প্রশ্নবিদ্ধ ৩৩১ কোটি টাকা ব্যয়,৬ বছরেও চালু হয়নি তিন পাইকারি বাজার
আলোকিত বার্তা:বাংলাদেশের রাজধানীতে ৩৩১ কোটি টাকা ব্যয়ে তিনটি পাইকারি কাঁচাবাজার নির্মাণের উদ্দেশ্য ব্যাহত হচ্ছে।৬ বছর আগে মার্কেট ভবনগুলো নির্মাণ শেষ।কিন্তু এখন পর্যন্ত কারওয়ান বাজার স্থানান্তর হয়নি।ফলে ৬ বছর ধরে ভবনগুলো পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে।কবে নাগাদ এসব ভবনে পাইকারি বাজার সরে যাবে তা নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে অনিশ্চয়তার।কারওয়ান বাজারকে তিন ভাগ করে তিনটি ভবনে সরিয়ে নেয়ার কথা ছিল। এ উদ্দেশ্যে প্রকল্পটি হাতে নেয়া হয়। কিন্তু তা না করে সম্প্রতি তিনটি ভবনের একটিতে মেকানিক্যাল ওয়ার্কশপ শুরু করেছে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন (ডিএনসিসি)।অপর একটিকে আধুনিক হাসপাতালে রূপান্তরের ঘোষণা দেয়া হয়েছে। বাকিটির বিষয়ে কোনো ঘোষণাও দেয়া হয়নি। অথচ বিশাল অঙ্কের টাকা ব্যয় করে ভবনগুলো নির্মাণ করা হয়। ৬ বছরেও ব্যবহার শুরু না হওয়ায় এত টাকা ব্যয়ে ভবন নির্মাণের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।কবে নাগাদ কারওয়ান বাজার স্থানান্তর হবে, নাকি আদৌ হবে না, সেটা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এরই মধ্যে ডিএনসিসি মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম মহাখালী পাইকারি কাঁচাবাজারকে আধুনিক মানের হাসপাতালে রূপান্তরের ঘোষণা দিয়েছেন।
এ ভবন পাইকারি কাঁচাবাজারের জন্য নির্মাণ করে হাসপাতালে রূপান্তর করলে কারওয়ান বাজার স্থানান্তর অনিশ্চয়তার মুখে পড়বে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।অন্যদিকে গাবতলী-বাবুবাজার বেড়িবাঁধ সড়কসংলগ্ন আমিন বাজার পাইকারি কাঁচাবাজারকে ডিএনসিসি মেকানিক্যাল ওয়ার্কশপ হিসেবে ব্যবহার করেছে।ওই মার্কেটের দোকানগুলো কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বসার জায়গায় রূপান্তর করা হয়েছে। আর যাত্রাবাড়ীর কাজলা রোডে নির্মিত পাইকারি কাঁচাবাজারটি পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়রয়েছে।সংশ্লিষ্টরা বলেন, তারা প্রায় নিশ্চিত যে কারওয়ান বাজার সরছে না। কারণ তিনটি ভবনের দুটি অন্য কাজে ব্যবহার হলে কারওয়ান বাজার সরানো সম্ভব হবে না।বাকি একটি ভবনে সবার স্থান সংকুলান হবে না। ঢাকা সিটি কর্পোরেশন বিভক্তির পর পাইকারি কাঁচাবাজার নির্মাণ প্রকল্পের পরিচালক ডিএনসিসির জনবল হওয়ায় পুরো প্রজেক্ট ডিএনসিসির আওতাধীন রয়েছে।যাত্রাবাড়ী পাইকারি কাঁচাবাজার ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনে (ডিএসসিসি) স্থানান্তর না হওয়ায় ওই মার্কেটের মেইনটেন্যান্স কাজ করতে পারছে না ডিএসসিসি।এ প্রসঙ্গে ডিএনসিসি মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম বলেন,আমরা কারওয়ান বাজার স্থানান্তর করে যাত্রাবাড়ী এবং আমিন বাজারে নিয়ে যাব। সেলক্ষ্যে ডিএসসিসির সঙ্গে সমন্বিত কার্যক্রম পরিচালনা করছি। আর ডিএনসিসির কাউন্সিলরদের নেতৃত্বে এ সংক্রান্ত একটি কমিটিও করা হয়েছে।
এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘তিনটি মার্কেটের মধ্যে আমরা মহাখালী মার্কেটকে আধুনিক মানের হাসপাতালে রূপান্তর করতে চাই। এক্ষেত্রে এখানে যেসব দোকান এ মার্কেটে আসার কথা ছিল আমরা আমিন বাজারে সেসব দোকান তৈরি করে দেব। আর ব্যবসায়ীরাও এক জায়গায় থাকতে চান। এজন্য এটা কারওয়ান বাজার স্থানান্তরে কোনো সমস্যার সৃষ্টি করবে না।’সংশ্লিষ্টরা জানান, জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) সভায় ২০০৬ সালের ৪ অক্টোবর ‘ঢাকা শহরের তিনটি পাইকারি কাঁচাবাজার নির্মাণ প্রকল্প’ অনুমোদন পায়। অবিভক্ত ঢাকা সিটি কর্পোরেশন ২০০৭ সালে এ তিন মার্কেট নির্মাণ কাজ শুরু করে।আমিন বাজারে ৩৩ বিঘা, মহাখালীতে ৭ বিঘা এবং যাত্রাবাড়ীতে ৫ বিঘা জমির ওপর এ পরিকল্পিত কাঁচাবাজার নির্মাণ করে সিটি কর্পোরেশন। শুরুতে প্রকল্পের আকার ছিল ২০৬ কোটি টাকা। পরে আকার বেড়ে দাঁড়ায় ৩৩১ কোটি টাকা।
