এডিস মশার প্রজনন স্থান ধ্বংসে নেই কার্যকর উদ্যোগ - Alokitobarta
আজ : বৃহস্পতিবার, ২০শে নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ৫ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

এডিস মশার প্রজনন স্থান ধ্বংসে নেই কার্যকর উদ্যোগ


আলোকিত বার্তা:এডিস মশার প্রজনন স্থান ধ্বংসে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের এখন পর্যন্ত তেমন কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেই বলে অভিযোগ নগরবাসীসহ বিশেষজ্ঞদের। তাদের মতে, ঢিমেতালে চলছে ডেঙ্গুজ্বরের জীবাণুবাহক এডিস মশার প্রজনন স্থান ধ্বংসের যাবতীয় কার্যক্রম।এমনকি স্বাস্থ্য অধিদফতরের পক্ষ থেকে জরিপ পরিচালনা করে রাজধানীর দক্ষিণ ও উত্তর সিটি কর্পোরেশনকে মশার প্রজনন স্থান চিহ্নিত করে দিলেও সেসব স্থান পরিষ্কার রাখা হচ্ছে না।সঠিকভাবে এডিস নিধন কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে না বলে প্রতিদিনই বিপুলসংখ্যক নগরবাসী নতুন করে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছেন। আবার অনেকে মারাও যাচ্ছেন।এখনই এডিসের প্রজনন ক্ষেত্রে আঘাত হানতে না পারলে চলতি মৌসুমে ডেঙ্গু পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ রূপ ধারণ করতে পারে বলে আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের।স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার জরিপ অনুযায়ী, মহানগরীর গাবতলী বাস টার্মিনাল, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও মিরপুর-১২ নম্বর বিআরটিসি বাস ডিপোর ৬০-৮০ শতাংশ পাত্রে মশার লার্ভা পাওয়া গেছে।

আর মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল,কমলাপুর বিআরটিসি বাস ডিপো, কমলাপুর রেলওয়ে কলোনি, মহাখালী বাস টার্মিনাল ও শাহজাদপুর বস্তিতে যত্রতত্র ফেলে রাখা জমাট পাত্রের ৮০ শতাংশের মধ্যে লার্ভা মিলেছে।এ ছাড়া ওই জরিপে সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল, কড়াইল বস্তি, মেট্রোরেল প্রকল্প এলাকার উন্নয়ন স্পটের ২০-৬০ শতাংশ জমাট পানিতে মশার লার্ভা মিলেছে।সরেজমিন ঘুরে এবং সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, উল্লিখিত স্থানগুলোতে সঠিকভাবে মশক নিধন অভিযান পরিচালিত হচ্ছে না। আর কোথাও কোথাও এ অভিযান চললেও তা পর্যাপ্ত নয়।এমনকি সব এলাকায় নিয়মিতভাবে অভিযান চলছে না। মেট্রোরেল প্রকল্প এলাকা, কড়াইল বস্তি, শাহজাদপুর বস্তিতে এখনও মশক নিধনে পরিচ্ছন্নতা অভিযান বা ওষুধ ছিটাতে দেখা যায়নি।

আরও জানা গেছে, রাজধানীর বিভিন্ন থানার ড্যাম্পিং স্থানে প্রচুর মশা জন্ম নিচ্ছে। ঢাকার দুই মেয়রের পক্ষ থেকে ঢাকা মহানগর পুলিশ ড্যাম্পিং জোন পরিষ্কার করার আহ্বান জানালেও পুলিশের পক্ষ থেকে এখনও কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হয়নি।এ ব্যাপারে ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার কৃষ্ণপদ রায় যুগান্তরকে বলেন, এবার ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ার পর থেকে আমরা খুবই সচেতন থেকে প্রত্যেক থানা ও ডাম্পিং জোন নিয়মিতভাবে পরিষ্কার রাখার নির্দেশ দিয়েছি।

