বরিশালে অবৈধ ইটভাটার ছড়াছড়ি পরিবেশ অধিদফতর নিরব ভূমীকায়
রেদওয়ান শাওন ।।প্রাগৈতিহাসিক সময় থেকেই মানুষ তার প্রয়োজনে বিশাল ভবন এবং বিভিন্ন নান্দনিক গঠনের অবকাঠামো তৈরী করে আসছে। বর্তমান আধুনিক বিশ্বে এই বিশাল বহুতল ভবন নির্মানে কংক্রিট, অ্যালুমিনিয়াম সিট, প্লাষ্টিক, কাঁচ ফাইবার, স্টীল এবং ধাতব বস্তুর ব্যাপক ব্যবহার হলেও বাংলাদেশসহ বহু স্বল্পোন্নত দেশে প্রধানত ব্যবহার হচ্ছে ইট। আর এই ইট তৈরীতে ব্যবহার হয় প্রকৃতির এক গুরুত্বপূর্ণ ও উত্তম উপাদান মাটি, এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে যা নেওয়া হয় কৃষি জমি ও নদীতীর থেকে, যাকে প্রকৃতির বর্জ্যের ঝুড়ি বলা হয়ে থাকে। বাংলাদেশে সাধারণত বছরের অক্টোবর থেকে মার্চ মাসকে ইট তৈরীর উপযুক্ত সময় হিসেবে বেছে নেন ইট কারখানার মালিক’রা। ইট ভাটার মালিক’রা কৃষকদের লোভ দেখিয়ে এককালীন অল্প কিছু টাকা দিয়ে চাষাবাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ জমির উপরি অংশের মাটি কেটে নিয়ে যায় ইট তৈরীর কাজে ব্যবহারের জন্য। বর্তমান আধুনিক বিশ্বে ইটের প্রয়োজনীয়তাকে অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু নিয়ম না মেনে এই প্রয়োজনীয় বস্তু তৈরীতে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে পরিবেশ, মানুষের স্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাস, স্বাস্থ্য, উর্বর মাটি, নদীতীরের মাটি এবং অতি উপকারী বায়ু। ইট তৈরীতে পোড়ানো হচ্ছে শত শত একর জমির উর্বর অংশ। বরিশাল জেলার বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে দেখা গেছে, জেলার সদর উপজেলা, বাকেরগঞ্জ, মেহেন্দিগঞ্জ, বাবুগঞ্জ, মুলাদিসহ সব জায়গায় কোনো ধরনের নিয়ম কানুন ও পরিবেশ দূষণের তোয়াক্কা না করেই ভাটাগুলোতে টিনের তৈরি ড্রাম চিমনিতে কাঠ জ্বালিয়ে ইট পোড়ানো হচ্ছে। ইট তৈরির মাটি নেওয়া হচ্ছে পার্শবর্তী খাল ও ফসলি জমি কেটে । ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন- ২০১৩-এ বলা হয়েছে- লাইসেন্স ছাড়া ইটভাটা করা যাবে না। কোনো ব্যক্তি ইট প্রস্তুতে কৃষি জমি কিংবা পাহাড় কেটে মাটি ব্যবহার করতে পারবেন না। অনুমতি ছাড়া খাল, পুকুর, নদীরপাড় কিংবা চরাঞ্চল কেটে মাটি সংগ্রহ করতে পারবেন না। একাধিক সুত্রে অভিযোগ পাওয়া গেছে, ভাটাগুলোতে শতো শতো মন ছোট-বড় গাছ পোড়ানো হচ্ছে। খাল ও ফসলি জমির পলি কেটে ইট তৈরি করছেন ভাটা মালিকরা। টিনের ছোট ড্রাম চিমনি ব্যবহারে প্রচুর পরিমাণে কালো ধোঁয়ারও সৃষ্টি হচ্ছে। এদিকে ছত্তার খাঁন নামের এক ব্যাক্তি বলেন, অনেক উপজেলায় যাতায়াত ব্যবস্থা ভাল না হওয়ায় সুবিধা নিচ্ছেন অবৈধ ইট ভাটার মালিকরা। তাদের সরকারি কোনো ভ্যাট-ট্যাক্স দিতে হচ্ছে না। তাদের কোনো সরকারি অনুমোদন না থাকায় ইচ্ছামতো ছোট-বড় গাছ পোড়াতে পারছেন। পরিবেশের ক্ষতি ও কাঠ পোড়ানোর ব্যপারে সদর উপজেলার ইট ভাটা মালিক মোঃ কালাম (ছদ্বনাম) বলেন, আমরা বিভিন্ন মহলকে ম্যানেজ করে আপাতত কাজ চালাচ্ছি। নিয়ম মেনে ইটভাটা করা খুবই কঠিন। তাই আমরা স্থানীয় প্রশাসনকে ম্যানেজ করেই ভাটা চালাচ্ছি। এই মুহূর্তে আমাদের ভাটার কোনো পরিবেশ ছাড়পত্র বা জেলা প্রশাসনের লাইসেন্স নেই। ভবিষ্যতে সব কিছুই পাকাপোক্তভাবে করবো। অবৈধ ভাটা স্থাপনে বৈধ ভাটা মালিকরা