জেলেরা বলছেন ভিন্ন কথা,হালদার ডিম নিয়ে ‘রেকর্ডবাজি’
আলোকিত বার্তা:দেশের একমাত্র কার্পজাতীয় মাছের প্রাকৃতিক প্রজননক্ষেত্র চট্টগ্রামের হালদা নদীতে শুক্রবার সকাল সাড়ে ৭টা থেকে রুই, কাতলা, মৃগেল ও কালবাউশ মা–মাছ পুরোদমে ডিম ছাড়তে শুরু করে। বিকেল ৩টার কিছু পরই চট্টগ্রাম জেলা মৎস্য অধিদফতরের পক্ষ থেকে গণমাধ্যমে পাঠানো এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে দাবি করা হয়, গত ১৪ বছরের মধ্যে এবার সর্বোচ্চ ডিম সংগ্রহ হয়েছে। যদিও সেদিন এর পরও প্রায় আরও তিন ঘণ্টা ধরে নদী থেকে ডিম সংগ্রহ করেন জেলেরা।গত শুক্রবার বিকেলে জেলা মৎস্য কর্মকর্তা ফারহানা লাভলী স্বাক্ষরিত সেই প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, ‘সকাল সাড়ে ৭টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত ডিম পাওয়া গেছে ২৫ হাজার ৫৩৬ কেজি। ২৮০টি নৌকা নিয়ে ৬১৬ সংগ্রহকারী এ ডিম সংগ্রহ করেন। যেখানে গত বছর ডিম সংগ্রহ হয়েছিল মাত্র সাত হাজার ৮০০ কেজি।বছরের ব্যবধানে হঠাৎ কোন জাদুতে হালদা নদীতে তিনগুণেরও বেশি ডিম মিলল— সে প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছে জাগো নিউজ। সেই খোঁজে অনেকটা কেঁচো খুঁড়তে সাপ দেখতে পাওয়ার মতোই চমকে দেয়া তথ্য আসে এ প্রতিবেদকের হাতে।
শুক্রবার হালদায় ডিম সংগ্রহে নেমেছিল কয়েকশ জেলে। সারি সারি নৌকায় ডিম সংগ্রহের নৈসর্গিক এ ছবি আবারও প্রমাণ করে হালদার শ্রেষ্ঠত্বশুক্রবার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের হালদা রিভার রিচার্স ইনস্টিটিউট, মৎস্য অধিফতর এবং ইন্টিগ্রেটেড ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন (আইডিএফ) যৌথভাবে হালদা থেকে প্রাপ্ত ডিমের যে পরিমাণ নির্ধারণ করেছে তার সঙ্গে বিস্তার ফাঁরাক মাঠের তথ্যের। ডিম আহরণকারী জেলেরাও বলছেন ভিন্ন কথা। আয়নাবাজির আয়নাতে যেমন সবকিছু উল্টো উল্টো দেখায় তেমনি এবার হালদার ডিমের পরিমাণ নির্ধারণে সোজা হিসাব উল্টে দিয়ে ঘটানো হয়েছে ‘রেকর্ডবাজি’!জেলা মৎস্য কর্মকর্তার প্রেস বিজ্ঞপ্তি থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, শুক্রবার হালদা নদীতে ৬১৬ জন সংগ্রহকারী ২৮০টি নৌকা নিয়ে এ ডিম সংগ্রহ করেন। ডিমের পরিমাণ ২৫ হাজার ৫৩৬ কেজি। অংকের হিসাবে এ লক্ষ্য অর্জনে প্রতিটি নৌকাকে গড়ে সংগ্রহ করতে হয়েছে ৯১ দশমিক ২ শতাংশ কেজি ডিম।
