বিশ্ববিদ্যালয়ের সব বিভাগ এবং পুরনো বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন বিভাগে এ সংকট প্রকট।
আলোকিত বার্তা:দেশের বিভিন্ন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক সংকট রয়েছে। বিশেষ করে নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের সব বিভাগ এবং পুরনো বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন বিভাগে এ সংকট প্রকট।কিন্তু এরপরও বিভাগ খালি করে ছুটিতে যাচ্ছেন শিক্ষকরা। বর্তমানে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৬ শতাংশ শিক্ষক ছুটিতে রয়েছেন।উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো ভাড়া করা শিক্ষকই সম্বল হয়ে উঠছে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের। এক বছরে শিক্ষক ভাড়া করার হার ৬১ শতাংশ বেড়েছে। এসব কারণে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে একাডেমিক কার্যক্রম দারুণভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সর্বশেষ দুটি বার্ষিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নতুন-পুরনো সব ধরনের বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক সংকট রয়েছে। এর মধ্যে পুরনো বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু বিভাগে সংকট রয়েছে। এর কারণ হল- প্রয়োজনীয় সংখ্যক পদ সৃষ্টিতে বিলম্ব। আর ঢাকার বাইরে প্রতিষ্ঠিত নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক সংকটের মূল কারণ অবস্থানগত।
নতুন গ্র্যাজুয়েটদের চাকরি দরকার। এ কারণে যেখানেই বিশ্ববিদ্যালয় হোক না কেন, বিজ্ঞপ্তি দিলে প্রভাষক পাওয়া যায়। কিন্তু ওইসব বিশ্ববিদ্যালয়ে সিনিয়র শিক্ষকের সংকট বেশি। বিজ্ঞপ্তি দিয়েও অধ্যাপক ও সহযোগী অধ্যাপক পাওয়া যাচ্ছে না। এমন পরিস্থিতিতে জুনিয়র শিক্ষক দিয়ে পাঠদান চলছে।এ বিষয়ে জানতে চাইলে ইউজিসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. কাজী শহীদুল্লাহ বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণার স্বার্থেই শিক্ষকরা উচ্চশিক্ষার জন্য ছুটি নেন। উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে যাওয়া কেউ কেউ সময়মতো ফিরতে পারেন না। এজন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অধ্যাদেশে নির্দেশিত পন্থায় ব্যবস্থা নিয়ে থাকে।এছাড়া জাতীয় প্রয়োজনে লিয়েনসহ অন্য সব ছুটি শিক্ষকদের দেয়া হয়। এটাকে ইতিবাচক হিসেবে দেখা হয়। খণ্ডকালীন বা চুক্তিভিত্তিক নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকের সংখ্যাও বেড়েছে। এ ধরনের ছুটিতে আগেও শিক্ষকরা যেতেন। হয়তো অনেকে বিশ্ববিদ্যালয়কে অবহিত করতেন না। তবে বাস্তবতা হল- ঢাকার বাইরে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক সংকট রয়েছে। বিজ্ঞাপন দিয়েও অধ্যাপক বা সহযোগী অধ্যাপক পাওয়া যায় না। সিনিয়র শিক্ষকের পদ পূরণে পদক্ষেপ নেয়া হবে বলে জানান তিনি।
২৯ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতির কাছে ইউজিসির সর্বশেষ (২০১৮ সালের) বার্ষিক প্রতিবেদন পেশ করা হয়। প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ৩৭টি বিশ্ববিদ্যালয়ে ২ হাজার ২৯৮ শিক্ষক অন্তত চার ধরনের ছুটিতে ছিলেন। এসব শিক্ষকের মধ্যে ২১৩৩ জন শিক্ষা ছুটি নিয়েছেন।প্রেষণ বা লিয়েন নিয়ে অন্য প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছেন ৭০ জন, বিনা বেতনে ছুটিতে আছেন ৭০ জন, ছুটি শেষ হওয়ার পরও অননুমোদিতভাবে বিদেশে অবস্থান করছেন ২৫ জন। ইউজিসির তথ্য অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে সরকারের অর্থে পরিচালিত বিশ্ববিদ্যালয় আছে ৪৬টি। এছাড়া আরও পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।