টাকার প্রবাহ কম বাজারে,বিভিন্ন সময়ের নির্বাচনের সঙ্গে সূচকের মিল নেই
মোহাম্মাদ আবুবকর সিদ্দীক ভুঁইয়া : বিভিন্ন সময়ের জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকের সঙ্গে এবারের নির্বাচন উপলক্ষ্যে অনেক সূচকই মিলছে না। অন্যান্য সময়ে নির্বাচনকে সামনে রেখে বাজারে টাকার প্রবাহ বেড়ে যেত। এবার বাড়ছে খুবই সীমিত হারে। অতীতে নির্বাচনের আগে ব্যাংক থেকে নগদ টাকা বেরিয়ে মানুষের হাতে চলে আসত বেশি। এবার সেটি হচ্ছে না। উলটো মানুষের হাতে থাকা টাকা ব্যাংকে চলে যাচ্ছে।অবশ্য চড়া মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি ঠেকাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখন সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি অনুসরণ করছে। এ কারণেও টাকার প্রবাহ কমছে। তবে ২০০৮ সালের নির্বাচনের সময়ও মূল্যস্ফীতির হার নিয়ন্ত্রণে সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি ও অর্থনৈতিক সংকট থাকলেও টাকার প্রবাহ কমেনি। বরং বেড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন প্রতিবেদন থেকে পাওয়া তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে অর্থনীতির এমন চিত্র পাওয়া গেছে।সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, নির্বাচনের আগে সরকার যেমন প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে বাড়তি খরচ করে, তেমনি প্রার্থী, দল ও প্রার্থীর নিটকজন বা কর্মীরাও বাড়তি অর্থ খরচ করে। এ কারণে মুদ্রানীতি যাই হোক না কেন টাকার প্রবাহ বাড়বেই। কিন্তু এবার তা হচ্ছে না। ব্যাংক থেকে নগদ টাকা বাইরে আসার কথা। সেটিও হচ্ছে না। উলটো টাকা ব্যাংকে চলে যাচ্ছে বেশি। এবারের নির্বাচনটি অংশগ্রহণমূলক ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হচ্ছে না। যে কারণে অর্থনীতির সূচকগুলো অংশগ্রহণমূলক ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনের সঙ্গে মিলছে না। নির্বাচনে বেশিরভাগ প্রার্থীই কালোটাকা ব্যবহার করেন। যে কারণে ব্যাংকের লেনদেনে খুব বেশি প্রভাব পড়ে না।এবারের নির্বাচনে প্রার্থীরা সর্বোচ্চ ২৫ লাখ টাকা খরচ করতে পারবেন। প্রার্থীর এ অর্থ খরচ করতে যে কোনো ব্যাংকে একটি হিসাব খুলতে হবে। ওই হিসাবে টাকা জমা করে খরচ করতে হবে। নির্বাচনের পর ওই হিসাবের জমা ও খরচের বিবরণী নির্বাচন কমিশনে জমা দিতে হবে।
এ প্রসঙ্গে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, নির্বাচনে প্রার্থীরা ব্যাংক থেকে তুলে টাকা খরচ খুবই কম করেন। বেশিরভাগ অর্থই ব্যাংকবহির্ভূত খাত থেকে আসে। অর্থনীতিতে কালোটাকার মাত্রা বেশি থাকায় টাকার প্রবাহের সঠিক হিসাব বের করা কঠিন। তবে নির্বাচনের সময় স্বাভাবিকভাবেই টাকার প্রবাহ বাড়ে। অর্থনৈতিক মন্দা, ডলার সংকট ও সব দল অংশ না নেওয়াতে এবার টাকার প্রবাহের বৃদ্ধি কম হতে পারে।
সূত্র জানায়, ২০০৮ সালের নির্বাচন ছিল ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণমূলক ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ। এতে সব দলই অংশ নিয়েছিল। ওই নির্বাচনের সময় বাজারে টাকার প্রবাহ যেমন বেড়েছিল, তেমনি ব্যাংক থেকে মানুষের হাতে আসা টাকার পরিমাণও বেড়েছিল বেশ। ২০১৪ সালের নির্বাচন একতরফা হলেও ওই সময়ে টাকার প্রবাহ কিছুটা বেড়েছিল। একই সঙ্গে বেড়েছিল ব্যাংক থেকে মানুষের হাতে আসা টাকার পরিমাণ। ওই নির্বাচনে বিএনপিসহ সমমনা দলগুলো অংশ নেয়নি। ১৫১টি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় প্রার্থীরা নির্বাচিত হয়েছিলেন।