অথচ মাঠ থেকে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে এবং জেলেদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শুক্রবার হালদায় ডিম সংগ্রহকারী জেলেরা গড়ে ৫ থেকে ৬ বালতির (এক বালতি = ১০ কেজি ডিম) বেশি ডিম সংগ্রহ করতে পারেননি পুরোদিনে। এ অবস্থায় বিকেল ৩টার মধ্যেই জেলা মৎস্য কর্মকর্তার ১৪ বছরের রেকর্ড ভাঙা ২৫ হাজার ৫৩৬ কেজি ডিমের হিসাব মিলছে না কোনোভাবেই।শুক্রবার হালদায় ডিম সংগ্রহে নেমেছিল কয়েকশ জেলে। সারি সারি নৌকায় ডিম সংগ্রহের নৈসর্গিক এ ছবি আবারও প্রমাণ করেছে হালদার শ্রেষ্ঠত্ব
শুক্রবার হালদা নদীতে ডিম সংগ্রহ করেছেন এমন ১৪০টি নৌকার ডিম সংগ্রহের তথ্য এসেছে হাতে।এর মধ্যে হাটহাজারী এলাকার শাহ মাদারি হ্যাচারি, মাছুয়া ঘোনা হ্যাচারি ও মদুনাঘাট প্রাকৃতিক রেনু উৎপাদন কেন্দ্রের ৬৬ জন জেলে তাদের সহযোগীদের নিয়ে ১৪০টি নৌকায় দিনভর ডিম সংগ্রহ করেছেন। তাদের দেয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ওই ১৪০টি নৌকা মোট সংগ্রহ করেছে পাঁচ হাজার ২২০ কেজি ডিম।স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, জেলা মৎস্য বিভাগের দেয়া ২৮০টি নৌকার অর্ধেক অর্থাৎ ১৪০টি নৌকা যদি সারাদিনে পাঁচ হাজার ২২০ কেজি ডিম সংগ্রহ করে, বাকি ১৪০টি নৌকা ২০ হাজার ৩১৬ কেজি ডিম সংগ্রহ করেছে— এমন তথ্য অনেকটাই শুভঙ্করের ফাঁকি।পুরো বিষয়টি নিখুঁতভাবে জানার জন্য একমাত্র হ্যাচারি থেকে পাওয়া তথ্যের ওপর নির্ভর করতে চায়নি । সরাসরি কথা বলেছে ডিম সংগ্রহকারী জেলে এবং শুক্রবার সরেজমিন হালদায় পরিদর্শন করা বেশ কয়েকজন সংবাদকর্মীর সঙ্গেও।
শুক্রবার হালদায় ডিম সংগ্রহে নেমেছিল কয়েকশ জেলে। সারি সারি নৌকায় ডিম সংগ্রহের নৈসর্গিক এ ছবি আবারও প্রমাণ করেছে হালদার শ্রেষ্ঠত্বহাটহাজারী উপজেলার গড়দুয়ারা এলাকার বাবুল জলদাশ হালদায় ডিম সংগ্রহ করছেন গত ৪০ বছর ধরে। তিনি জানান, শুক্রবার মোটামুটি উল্লেখ করার মতো ডিম সংগ্রহ করেছেন তিনি। তবে মোট হিসাবে যা বলা হচ্ছে তা কোনোভাবেই সম্ভব নয়।তিনি বলেন, আমি পাঁচটি নৌকায় ১০ জন লোক খাটিয়ে সারাদিনে ২০ বালতি ডিম সংগ্রহ করেছি। আমার দেখা এটাই সর্বোচ্চ। আজিমের ঘাট থেকে পোড়াকোয়াইল্লা এলাকা পর্যন্ত প্রচুর ডিম পাওয়া গেছে।তবে উত্তর মাদার্শা এলাকার জেলে সাহাবউদ্দিন বলেন, ‘তিনটি নৌকায় সাতজনের পরিশ্রমে মোট আট বালতি অর্থাৎ ৮০ কেজি ডিম সংগ্রহ করেছেন।’ এ সময় তিনি চ্যালেঞ্চ ছুড়ে দিয়ে বলেন, ‘কেউ যদি বলেন, তিনি ২০ বালতি ডিম পেয়েছেন, আমি তাঁকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ করব। এটা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। কারণ ওইদিন চলে গেছে আরও ৪০ বছর আগে, আমাদের বাপ-দাদার সময়।’