২০১৭ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী- ৩৭টি সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ের ২ হাজার ১০১ জন শিক্ষা ছুটিতে, প্রেষণ বা লিয়েনে ৮৪ জন, বিনা বেতনে ছুটিতে আছেন ৫৮ জন, অননুমোদিত ছুটিতে ১৭ জন ছিলেন।ইউজিসি সূত্র জানায়, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪১৪৫ জন খণ্ডকালীন অধ্যাপনা করছেন। তাদের মধ্যে ১৩১২ জন অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক ৬৪৪ জন, ৭৮৮ জন সহকারী অধ্যাপক এবং ১৪০১ জন প্রভাষক। এসব শিক্ষক কোনো না কোনো সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত। অভিযোগ আছে, তাদের বেশির ভাগ কোনোরকমে ক্লাস নিয়ে ক্যাম্পাসের বাইরে ছুটে যান। আবার কেউ কেউ সপ্তাহে এক-দু’দিন হাজিরা দেন নিজের কর্মস্থলে। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলাপে এসব জানা গেছে।বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, বর্তমানে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নেয়ার বিষয়টি সবচেয়ে রমরমা। সম্প্রতি ঢাকার বাইরে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠেছে। ওইসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকের চাহিদার একটি অংশও পূরণ করা হয় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।
এ ব্যাপারে সম্প্রতি আলাপকালে ইউজিসি চেয়ারম্যান বলেন, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেশিরভাগ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেয়। বিপরীত দিকে নিজেদের স্থায়ী শিক্ষকের প্যানেল ভারি করছে না। এতে একদিকে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কম-বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।আরেকদিকে সংশ্লিষ্ট বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। স্থায়ী শিক্ষক যে দরদ দিয়ে পড়ান এবং প্রতিষ্ঠানের উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি চাইবেন, সেটা ভাড়াটে শিক্ষক না-ও চাইতে পারেন। শিক্ষক ভাড়া করতে যে অর্থ ব্যয় হয়, সেই অর্থে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় স্থায়ী শিক্ষক নিয়োগ করতে পারে। এতে তাদের লাভ বেশি।
ভাড়া করা শিক্ষকও কম নয় : বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে ভাড়া করা শিক্ষকের ধারণা জনমনে থাকলেও গত কয়েক বছর ধরে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ও চলছে একই তত্ত্বে। ইউজিসির প্রতিবেদন অনুযায়ী, এক বছরেই ভাড়া করা শিক্ষক বেড়েছে ৬১ দশমিক ৩২ শতাংশ।২০১৭ সালে যেখানে ৬৮০ জন খণ্ডকালীন বা চুক্তিভিত্তিক শিক্ষক ছিল ৩৭ বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে পরের বছর এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০৯৭ জন। ভাড়া করা শিক্ষক দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার ক্ষেত্রে শুধু নতুন বিশ্ববদ্যালয়গুলোই নয়, পুরনো প্রতিষ্ঠানগুলোও একই সমস্যায় জর্জরিত।চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট শিক্ষক ১৩১১ জন। তাদের মধ্যে ৪৪০ জনই খণ্ডকালীন বা চুক্তিভিত্তিকসহ অন্যান্য ধরনের শিক্ষক। বাকিরা স্থায়ী শিক্ষক। কিন্তু তাদের মধ্যে আবার ১৫৬ জন আছেন শিক্ষা কার্যক্রমের বাইরে। কেউ শিক্ষা ছুটিতে আবার কেউ লিয়েন বা বিনা বেতনের ছুটিতে।