২০১৮ সালের নির্বাচনের শেষ মুহূর্তে প্রায় সব দল অংশ নিলেও নির্বাচনের আগের পরিবেশ অর্থনীতির জন্য অনুকূল ছিল না। তারপরও নির্বাচনের আগে টাকার প্রবাহ যেমন বেড়েছে, তেমনি ব্যাংক থেকে মানুষের হাতে আসা টাকার পরিমাণও বেড়েছে।এবারের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে ৭ জানুয়ারি। গত ২ বছর ধরে চলা অর্থনৈতিক মন্দা ও চড়া মূল্যস্ফীতির হার নিয়ন্ত্রণ করতে গত অর্থবছর থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি অনুসরণ করছে। এ কারণে গত অর্থবছরে টাকার প্রবাহ না কমলেও এবার কমতে শুরু করেছে। আগের সংকোচনমুখী মুদ্রানীতির সময়ও টাকার প্রবাহ কমার নজির খুব কম। সব জাতীয় নির্বাচনের সময়ই টাকার প্রবাহ বাড়ে। এবার তেমনটি হচ্ছে না। এর কারণ হিসাবে বিশ্লেষকরা মনে করেন, নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা পূর্ণ না হওয়ায় এমনটি হচ্ছে। এর সঙ্গে অর্থনৈতিক মন্দার বিষয়টিও রয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, নির্বাচনের আগে আগস্টের তুলনায় সেপ্টেম্বরে টাকার প্রবাহ বাড়েনি বললেই চলে। আগস্টে বাজারে টাকার প্রবাহের স্থিতি ছিল ১৮ লাখ ৭৭ হাজার কোটি টাকার কিছুটা কম। সেপ্টেম্বরে তা খুব সামান্য বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৮ লাখ ৭৭ হাজার কোটি টাকা। বৃদ্ধির হার প্রায় শূন্য। তবে সেপ্টেম্বরের তুলনায় অক্টোবরে বেড়েছে মাত্র শূন্য দশমিক ২৭ শতাংশ। অর্থাৎ ৫ হাজার কোটি টাকা বেড়ে অক্টোবরে টাকার প্রবাহের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১৮ লাখ ৮২ হাজার কোটি টাকায়। একই সময়ে ব্যাংক থেকে মানুষের হাতে যাওয়া টাকার পরিমাণ কমেছে। অর্থাৎ গ্রাহকদের কাছ থেকে টাকা ব্যাংকে এসেছে বেশি। আগস্টের তুলনায় সেপ্টেম্বরে ব্যাংকবহির্ভূত মুদ্রা কমেছিল ১ দশমিক ৫৫ শতাংশ। অক্টোবরে তা আরও কমেছে ৩ দশমিক ১৫ শতাংশ। অর্থাৎ সেপ্টেম্বরে ব্যাংকবহির্ভূত মুদ্রা ছিল ২ লাখ ৫৪ কোটি টাকা। অক্টোবরে তা কমে দাঁড়ায় ২ লাখ ৪৬ হাজার কোটি টাকায়। নভেম্বর ও ডিসেম্বরের তথ্য এখনো পাওয়া যায়নি।
এবারের নির্বাচনে বিএনপিসহ সমমনা দলগুলো অংশ নিচ্ছে না। যে কারণে নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতা পূর্ণ হচ্ছে না। এতে প্রার্থীদের অনেকেই স্বস্তিতে রয়েছেন। কিছু আসনে স্বতন্ত্রের কারণে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হলেও সেই সংখ্যা খুব কম। যে কারণে সার্বিক মুদ্রা ব্যবস্থাপনায় এর কোনো প্রভাব নেই।২০১৮ সালের নির্বাচন হয়েছিল ৩০ ডিসেম্বর। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, ওই নির্বাচনের সময় শুধু আগস্টের তুলনায় সেপ্টেম্বরে টাকার প্রবাহ দশমিক ৪৪ শতাংশ কমেছিল। সেপ্টেম্বরের তুলনায় অক্টোবরে বেড়েছিল দশমিক ৬৩ শতাংশ। অর্থাৎ ১১ লাখ ১৯ হাজার কোটি থেকে বেড়ে টাকা সরবরাহের স্থিতি দাঁড়ায় ১১ লাখ ২৬ হাজার কোটিতে। একইভাবে নভেম্বরে এর প্রবাহ বেড়েছিল দশমিক ৫৩ শতাংশ। ওই সময়ে স্থিতি বেড়ে দাঁড়ায় ১১ লাখ ৩২ হাজার কোটি টাকায়। নভেম্বরের