তেল চুরি নির্বিঘ্ন করতে ,সিন্ডিকেটে বিআইডব্লিউটিসির ফেরি-জাহাজ
আলোকিত বার্তা:ফেরি বা জাহাজের গতিবেগ ও কোন পথে চলছে-তা মনিটরিং করার জন্য ভ্যাসেল ট্র্যাকিং সিস্টেম (ভিটিএস) পদ্ধতি স্থাপন করেছিল বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন করপোরেশন (বিআইডব্লিউটিসি)। উদ্দেশ্য ছিল- এ পদ্ধতিতে চলাচলের দূরত্ব পরিমাপ ও জাহাজের গতির নির্ণয় করে সেই অনুযায়ী তেল বরাদ্দ দেওয়া হবে। পাশাপাশি জাহাজের গতিবিধিও মনিটরিং করা হবে। বিআইডব্লিউটিসির ৩৫টি ফেরি ও সাতটি যাত্রীবাহী জাহাজে ঘটা করে এ প্রযুক্তির প্রয়োগ করা হয়। নানা অজুহাতে বর্তমানে পুরোপুরি অকার্যকর হয়ে আছে প্রযুক্তিটি। ফেরি ও জাহাজে তেল বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে। অভিযোগ রয়েছে, তেল চুরির পথ নির্বিঘ্ন করতেই এ পদ্ধতি কার্যকর করা হয়নি। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।
আরও জানা গেছে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে বিআইডব্লিউটিসির যাত্রীবাহী জাহাজ ও ফেরিতে ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে এক কোটি ৭৩ লাখ ২৯ হাজার ১৩৪ লিটার জ্বালানি তেল ও এক লাখ ৪২ হাজার ৯৫৬ লিটার লুব ওয়েল বরাদ্দ দেওয়া হয়। যার আর্থিক দাম প্রায় ১১১ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। ওই বছরে সংস্থাটির নৌযানগুলো দুই লাখ দুই হাজার ১৭৬টি ট্রিপ দেয়। এর আগের ২০১৮-১৯ সালে জ্বালানি তেল বরাদ্দ দেওয়া হয় এক কোটি ৮৯ লাখ ছয় হাজার ৩৭৮ লিটার ও লুব ওয়েল দেওয়া হয় এক লাখ ৬২ হাজার ১০৪ লিটার। যার আর্থিক মূল্য প্রায় ১২১ কোটি ছয় লাখ টাকা। ওই বছরে দুই লাখ ১৪ হাজার ৬৭৩টি ট্রিপ হয়। ২০২০-২১ অর্থবছরের হিসাব এখনো তৈরি করেনি সংস্থাটি।অভিযোগ রয়েছে, দূরত্ব, গতিবেগ ও স্রোত বিবেচনায় বিপুল পরিমাণ তেল বরাদ্দ দেওয়া হলেও সেই অনুযায়ী ফেরি ও জাহাজ চালানো হয় না। এভাবে বরাদ্দের তেল বাঁচিয়ে তা গোপনে বিক্রি করে দেন সংশ্লিষ্টরা। তেল চুরির টাকা সংস্থাটির বিভিন্ন পর্যায়ের কয়েক কর্মকর্তার পকেটে যায়। সর্বশেষ এ ঘটনার প্রমাণ মিলেছে বাংলাবাজার-শিমুলিয়া রুটে চলাচলকারী রো রো ফেরি শাহজালালের ক্ষেত্রে। নির্ধারিত গতির চেয়ে কম গতিতে এবং সংক্ষিপ্ত পথে চলতে গিয়ে ওই ফেরিটি পদ্মা সেতুর ১৭ নম্বর পিলারে আঘাত করে। যদিও স্রোত বৃদ্ধি ও পদ্মা সেতুর পিলার নিরাপদ রেখে নির্দিষ্ট দূরত্বের বাইরে চলাচলের জন্য সর্বশেষ গত ৪ জুলাই এ রুটের সবক’টি ফেরির তেল বরাদ্দ বাড়ানো হয়। তবে পদ্মা সেতুতে ফেরির ধাক্কা দেওয়ার ঘটনায় সমালোচনার মুখে ভিটিএস প্রযুক্তি আবার বসানোর উদ্যোগ নিয়েছে এ সংস্থাটি।