আর ডিএমপির পক্ষ থেকে সেসব কার্যক্রম তদারকিও করা হচ্ছে। রোববার উচ্চ আদালত এডিস মশা দমন বিষয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন হাইকোর্ট। আদালত বলেছেন, ডেঙ্গু দমনে সময়মতো পদক্ষেপ নিলে এমন পরিস্থিতি হতো না।ডেঙ্গু নিধনে মানসিকতা ও দক্ষতার অভাব রয়েছে। কাগজে-কলমে সবকিছুই ঠিক আছে, আদতে ডেঙ্গু নিধনে কিছুই পুরোপুরি ঠিক নেই। উচ্চ আদালত আরও বলেন, ডেঙ্গু মশার লার্ভা ও ডিম থাকে পানিতে।ওনারা সেটা পরিষ্কার না করে রাস্তায় ময়লা ফেলে পরিষ্কার করলেন। এসব নেহাতই হাস্যকর। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে করণীয় সম্পর্কে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ও কীটতত্ত্ব গবেষক ড. কবিরুল বাশার যুগান্তরকে বলেন, বিদ্যমান সময় ডেঙ্গুর সাইকেলের জন্য খুবই কঠিন সময়।এ পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলোকে আরও সক্রিয় হতে হবে। মশার প্রজনন স্থানগুলো ধ্বংস করতে হবে। মশার প্রজনন স্থান কার্যকরভাবে বিনাশ করা গেলে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা কমত। বিদ্যমান পরিস্থিতি দেখে তেমনটি মনে হচ্ছে না।

তিনি বলেন, সরকারি দফতরগুলোতে যাতে কোনোভাবে মশার প্রজনন না হতে পারে, এ ব্যাপারে সরকারি প্রজ্ঞাপন জারি করা যেতে পারে। কেননা, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে মশার প্রজননস্থল ধ্বংস করাই প্রধান কাজ।মশার প্রজনন স্থান কার্যকরভাবে ধ্বংস করতে না পারলে চলতি মৌসুমে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হতে পারে।কীটতত্ত্ববিদ ড. মঞ্জুর চৌধুরী বলেন, এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্তের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে না আসার একমাত্র কারণ মশার প্রজনন স্থান ঠিকঠাকভাবে পরিষ্কার করতে না পারা।তবে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম বলেছেন, আমরা এখন মশার প্রজনন স্থান ধ্বংসে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে কাজ করছি।স্বাস্থ্য অধিদফতরের জরিপ এবং আমাদের নিজস্ব জরিপে যেসব স্থানকে মশার প্রজনন স্থান মনে হচ্ছে, সেসব স্থানে পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। ওষুধ ছিটানো হচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, আপনারা জেনে থাকবেন, আমরা ইতিমধ্যে বাসাবাড়ি, নির্মাণাধীন ভবন, বাস টার্মিনাল, বস্তি, উন্নয়ন প্রকল্পসহ সব জায়গায় পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম জোরদার করেছি। আর কাল (আজ) থেকে মাসব্যাপী মশক নিধনে চিরুনি অভিযান পরিচালনা করা হবে। এ অভিযানে প্রত্যেক ওয়ার্ডের সব জায়গায় মশক নিধন, পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম ও ওষুধ ছিটানো হবে।এ বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ডিএসসিসি মশক নিধনে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এ উদ্যোগ বাস্তবায়নের মাধ্যমে মশার প্রজনন স্থানসহ উড়ন্ত মশা নিধন করা হচ্ছে।এ কর্মসূচির আওতায় আমরা হাসপাতাল, বাস টার্মিনাল, নির্মাণাধীন ভবন, বাসাবাড়ির ভেতর ও ছাদ পরিদর্শন করে মশার লার্ভা বা প্রজনন স্থান নষ্ট করা হচ্ছে। আগামী ৩১ আগস্ট পর্যন্ত আমাদের কার্যক্রম চলমান থাকবে।

এদিকে যুগান্তরের উত্তরা প্রতিনিধি জানান, এডিস মশার প্রকোপের মধ্যে উত্তরা মডেল টাউন এলাকায় সপ্তাহে এক বা দু’দিন মশার ওষুধ ছিটাতে দেখা গেছে। এতে তেমন কাজ হচ্ছে না।কেননা, উত্তরা লেক পাড় ও উত্তরা সংলগ্ন তুরাগ, উত্তরখান, দক্ষিণখান এলাকা থেকে দৈনিক প্রচুর মশা উত্তরায় চলে আসে। এ জন্য এ এলাকায় নিয়মিত মশক নিধন কার্যক্রম পরিচালনা করা জরুরি বলে মন্তব্য করেন এলাকাবাসী।তুরাগ প্রতিনিধি জানান, তুরাগ থানার আওতায় ডিএনসিসির ৫২, ৫৩ ও ৫৪ নম্বর ওয়ার্ড। এখন ডেঙ্গুর ভয়াবহ উপদ্রব চলছে। সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, তিনটি ফগার মেশিন দিয়ে প্রতিদিন সকাল-বিকাল তিন ওয়ার্ডে ফগিং করে মশক নিধন করা হচ্ছে।