বেশি সংকট নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ে : গত বছর শিক্ষা কার্যক্রম চালু হওয়া খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঁচটি অনুষদে ২১০ জন শিক্ষার্থী আছে। কিন্তু নিজস্ব কোনো শিক্ষক নেই প্রতিষ্ঠানটিতে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মতোই ভাড়া করা শিক্ষক দিয়ে চলছে এ বিশ্ববিদ্যালয়টি।তবে সম্প্রতি ইউজিসি ৩৫টি শিক্ষক পদের অনুমোদন দিয়েছে। তাতে পাঁচটি সহকারী অধ্যাপক ও ৩০টি প্রভাষকের পদ আছে। সিনিয়র শিক্ষকের কোনো পদ অনুমোদন পায়নি। জামালপুরে অবস্থিত বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে গেল শিক্ষাবর্ষে (২০১৮-১৯) ক্লাস শুরু হয়েছে।
তখন ১৩৩ শিক্ষার্থী ভর্তি হয়। বর্তমান শিক্ষাবর্ষে ১৬৭ জন ভর্তি করা হয়েছে। তাদের জন্য আছেন ১২ জন প্রভাষক, তিন সহকারী অধ্যাপক। লেখাপড়ার মূল কাজটি চালিয়ে রাখতে ১১ জন অতিথি শিক্ষক নিতে হয়েছে। ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসিসহ শিক্ষক আছেন ১৬ জন।তাদের মধ্যে শুধু ভিসি এবং গণিত বিভাগে একজন অধ্যাপক আছেন। নেত্রকোনায় অবস্থিত শেখ হাসিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম গত বছর প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের একটি ভবনে শুরু হয়েছে। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন বিভাগে ২১০ শিক্ষার্থী আছে। তাদের জন্য নিয়োগ করা হয়েছে মাত্র ১০ জন প্রভাষক।২০১৮ সালে গোপালগঞ্জে অবস্থিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (বশেমুরবিপ্রবি) ৩৪টি বিভাগে ছাত্রছাত্রী বর্তমানে সাড়ে তিন হাজার। তাদের পড়াচ্ছেন ২৫৮ শিক্ষক। তাদের মধ্যে অধ্যাপক মাত্র একজন। অবশ্য বিশ্ববিদ্যালয়টিতে চুক্তিভিত্তিক অধ্যাপক আছেন চারজন।
কোনো সহকারী অধ্যাপক নেই। দু’জন সহযোগী অধ্যাপক, বাকিরা প্রভাষক। গাজীপুরের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ডিজিটাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ছয়জন স্থায়ী প্রভাষক, একজন সহকারী অধ্যাপক আছেন। এছাড়া অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছয়জন প্রবীণ শিক্ষকও যুক্ত আছেন।বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বমোট ১৮০ শিক্ষকের মধ্যে ৪১ জনই আছেন ছুটিতে। এতে অধ্যাপক ও সহযোগী অধ্যাপক আছেন মাত্র একজন করে। বাকিরা সহকারী অধ্যাপক ও প্রভাষক। রাঙ্গামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে চলছে ১৫ শিক্ষক দিয়ে। প্রতিষ্ঠানটিতে কোনো অধ্যাপক নেই।একমাত্র সহযোগী অধ্যাপক আবার ভাড়া করা। এছাড়া ১ জন সহকারী অধ্যাপক ও বাকিরা প্রভাষক। পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৫৩ জন শিক্ষকের মধ্যে কোনো অধ্যাপকই নেই। ১৫ জন সহযোগী অধ্যাপকসহ অন্য শিক্ষক নিয়ে চলছে প্রতিষ্ঠানটি। এভাবে নতুন প্রতিষ্ঠিত অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের চিত্রও প্রায় একই রকম বলে জানা গেছে।অর্থাৎ, অধ্যাপকের তীব্র সংকট। তবে কিছুটা ভালো অবস্থানে আছে অপেক্ষাকৃত পুরনো বিশ্ববিদ্যালয়। যেমন-২০০৭ সালে প্রতিষ্ঠিত যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ২১৬ শিক্ষকের মধ্যে ৫৩ জনই শিক্ষাছুটিতে আছেন। বাকিদের মধ্যে ১৬ জন অধ্যাপক, ২৬ জন সহযোগী ও ৩৯ জন সহকারী অধ্যাপক এবং ১৩৩ জন প্রভাষক। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থাও প্রায় এমনই। তবে সেখানেও পরিস্থিতি অনেকটা এমন যে, বিভাগপ্রতি গড়ে একজন অধ্যাপকও নেই। এমনকি কোনো কোনোটিতে অনুষদ প্রতিও একজন অধ্যাপক নেই।