এমপিওতে আরও ৪ শতাংশ চাঁদা আরোপ বেসরকারি শিক্ষকদের
আলোকিত বার্তা:বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের এমপিও (বেতন) থেকে মাসে বাড়তি ৪ শতাংশ হারে অর্থ কেটে নেয়ার স্থগিত সিদ্ধান্ত প্রায় ২ বছর পর পুনরায় কার্যকর করা হয়েছে। সোমবার শিক্ষা মন্ত্রণালয় এ সংক্রান্ত আদেশ জারি করে।ফলে চলতি মাস থেকে বেতনের মোট ১০ শতাংশ অর্থ কেটে রাখা হবে। এই অর্থ চলে যাবে বেসরকারি শিক্ষক ও কর্মচারী অবসর সুবিধা বোর্ড এবং কল্যাণ ট্রাস্টের তহবিলে। ওই দুই সংস্থা অবসরে যাওয়া এ ধরনের শিক্ষক ও কর্মচারীদের অবসর ও কল্যাণ সুবিধা দিয়ে থাকে। এই সিদ্ধান্তে শিক্ষকদের একটি অংশ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অসন্তোষ প্রকাশ করে স্ট্যাটাস দিচ্ছেন। এছাড়া বিভিন্ন শিক্ষক ও কর্মচারী সংগঠন আলাদা বিবৃতিতে অতিরিক্ত হারে বেতন কাটার সিদ্ধান্ত বাতিল দাবি করেছেন। দাবি মেনে না নিলে ২ মে থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে লাগাতার ধর্মঘট পালনেরও হুমকি দিয়েছে দুটি সংগঠন।তবে বেসরকারি শিক্ষক ও কর্মচারী কল্যাণ ট্রাস্টের সদস্য সচিব অধ্যক্ষ শাহজাহান আলম সাজু আলোকিত বার্তাকে বলেন, চলতি মাসের এমপিও আগামী মাসে যখন পরিশোধ করা হবে তখন বর্ধিত অর্থ কাটার সিদ্ধান্ত কার্যকর করা হবে। শিক্ষকদের প্রতি মাসে ৫ শতাংশ বাড়তি বেতন দিয়ে ৪ শতাংশ কেটে রাখা হচ্ছে। এ প্রক্রিয়ায় অবসর ও কল্যাণ খাতে বাড়তি অর্থ দেয়ার ব্যাপারে শিক্ষকদের সায় আছে বলে তারা আগেই আমাদের জানিয়েছেন।
বর্তমানে বেসরকারি শিক্ষক ও কর্মচারীদের এমপিও থেকে মাসে অবসর বোর্ডের চাঁদা হিসেবে ৪ শতাংশ এবং কল্যাণ ট্রাস্টের চাঁদা বাবদ ২ শতাংশ টাকা কেটে রাখা হয়। নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী অবসর বোর্ডের অনুকূলে ৬ শতাংশ এবং কল্যাণ ট্রাস্টের জন্য ৪ শতাংশ কাটা হবে। বর্তমানে ২ শতাংশ হারে কল্যাণ তহবিলের জন্য মাসে ১৭ কোটির বেশি টাকা চাঁদা আদায় হয়। ৪ শতাংশ হারে এই অঙ্ক দাঁড়াবে প্রায় ৩৫ কোটি। অপরদিকে অবসর খাতে প্রতি মাসে প্রায় ৩৫ কোটি টাকা চাঁদা কেটে রাখা হয়। ৬ শতাংশ হারে এটি দাঁড়াবে প্রায় ৫২ কোটি। সেই হিসাবে দুই খাতে মাসে ৮৭ কোটি টাকা আদায় হবে। বছরে এর পরিমাণ দাঁড়ায় ৪২০ কোটি টাকা।শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা আলোকিত বার্তাকে জানান, শিক্ষক ও কর্মচারীদের অবসর সুবিধা বোর্ড এবং কল্যাণ ট্রাস্টের সুবিধার জন্য হাজার হাজার আবেদন পেন্ডিং আছে। ওইসব আবেদন নিষ্পত্তির জন্য সরকার বিশেষ বরাদ্দ দিয়েছে। কিন্তু তারপরও অনেকেই সুবিধা বিলম্বে পাচ্ছেন। এমন পরিস্থিতিতে দাবি দ্রুত নিষ্পত্তি এবং অর্থ বিভাগের শর্ত অনুযায়ী বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষক ও কর্মচারীদের এমপিও থেকে বাড়তি হারে চাঁদা নেয়ার সিদ্ধান্ত কার্যকর করা হয়েছে।
এর আগে ২০১৭ সালের ১৫ জুন একইভাবে বর্ধিত হারে চাঁদা কাটার ব্যাপারে শিক্ষা মন্ত্রণালয় নির্দেশনা জারি করেছিল। তখন সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে প্রায় ৫ লাখ শিক্ষক-কর্মচারীর মধ্যে ব্যাপক অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়েছে। বিভিন্ন শিক্ষক ও কর্মচারী সংগঠন সংবাদ সম্মেলনসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে। তাদের যুক্তি ছিল, একজন শিক্ষক যদি ২২ হাজার টাকা স্কেলে চাকরি শুরু করেন এবং ৩০ বছর চাকরি করেন তাহলে তার কাছ থেকে ১০ শতাংশ হারে অবসর সুবিধা ও কল্যাণ ট্রাস্ট বাবদ ৩০ বছরে কাটা হবে ২২০০দ্ধ১২দ্ধ৩০=৭,৯২,০০০ টাকা। অথচ ওই শিক্ষক যদি