমে একের পর এক খবর প্রকাশের পর অবশেষে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তাকে তলব করে।এর আগে নির্দিষ্ট সময়ে সম্পদের হিসাব না দেয়ায় ২০১৬ সালে মিঠুর বিরুদ্ধে মামলা করেছিল দুদক।