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে বিআইডব্লিউটিসির চেয়ারম্যান সৈয়দ তাজুল ইসলাম বলেন, ভিটিএস প্রযুক্তি বসানো হয়েছিল। এটি পুরোপুরি কার্যকরভাবে কাজ করছে না। এখন আমরা সিরিয়াসলি এটা দেখছি। তেল চুরির বিষয়ে তিনি বলেন, বরাদ্দ দেওয়া তেল চুরির বিষয়ে অভিযোগ শুনে আসছি। এটা ধরা খুব কঠিন। ওয়ান ইলেভেনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় চেষ্টা করে ধরা যায়নি। তিনি মন্তব্য করেন, যেসব সংস্থার যানবাহন চলাচল করে সেসব সংস্থায় কমবেশি তেল চুরি হয়।নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয় ও বিআইডব্লিউটিসির একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম গোপন রাখার শর্তে বলেন, তেল চুরি করার বিষয়টি ‘ওপেন সিক্রেট’। প্রয়োজনের চেয়ে অতিরিক্ত তেল বরাদ্দ দেওয়া হয়। আবার নৌযান পরিচালনার সময় যেই গতি ও দূরত্ব অনুযায়ী তেল নেওয়া হয় তার চেয়ে কম গতি ও দূরত্বে চলাচল করে। এভাবে তেল বাঁচিয়ে তা পরিবহণ ঠিকাদারের মাধ্যমে গোপনে বিক্রি করে দেয়। এ কার্যক্রমের সঙ্গে বিআইডব্লিউটিসির সদর দপ্তর থেকে শুরু করে মাঠপর্যায়ের একটি সিন্ডিকেট জড়িত। এ কারণে তেল চুরির বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয় না। উলটো নানা অজুহাত দেখিয়ে তেল বরাদ্দের হার বাড়ানো হয়। তারা আরও বলেন, ২০১৩ সালের মে মাসে ঘটা করে ভিটিএস প্রযুক্তির উদ্বোধন করা হলেও তা কখনোই পুরোপুরি মনিটরিং করা হয়নি। এমনকি নানা অজুহাতে মাসিক বিল পরিশোধ না করে এক পর্যায়ে এ প্রযুক্তির ব্যবহার অকার্যকর করে দেওয়া হয়। সম্প্রতি পদ্মা সেতুতে ফেরির ধাক্কার ঘটনায় আবারও ভিটিএস স্থাপনের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি বিআইডব্লিউটিসির সার্বিক কার্যক্রম খতিয়ে দেখতে উচ্চ পর্যায়ের একটি কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়।
জানা গেছে, বিআইডব্লিউটিসির বহরে নতুন নতুন যাত্রীবাহী জাহাজ ও ফেরি যুক্ত হলেও প্রতি বছরই সংস্থাটির নিট মুনাফা কমছে। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে সংস্থাটি নিট ৪৬ কোটি ৬৬ লাখ টাকা মুনাফা হয়েছিল। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে তা কমে দাঁড়ায় ২০ কোটি ৩৭ লাখ টাকা ও ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ২২ কোটি সাত লাখ টাকা। ২০১৮-১৯ সালে নিট লাভ আরও কমে ১৫ কোটি ১৮ লাখ টাকা ও ২০১৯-২০ অর্থবছরে ১০ কোটি আট লাখ টাকায় দাঁড়িয়েছে। তেল চুরি, আর্থিক অনিয়ম, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধিসহ নানা কারণে এ অবস্থার তৈরি হয়েছে।