শুক্রবার হালদায় ডিম সংগ্রহে নেমেছিল কয়েকশ জেলে। সারি সারি নৌকায় ডিম সংগ্রহের নৈসর্গিক এ ছবি আবারও প্রমাণ করেছে হালদার শ্রেষ্ঠত্বআঙ্কুরিঘোনার জেলে সিরাজ উদ্দিন বলেন, ‘তিনি দুই নৌকা ব্যবহার করে পাঁচ বালতি অর্থাৎ ৫০ কেজি ডিম সংগ্রহ করতে পেরেছেন।’
শাহ মাদারী হ্যাচারিতে ডিম দিয়েছেন রামদাশহাটের ইলিয়াস। এবার রেকর্ড ডিমপ্রাপ্তির বিষয়ে জানতে চাইলে বলেন, ‘সত্যটা বললে অনেকে নারাজ হবেন। এসব কথা কীভাবে বলি? সত্য বলার লোক কোথায়? আমি দুটি নৌকা নিয়ে ৬০ কেজির মতো ডিম সংগ্রহ করতে পেরেছি। এছাড়া আমাদের হ্যাচারির ৪০টি নৌকায় ৮০ জন মানুষ সারাদিন পরিশ্রম করে ১২০০ কেজির কাছাকাছি (প্রকৃত সংখ্যায় ১১৩০ কেজি) ডিম সংগ্রহ করেছেন।তবে জেলেদের এসব পরিসংখ্যান মানতে রাজি নন জেলা মৎস্য কর্মকর্তা ফারহানা লাভলী। তার দাবি, মোট হিসাবে ডিম সংগ্রহের সংখ্যা আরও বেশি হবে। কারণ নদীতে মাছ সংগ্রহকারী ২৮০ নৌকার হিসাব দেয়া হলেও প্রকৃতপক্ষে নৌকার উপস্থিতি ছিল ৩০০-এর বেশি। যদিও জেলা মৎস্য বিভাগ নিজেদের পরিসংখ্যানে অন্তর্ভুক্ত করেছেন মাত্র ৬০টি নৌকার।
হালদাপাড়ের সরকারি হ্যাচারিগুলোতে কার্প জাতীয় মাছের ডিম ফুটিয়ে রেনু উৎপাদনের কর্মযজ্ঞ চলছেফারহানা লাভলী বলেন, আমরা সকাল থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত যৌথভাবে তিনটি দলে ভাগ হয়ে তথ্য সংগ্রহ করেছি। এর মধ্যে জেলা মৎস্য অফিস ৬০টি নৌকা থেকে তথ্য সংগ্রহ করেছে। অনেকের কাছে বারবার জিজ্ঞাসা করা হয়েছে, অনেক জেলে এ সময় বিরক্ত হন। পাওয়া তথ্য থেকে আমরা কম-ই বলেছি।জেলেদের দেয়া তথ্য এ সময় জেলা মৎস্য কর্মকর্তার কাছে তুলে ধরলে তিনি বলেন, ‘আপনি কি প্রমাণ করতে পারবেন?’শুক্রবার হালদা নদীতে ডিম সংগ্রহের বিষয়ে সংবাদ সংগ্রহের জন্য সকাল ৭টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত নদীর বিভিন্ন পয়েন্টে ঘুরে বেড়িয়েছেন বেসরকারি টেলিভিশন সময় টিভির স্টাফ রিপোর্টার পার্থ প্রতিম বিশ্বাস। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা সংবাদ সংগ্রহের জন্য একেবারে সকাল থেকেই হালদায় অবস্থান করছিলাম। বেলা ১২টা পর্যন্ত নদীতে ডিম পাওয়ার পরিমাণ ছিল কম। দুপুরের দিকে পরিমাণ বাড়তে থাকে। সে সময় জেলেরা ভালোই ডিম পান। তবে বিকেলে ডিম সংগ্রহের যে হিসাব দেয়া হলো সেটা কেমন যেন মেলে না। এ হিসাবটা বড়জোর ১৫ হাজার কেজি হতে পারে। এছাড়া তাদের তথ্য সংগ্রহের পদ্ধতি ছিল পুরোটাই মৌখিক। কোনো নৌকার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় জিজ্ঞাসা করা হচ্ছিল কত বালতি? জবাবে কেউ পাঁচ আবার কেউ সাত বালতি বলছিল।