কিন্তু, দিয়াবাড়ী, ধউর, বাউনিয়া ও কামারপাড়ার বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কোনো মশক নিধন কর্মীকে ফগিং বা স্প্রে করতে দেখেননি তারা।তুরাগের বাউনিয়া এলাকার বাসিন্দা মো. রুবেল আহমেদ বলেন, নির্বাচনের সময় কাউন্সিলর প্রার্থীরা বলেছিল নির্বাচনের পর থেকে এলাকায় মশক নিধনে স্প্রে করা হবে। এলাকা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা হবে।

কিন্তু নির্বাচনের পর থেকে এখন পর্যন্ত ওই এলাকায় মশক নিধনে কোনো কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে না।তিনি আরও বলেন, কিছুদিন আগে আমরা শুধু রাতের বেলায় মশার উপদ্রব লক্ষ করেছি। আর এখন বিকাল থেকেই মশা কামড়াচ্ছে। এলাকার মানুষ অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে, কিন্তু সিটি কর্পোরেশনের কাউন্সিলর ও কর্মকর্তারা শুধু আশ্বাসই দিয়ে যাচ্ছেন।উত্তর ও দক্ষিণখান প্রতিনিধি জানান, এডিস মশার এই প্রকোপের সময়ে সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে মশক নিধনে কোনো তৎপরতা চালানো হচ্ছে না। ইতিমধ্যে অনেক মানুষ ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়েছেন। কেউ সুস্থ হয়েছেন, অনেকে হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন।সম্প্রতি দক্ষিণখানের এক বাসিন্দা ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন।ডেমরা প্রতিনিধি জানান, সম্প্রতি ডেমরা, সারুলিয়া, বড়ভাঙ্গা, ডগাইর, বাঁশেরপুল ও কোনাপাড়া এলাকা ঘুরে ও স্থানীয় মানুষের সঙ্গে কথা বলে জেনেছেন, চলতি মৌসুমে ওইসব এলাকার অনেক মানুষ ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন।

কেউ হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা নিয়ে বাসায় ফিরেছেন এবং অনেকে এখনো হাসপাতালে ভর্তি।আরও জানান, ওইসব এলাকায় বেশ কয়েকটি মশার প্রজনন স্থান রয়েছে। এ ছাড়া প্রচুর মশা রয়েছে। রাত ও দিন উভয় সময়ই মশার উপদ্রবে অতিষ্ঠ থাকেন এলাকাবাসী।কিন্তু সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে মশার প্রজনন স্থান ধ্বংসে কোনো তৎপরতা লক্ষ করা যাচ্ছে না। সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে এলাকাবাসীকে বলা হচ্ছে, ওইসব এলাকার জন্য কোনো বরাদ্দ নেই।কিন্তু ওই এলাকার বাসিন্দাদের অভিযোগ, ভোট দিয়ে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত করেছেন তারা, তবে কেন সেবা পাবেন না?দনিয়া প্রতিনিধি জানান, মহানগীর শ্যামপুর, কদমতলী, রায়েরবাগ, দনিয়া ও শেখদি এলাকায় প্রচুর মশার প্রজনন স্থান রয়েছে। কিন্তু সিটি কর্পোরেশন এসব প্রজনন স্থান ধ্বংস করছে না।শুধু সরকার গঠিত কমিটির সদস্যরা বাসবাড়িতে ঘুরে ঘুরে মশার লার্ভা অনুসন্ধান করছেন। কিন্তু সেসব ধ্বংসে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করছে না।আরও জানান, চলতি মৌসুমে ওই এলাকায় শতাধিক মানুষ ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছে এবং এখন পর্যন্ত শুধু ৬১ নম্বর ওয়ার্ডে ৭ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন।এদিকে গত শনিবার স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের পরিচালক অধ্যাপক ডা. সানিয়া তাহমিনা নিয়মিত সংবাদ ব্রিফিংয়ে বলেছেন, ‘আবহাওয়া আমাদের অনুকূলে নয়। এডিস নির্মূলে যেসব কর্মসূচি জোরদার করা প্রয়োজন, সেগুলো যদি সঠিকভাবে করা সম্ভব না হয়, তাহলে পরিস্থিতি কী হবে বলা মুশকিল।

Top