ক্ষতিগ্রস্ত হোক, এটা কেউ চান না। অবৈধ ভাটা মালিকদের তো সরকারি রাজস্ব দিতে হয় না কিংবা লাইন্সেস নবায়ন করতে হয় না। এর বিরুদ্ধে জেলা প্রশাসনের হস্তক্ষেপে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। তা না হলে বৈধ ব্যবসায়ীরা আর্থিক ক্ষতিতে পড়তেই থাকবেন। বাংলাদেশে অনুমোদিত ইট ভাটার সংখ্যা প্রায় ৬,৫০০ (দি ডেইলি স্টার, ১৩ ডিসেম্বর, ২০০৯)। তবে অনুমোদন ছাড়াও রয়েছে অনেক ইট ভাটা যেখানে কাঠ এবং কয়লাকে জ্বালানী হিসেবে ব্যবহার করা হয়। দেশে প্রচলিত আইন থাকা সত্ত্বেও বরিশালে গতানুগতিক পদ্ধতিতে ইট তৈরী করছে লাইসেন্সবিহীন অনেক ইট ভাটা। আর এই সব ইট ভাটার জ্বালানী হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে কাঠ যা প্রতি বছর বাংলাদেশের ইট ভাটার ২৫% জ্বালানী সরবরাহ করে থাকে। এই প্রাকৃতিক কাঠ পোড়ানোর ফলে একদিকে যেমন নষ্ট হচ্ছে বনজ সম্পদ, অন্যদিকে নষ্ট হচ্ছে ওইসব বনে বসবাসকারী জীবজন্তুর ভারসাম্য। অতিরিক্ত কয়লা পোড়ানোর ফলে নির্গত হচ্ছে ধূলিকনা, পার্টিকুলেট কার্বন, কার্বন মনোক্সাইড, সালফার এবং নাইট্রোজেন অক্সাইডসমূহ যা চোঁখ, ফুসফুস ও শ্বাসনালীতে মারাত্মক প্রভাব ফেলে। গতানুগতিক পদ্ধতির ইটভাটা শুধু বায়ু দূষণই করে না বরং বায়ু হতে বিভিন্ন বায়ুমন্ডলীয় উপায়ে মাটিতে এসব দূষণকে স্থানান্তরিত করে এবং ব্যাপকভাবে মাটি দূষণকে তরান্বিত করে, যা নষ্ট করে মাটির প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদানের ভারসাম্য। একটি হিসেব মতে ২৫০ বর্গমিটার ফ্লোরের একটি ৫-তলা ভবন নির্মানের জন্য ৫,০০,০০০ ইট প্রয়োজন যা তৈরীতে ১ হেক্টর ফারো স্লাইস (১০০ মি*১০০ মি* ১৫ সে. মি.) এরও বেশি মাটির উপরি অংশ প্রয়োজন, যা মাটি ক্ষয়ের একটি অন্যতম কারন। কৃষি প্রধান দেশে ইটভাটার সবচেয়ে বড় প্রভাব হল মাটির উর্বর উপরি অংশ পুড়িয়ে ইট তৈরী যা দেশের কৃষির উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। কারন প্রাকৃতিকভাবে মাটি তৈরী একটি সময় সাপেক্ষ বিষয়। বরিশালের আবাসিক এলাকা, কৃষি জমি এমনকি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পার্শ্ববর্তী এলাকায়ও অনেক ইটভাটা তৈরী হয়েছে, যা এইসব এলাকার জনস্বাস্থ্য, কৃষি ও বনজ বৃক্ষের উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে। যা ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইনের লঙ্ঘন। এমতাবস্থায় জনসচেতনতা তৈরী করে উন্নত প্রযুক্তিতে ইট কারখানা তৈরীতে সরকারী ও বেসরকারী অর্থায়ন এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পরিবেশ বান্ধব উদ্যোগই পারে একটি পরিবেশ বান্ধব, কম দূষক নিঃসরক ইট তৈরীর পরিবেশ সৃষ্টি করতে যা গ্রিন হাউজ গ্যাস নিঃসরণ কমিয়ে বিশ্ব জলবায়ু পরিবর্তনের বিপক্ষে বাংলাদেশের সুদৃঢ় অবস্থানকে নিশ্চিত করবে। বরিশাল পরিবেশ অধিদফতর অফিস সুত্র জানান, ইটভাটার বিষয়ে জেলার সব ইট ভাটা মালিকদের সরকারি নির্দেশ জানিয়ে দেয়া হয়েছে, অনেকেই সেগুলো মেনে চলছেন। পরিবেশের ক্ষতি হয়, এমন কোনো কাজে কাউকেই ছাড় দেয়া হবেনা। এ ব্যাপারে পরিবেশ অধিদফতরে’র বরিশাল বিভাগীয় কার্যালয়ের উপ-পরিচালক কামরুজ্জামান সরকারের সাথে মুঠোফোনে (০১৭১৪……………৯৭) যোগাযোগ করলে, এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত তিনি ফোন রিসিভ করেননী।