অতিরিক্ত তেল বরাদ্দ : জানা গেছে, স্রোত বৃদ্ধিসহ নানা অজুহাতে তেলের বরাদ্দ বাড়িয়ে থাকে এ সংস্থাটি। সর্বশেষ গত ১৪ জুলাই এক আদেশে শিমুলিয়া-বাংলাবাজার ও পাটুরিয়া-দৌলতদিয়াসহ অন্যান্য রুটের ফেরির তেল বরাদ্দ বাড়ানো হয়। ওই আদেশ গত ১৪ জুলাই জারি করা হলেও তা কার্যকর দেখানো হয় ৪ জুলাই থেকে। আরও জানা গেছে, গত ২ জুলাই সংস্থাটির মাওয়া বাণিজ্যিক কার্যালয় থেকে এক বেতার বার্তায় স্রোত ও পদ্ধা সেতুর পিলারের নিরাপত্তার কারণে বেশি দূরত্ব দেখিয়ে তেল বরাদ্দের আবেদন পাঠানো হয় সদর দপ্তরে। ওই চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে গত ৬ জুলাই তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে সংস্থাটির ফুয়েল সেল। ওই কমিটি ৭ জুলাই মাঠপর্যায়ে পর্যবেক্ষণ করে ৮ জুলাই প্রতিটি ফেরিতে তেল বরাদ্দ বাড়ানোর সুপারিশ করে। একই দিন আরেক প্রতিবেদনে পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া রুটে চলাচলকারী ফেরির তেল বরাদ্দ বাড়ানোরও সুপারিশ করা হয়। পরে দুই রুটেই তেল বরাদ্দ বাড়ানো হয়। এতে শিমুলিয়া-বাংলাবাজার রুটে চলতে ফেরি শাহ মখদুমের জ্বালানি ১৩৪ লিটার থেকে বাড়িয়ে ২১৫ লিটার করা হয়েছে। ফেরি এনায়েতপুরী ও শাহপরাণের তেলের বরাদ্দ প্রতি ট্রিপে ১৩৭ লিটার থেকে বাড়িয়ে ২২১ লিটার করা হয়েছে। একইভাবে অন্যান্য ফেরির তেলের বরাদ্দ বাড়ানো হয়। আরও জানা গেছে, রো রো ফেরিতে দুটি ইঞ্জিন থাকে। দুটি ইঞ্জিন গড়ে ৫০০ আরপিএমে চলবে-এমন শর্তে এ তেল বরাদ্দ দেওয়া হয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ফেরি এনায়েতপুরীর মাস্টার (চালক) মো. রেজাইল করিম জানান, তার ফেরিতে ভিটিএস সচল নেই। মাস্টার ব্রিজের সব মিটার নষ্ট অবস্থায় আছে। ফলে ইঞ্জিন কত আরপিএমে চলে তা তিনি দেখতে পারেন না। তবে ইঞ্জিন রুমের মিটার ভালো আছে। সেখানে যারা দায়িত্বে থাকেন তারা দেখতে পান। তিনি বলেন, জিপিএস সচল থাকলেও সবসময় কাজ করে না। তার ফেরিরও সার্ভে (ফিটনেস) নেই। পদ্মা সেতুতে আঘাতকারী রো রো ফেরি শাহজালালের জুনিয়র মাস্টার অফিসার রেজাউল করিম বলেন, মেশিনের আরপি দেখার অরিজিনাল মিটার নষ্ট। ভিটিএস নেই। তবে সম্প্রতি চায়না মিটার লাগানো হয়েছে। তিনি বলেন, মাস্টার ব্রিজে দাগ দেওয়া একটি মিটার রয়েছে। ওই মিটারে ২০ নম্বর দাগে উঠলে ৩৫০ আরপিএমে ইঞ্জিন চলছে সেটা ধরে নেওয়া হয়। একই ধরনের বক্তব্য দিয়েছেন আরও কয়েকটি ফেরির চালকেরা।