তার চাকরির শুরুতে ২২শ’ টাকার একটি ১০ বছর মেয়াদি ডিপিএস হিসাব খুলতেন, তাহলে তিনি জমা দিতেন ২,৬৪,০০০ টাকা। মেয়াদ শেষে যা বেড়ে হতো ৫ লাখ টাকা। এই ৫ লাখ টাকা ফিক্সড ডিপোজিট করলে পরবর্তী ৭ বছরে ১০ লাখ, ১৪ বছরে ২০ লাখ, ২১ বছরে ৪০ লাখ টাকা হতো। অপরদিকে একজন শিক্ষক ২৫ বছর চাকরি করলে সর্বশেষ স্কেলের ১০০ মাসের (অবসরে ৭৫ ও কল্যাণে ২৫) বেতনের সমপরিমাণ অর্থ অবসর সুবিধা ও কল্যাণ তহবিল বাবদ পাবেন। তাহলে একজন শিক্ষক ১০ শতাংশ হারে ৩০ বছরে ৭,৯২,০০০ টাকা চাঁদা দিয়ে অবসর নেয়ার পরে ২-৩ বছর অপেক্ষা করে পাবেন ২২,০০০x১০০=২২ লাখ টাকা (কারণ, বেসরকারি শিক্ষকদের কোনো ইনক্রিমেন্ট, টাইমস্কেল ও পদোন্নতি না থাকায় আজীবন একই স্কেলে চাকরি করতে হবে)। তাহলে বেসরকারি শিক্ষকদের অবসর সুবিধা ও কল্যাণ ট্রাস্টে চাঁদা দিয়ে লাভ কি? এমন নানা যুক্তি আর ক্ষোভের কারণে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে অর্থ কেটে নেয়া স্থগিত করা হয়েছিল। শুধু তাই নয়, পরে ওই নির্দেশনা স্থগিত করা হয়।
কল্যাণ ট্রাস্টের সদস্য সচিব ও শিক্ষক নেতা অধ্যক্ষ শাহজাহান আলম সাজু বলেন, শিক্ষকদের বছরে ৫ শতাংশ বাড়তি বেতন দিয়ে ৪ শতাংশ কেটে রাখা হবে। শিক্ষকরা যখন ১০ শতাংশ হারে চাঁদা কেটে নেয়ার দাবি তুলেছিল, তখন তাদের বক্তব্য ছিল- বৈশাখী ভাতা আর বার্ষিক ৫ শতাংশ ইনক্রিমেন্ট দিয়ে বর্ধিত ৪ শতাংশ কেটে নিলে অসুবিধা নেই। এরপর এ দুটি সুবিধাই কার্যকর হয়েছে। অপরদিকে এখন বছরে ৫ শতাংশ হারে যে ইনক্রিমেন্ট যোগ হবে, তাতে চাকরিজীবন শেষে একজন শিক্ষক বা কর্মচারীর অনেক বড় অঙ্কের বেতন দাঁড়াবে। সেটার তুলনায় শিক্ষকরা মোটা অঙ্কের আর্থিক সুবিধা পাবেন। তিনি মনে করেন, যেহেতু ৪ শতাংশ কেটে রাখার শর্তে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে শিক্ষকদের অন্যান্য সুবিধা আনা হয়েছে, তাই এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন যৌক্তিক। এ ব্যাপারে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে সাধারণ শিক্ষক ও কর্মচারীদের সহায়তা কর্তব্য।
শিক্ষকদের ক্ষোভ:বেসরকারি স্কুল-কলেজের শিক্ষক-কর্মচারীদের অবসর সুবিধা ও কল্যাণ তহবিলে অতিরিক্ত ৪ শতাংশ কর্তনের সরকারি আদেশ ৩০ এপ্রিলের মধ্যে বাতিলের আলটিমেটাম দিয়েছে হাইস্কুলে বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি (নজরুল) ও এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ লিয়াজোঁ ফোরাম। বাতিল না হলে ২ মে থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে লাগাতার ধর্মঘট পালন করবে তারা। বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির সভাপতি মো. নজরুল ইসলাম রনি এ তথ্য জানান। তিনি বলেন, উভয় সংগঠনের যৌথ সভায় এই সিদ্ধান্ত হয়েছে।
এছাড়া অবসর সুবিধা বোর্ড ও কল্যাণ ট্রাস্টের তহবিলে বাড়তি ৪ শতাংশ চাঁদা কর্তনের আদেশের প্রতিবাদ জানিয়েছে বাংলাদেশ কলেজ শিক্ষক সমিতি (বাকশিস), বাংলাদেশ অধ্যক্ষ পরিষদ (বিপিসি), বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি (আউয়াল-বিলকিস), বাংলাদেশ মাদ্রাসা জেনারেল টিচার্স অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি (বজলুর), বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি (জুলফিকার), বাংলাদেশ বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কর্মচারী জাতীয় পরিষদ। এসব সংগঠন এই ইস্যুতে পৃথকভাবে সভাও করে। অধ্যক্ষ পরিষদের সভাপতি অধ্যক্ষ মাজহারুল হান্নান বলেন, প্রকৃতপক্ষে শিক্ষকদের অবসর সুবিধা দেয়ার জন্য বেতন থেকে কোনো চাঁদাই কাটা উচিত না।