প্রকল্প বাস্তবায়নের পুরো টাকা সরকারের দেয়ার কথা থাকলেও ২৬৪ কোটি টাকা পরিশোধ করার পর সরকার আর কোনো টাকা দেয়নি। পরে সিটি কর্পোরেশনের নিজস্ব ফান্ডের টাকা থেকে প্রকল্পের কাজ শেষ হয়।২০১৩ সালের তিন পাইকারি কাঁচাবাজার নির্মাণ প্রকল্পের কাজ শেষ হয়। এরপর থেকে কারওয়ান বাজারের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনা করে তাদের সরানোর চেষ্টা করেছে সিটি কর্পোরেশন, কিন্তু রাজি করাতে পারেনি।
প্রয়াত মেয়র মো. আনিসুল হক দায়িত্ব গ্রহণের পর বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করলেও তার মৃত্যুর পর আর অগ্রগতি হয়নি।সংশ্লিষ্টরা আরও জানান, কারওয়ান বাজার ডিএনসিসির ২৪ বিঘা জায়গার ওপর আড়তসহ বিভিন্ন সাইজের ২ হাজার ৩০১টি দোকান রয়েছে। ব্যবসার ধরন অনুযায়ী ৮টি সমিতিও গড়ে উঠেছে সেখানে।এসব সমিতির মাধ্যমে শ্রেণিভিত্তিক ব্যবসা ও দোকান পরিচালিত হচ্ছে। কারওয়ান বাজার থেকে মার্কেট স্থানান্তর করতে হলে এসব সমিতির সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করতে হবে। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে এ উদ্যোগ লক্ষ্য করা যাচ্ছে না।এ প্রসঙ্গে কারওয়ান বাজার ক্ষুদ্র কাঁচামাল আড়ত মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক লোকমান হোসেন বলেন,প্রয়াত মেয়র আনিসুল হক জীবিত থাকতে কারওয়ান বাজার স্থানান্তরের বিষয়ে আলোচনা হয়েছিল। এরপর আর এ বিষয়ে কোনো আলোচনা করেনি ডিএনসিসি।তিনি বলেন, ‘এখন তো মহাখালী মার্কেটে করোনা হাসপাতাল করেছে। যাত্রাবাড়ী ও আমিন বাজারের কী অবস্থা সেটা জানি না। তবে ডিএনসিসি এ বিষয়ে আলোচনা করে আমাদের চাহিদামতো দোকানের ব্যবস্থা করলে পরে আমরা যাওয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেব।কারওয়ান বাজারের ব্যবসায়ীরা জানান, আমরা শুনেছি সিটি কর্পোরেশনের পাইকারি কাঁচাবাজারে দোকান রয়েছে সাড়ে চার হাজার। দোকানগুলোর আয়তন ৭০ থেকে ১২০ বর্গফুটের।কিন্তু, কারওয়ান বাজারের দোকানগুলো ৩০০-৪০০ বর্গফুটের। তাদের মতে, ছোট পরিসরের দোকান দিয়ে ব্যবসায়িক কার্যক্রম চালানো সম্ভব হবে না। এর ফলে ব্যবসায়ীরা দোকান বরাদ্দ নিতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না।ডিএনসিসির উদ্যোগ গ্রহণের পর মাত্র ১২৯টি দোকান বরাদ্দ হয়। দোকানের বর্গফুট প্রতি ২৫ হাজার টাকা নির্ধারণ করায় ক্রেতা সাধারণের মাঝে এ ব্যাপারে আগ্রহ সৃষ্টি হয়নি।পরে সিটি কর্পোরেশন থেকে বিদ্যমান সমস্যার সমাধানে কার্যকর কোনো উদ্যোগও গ্রহণ করেনি। দোকানগুলো বড় করে দেবে প্রতিশ্রুতি দিলেও সে ব্যাপারে কার্যকর কোনো উদ্যোগও লক্ষ্য করা যায়নি।এ প্রসঙ্গে ডিএসসিসির তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মুন্সি আবুল হাসেম বলেন,পাইকারি কাঁচাবাজার নির্মাণ প্রকল্পটি অবিভক্ত সিটি কর্পোরেশনের। বিভক্ত হওয়ার পর এটা ডিএনসিসির নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। তবে সম্প্রতি ডিএনসিসির সঙ্গে আমাদের সমন্বয় সভা হয়েছে। আমরা যাত্রাবাড়ী মার্কেটটি দ্রুত বুঝে নেব। এরপর সেখানে কিছু সংস্কার কাজ করে মার্কেট চালু করা হবে। আর এটা করতে হলে স্থানীয় সরকার বিভাগের মাধ্যমে করতে হবে। আশা করি দ্রুততম সময়ে এ জটিলতার নিরসন হবে। পরে কারওয়ান বাজার স্থানান্তরে কর্তৃপক্ষ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারবে।এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ‘ঢাকা শহরের তিন পাইকারি কাঁচাবাজার নির্মাণ প্রকল্প’র প্রকল্প পরিচালক এবং ডিএনসিসির তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. আরিফুর রহমানবলেন, ‘২০০৭ সালে শুরু হওয়া এ প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে ২০১৩ সালে। তবে এখনও মার্কেটটি ডিএসসিসির কাছে হস্তান্তর করা হয়নি। কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নিলে দ্রুত এ বিষটি সুরাহা করা সম্ভব হবে। এ বিষয়ে কার্যক্রম চলমান।