সাংবাদিক পার্থ প্রতিমের দেয়া তথ্যের আরও জোরালো ইঙ্গিত পাওয়া যায় হালদা গবেষক অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী আজাদীর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে দেয়া এক স্ট্যাটাস থেকে। শুক্রবার (২২ মে) দুপুর ১টা ২২ মিনিটে দেয়া সেই স্ট্যাটাসে তিনি লেখেন, ‘বহু প্রতীক্ষার পর ২১ মে ২০২০ দিবাগত রাত ২টার দিকে আজিমের ঘাট এলাকায় মা মাছ হালদায় ডিম ছেড়েছে। সকাল ৯টা পর্যন্ত ডিম সংগ্রহকারীরা নমুনার চেয়ে কিছু বেশি পরিমাণ ডিম ধরতে সক্ষম হয়েছে বলে জানা গেছে। ভাটার শেষে জোয়ার শুরু হয়, মাঝ জোয়ারেও ডিম সংগ্রহ হয়। ২৫০-৩০০ মতো নৌকা ডিম সংগ্রহে থাকলেও সব এলাকার সব নৌকা ভালো পরিমাণে ডিম পায়নি। তবে এখনও সময় আছে। বেলা শেষে বোঝা যাবে ডিমের প্রাপ্তির পরিমাণ।’
হালদাপাড়ের সরকারি হ্যাচারিগুলোতে কার্প জাতীয় মাছের ডিম ফুটিয়ে রেনু উৎপাদনের কর্মযজ্ঞ চলছেবিষয়টি সামনে এনে নিজেদের দেয়া তথ্যের ব্যাপারে জানতে চাইলে তথ্য সংগ্রহকারীর দলের সঙ্গে থাকা ইন্টিগ্রেটেড ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের (আইডিএফ) কর্মকর্তা রাশেদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘আসলে কী বলব, বুঝতে পারছি না। আইডিএফ ৮০টি নৌকা থেকে তথ্য সংগ্রহ করে। আমাদের তথ্যের সঙ্গে হালদা রিভার রিচার্স ইনস্টিটিউট ও মৎস্য অধিদফতরের তথ্য মিলে যাওয়ায় আমরা সম্মিলিতভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে ওই তথ্য দিয়েছি।তবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরির সমন্বয়ক ড. মনজুরুল কিবরিয়ার দাবি, তার নিজস্ব উদ্ভাবিত ম্যাথডলজি’ ১৪ বছরের মধ্যে এবার সর্বোচ্চ ২৫ হাজার ৫৩৬ কেজি ডিম সংগ্রহের বিষয়টিকে সমর্থন করে। তারা এ সংক্রান্ত তথ্য জেলেদের সঙ্গে কথা বলেই সংগ্রহ করেছেন। এ সংক্রান্ত সকল ডাটা তার কাছে সংরক্ষিত রয়েছে।
উল্লেখ্য, মাত্র দুই বছর আগেও মৎস্য বিভাগের তথ্যের সঙ্গে হালদায় ডিম সংগ্রহ নিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অধ্যাপকের ব্যাপক মতপার্থক্য দেখা যেত। বিভিন্ন সভা ও সেমিনারে এ নিয়ে বিস্তর আলোচনা-সমালোচনাও হতো নিয়ম মাফিক।