তুলনায় ডিসেম্বরে বেড়েছিল ২ দশমিক ০৩ শতাংশ। ওই সময় স্থিতি বেড়ে দাঁড়ায় ১১ লাখ ৫৫ হাজার কোটি টাকায়। নির্বাচনের পর জানুয়ারিতে টাকার প্রবাহ বাড়েনি, ডিসেম্বরের তুলনায় অপরিবর্তিত ছিল। জানুয়ারির তুলনায় ফেব্রুয়ারি থেকে আবার বেড়েছিল। একইভাবে সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকবহির্ভূত মুদ্রা সামান্য হারে কমেছিল। কিন্তু ডিসেম্বরে এসে তা ব্যাপকভাবে বেড়ে দাঁড়ায় ১ লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকায়। নভেম্বরের তুলনায় বেড়েছিল ৪ দশমিক ৩২ শতাংশ। নভেম্বরে তা ছিল ১ লাখ ৩৯ হাজার কোটি টাকা। নির্বাচনের পর জানুয়ারিতে মানুষের হাতে থাকা টাকার পরিমাণ অপরিবর্তিত ছিল। ফেব্রুয়ারি থেকে আবার বেড়েছে।
২০১৪ সালের নির্বাচন হয়েছিল ৫ জানুয়ারি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, ওই সময়ে নির্বাচনের আগে আগস্টের তুলনায় সেপ্টেম্বরে টাকার প্রবাহ বেড়েছিল ১ দশমিক ১৩ শতাংশ। ওই মাসে স্থিতি ছিল ৬ লাখ ২৭ হাজার টাকা। অক্টোবরে বেড়েছে ২ দশমিক ০৭ শতাংশ। স্থিতি ছিল ৬ লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকা। নভেম্বরে স্থিতি ছিল ৬ লাখ ৪৩ হাজার কোটি টাকা। বৃদ্ধির হার ছিল দশমিক ৪৭ শতাংশ। ডিসেম্বরে তা আরও বেড়ে স্থিতি দাঁড়ায় ৬ লাখ ৫৪ হাজার কোটি টাকায়। বৃদ্ধির হার ছিল ১ দশমিক ৭১ শতাংশ। জানুয়ারিতে টাকার প্রবাহ আর বাড়েনি। অপরিবর্তিত ছিল। ফেব্রুয়ারিতে কমেছিল। ওই সময়ে ব্যাংক থেকে টাকা বের হওয়ার প্রবণতা কমা ও বাড়ার মধ্যে ছিল। তবে গড়ে বেড়েছে। আগস্টের তুলনায় সেপ্টেম্বরে কমেছিল ৩ দশমিক ২৩ শতাংশ। স্থিতি ছিল ৬৯ হাজার ১৫৭ কোটি টাকা। অক্টোবরে স্থিতি বেড়ে দাঁড়ায় ৭৫ হাজার ৪৪১ কোটি টাকায়। বৃদ্ধির হার ছিল ৯ দশমিক ০৯ শতাংশ। নভেম্বরে এর প্রবাহ আবার ৪ দশমিক ৭৪ শতাংশ কমে যায়। ফলে স্থিতি কমে দাঁড়ায় ৭১ হাজার ৮৬৭ কোটি টাকায়। ডিসেম্বরে আবার ব্যাংকবহির্ভূত মুদ্রা বেড়ে যায় ১ দশমিক ৪২ শতাংশ। ওই সময়ে স্থিতি ছিল ৭২ হাজার ৮৮৪ কোটি টাকায়। জানুয়ারিতে তা ছিল অপরিবর্তিত। ফেব্রুয়ারি থেকে আবার বেড়েছে।
সর্বশেষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে সব দলের অংশগ্রহণে ২০০৮ সালের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল ২৯ ডিসেম্বর। ওই সময়েও বৈশ্বিক মন্দার ধাক্কায় আক্রান্ত হয়েছিল দেশের অর্থনীতি। মূল্যস্ফীতির হারও ছিল ঊর্ধ্বমুখী। এ হার নিয়ন্ত্রণে তখনও সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি অনুসরণ করা হয়েছে। চালসহ নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছিল হু হু করে। দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভেও সংকট কিছুটা ছিল। তবে এবারের মতো এত বেশি রিজার্ভ সংকট ছিল না। ওই সময়ে সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি ও রিজার্ভ সংকট দিয়েও টাকার প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়নি।কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা গেছে, ওই নির্বাচনের সময় টাকার প্রবাহ ও ব্যাংকবহির্ভূত মুদ্রা সরবরাহ বেড়েছিল বেশ। ওই বছরের সেপ্টেম্বরের তুলনায় ডিসেম্বরে টাকার প্রবাহ বেড়েছিল ১ দশমিক ৮৭ শতাংশ। একইভাবে ব্যাংকবহির্ভূত মুদ্রা বেড়েছিল ৪ দশমিক ০৩ শতাংশ।