‘ভোটের নিরাপত্তায়’ হুমকি,জেল পালানো ৭ শতাধিক আসামি
জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক,আলোকিত বার্তা:হত্যা মামলা, মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত এসব আসামি দীর্ঘ সময় ধরে পলাতক থাকায় আসন্ন জাতীয় নির্বাচন ঘিরে তৈরি হয়েছে নিরাপত্তা হুমকি। একই সময়ে লুট হওয়া অনেক অস্ত্র-গোলাবারুদও এখনো উদ্ধার হয়নি।চব্বিশের ৫ আগস্টের আগে-পরে কারাগার থেকে পালিয়ে যাওয়া সাত শতাধিক আসামি ১৬ মাস পরও ধরা পড়েনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জালে।কারা ও পুলিশ সূত্র জানায়, পালিয়ে যাওয়া এসব আসামির মধ্যে হত্যা, সন্ত্রাস, ডাকাতি ও জঙ্গিবাদে সংশ্লিষ্ট গুরুতর মামলার অভিযুক্তরাও রয়েছে। পালানোর পর অনেককে গ্রেফতার করা হলেও বড় একটি অংশ এখনো ধরা-ছোঁয়ার বাইরে।
এ বিষয়ে নিরাপত্তা বিশ্লেষক বলছেন, নির্বাচনের আছে মাত্র দেড় মাস।নির্বাচন সামনে রেখে এসব পলাতক আসামি সহিংসতা,ভয়ভীতি প্রদর্শন বা নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়তে পারে।এতে ভোটারদের নিরাপত্তা ও সুষ্ঠু ভোটগ্রহণ ব্যাহত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলছে,পলাতক আসামিদের গ্রেফতারে নিয়মিত অভিযান চলছে।নির্বাচন সামনে রেখে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে এবং ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলো চিহ্নিত করা হচ্ছে।
সম্প্রতি ঢাকা-৮ আসনের সম্ভাব্য প্রার্থী, ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র ওসমান হাদিকে গুলি করে হত্যা, চট্টগ্রামে প্রার্থীর প্রচারণার সময় গুলিসহ কয়েকটি ঘটনা সামনে আসায় নিরাপত্তা শঙ্কার বিষয়টি ভাবাচ্ছে।
২০২০ সালের ২৫ জুন শরীয়তপুরের জাজিরায় অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী শাকিল মাদবরকে অপহরণ করে পরিবারের কাছে মুক্তিপণ দাবি করেন সাকিব ওরফে বাবু। কিন্তু মুক্তিপণ না পাওয়ায় বাবু ও তার সহযোগীরা শাকিলকে হত্যা করে মরদেহ নির্মাণাধীন রেলসেতুর পাশে পুঁতে রাখেন। সাকিবকে গ্রেফতারের পর বিচার শেষে আদালত মৃত্যুদণ্ড দেন। সাকিব ওই মামলায় কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কারাগারে আটক ছিলেন।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরদিন ৬ আগস্ট হাই সিকিউরিটি কারাগার থেকে পালিয়ে যান সাকিব। ১১ মাস পর গত ১৮ সেপ্টেম্বর ঢাকার তেজগাঁও থানাধীন তেজতুরি বাজার এলাকা থেকে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত সাকিবকে গ্রেফতার করে অ্যান্টি টেরোরিজম ইউনিট।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর সাকিবের মতো জেল থেকে পালিয়ে যান ২২৪০ জন আসামি। এর মধ্যে এক হাজার ৫২০ বন্দিকে কারাগারগুলোতে বিভিন্নভাবে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। ফিরিয়ে আনাদের মধ্যে জামিন হয়েছে এক হাজার ১৩০ জনের। এখনো প্রায় ৭২০ বন্দি পলাতক।
সারাদেশে অপারেশন ডেভিল হান্ট ফেজ–২ চলমান। প্রতিদিন ওয়ারেন্টভুক্ত আসামিসহ পলাতক আসামিদেরও গ্রেফতার করা হচ্ছে। নির্বাচনের আগে পলাতক আসামিদের ধরতে পুলিশ পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করছে।- পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) এ এইচ এম শাহাদাত হোসাইন
কারা অধিদপ্তর সূত্র জানায়, গত বছরের ৫ আগস্ট জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের আগে-পরে দেশের কয়েকটি কারাগারে বন্দিরা বিশৃঙ্খলা করেন। এসময় দেশের পাঁচ কারাগারে চরম বিশৃঙ্খলা ও বিদ্রোহ করে দুই হাজার ২৪০ বন্দি পালিয়ে যান। হামলাকারীরা কারাগার থেকে ৯৪টি শর্টগান ও চায়নিজ রাইফেল লুট করেন।
কাশিমপুর কেন্দ্রীয় হাই সিকিউরিটি কারাগার থেকে পালিয়ে যাওয়ার সময় ছয় বন্দি মারা যান। পলাতক বন্দিদের মধ্যে জঙ্গি, মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত, যাবজ্জীবন, বিভিন্ন মেয়াদে সাজা পাওয়াসহ বিচারাধীন মামলার আসামি রয়েছেন। এর মধ্যে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ও যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামি ২০৩ জন। তাদের বিরুদ্ধে হত্যা, ডাকাতি, সন্ত্রাসবিরোধী আইন, অস্ত্র, মাদক, ধর্ষণ, নারী নির্যাতনসহ বিভিন্ন অভিযোগে মামলা রয়েছে।
২০২৪ সালের ১৯ জুলাই হাজার হাজার লোক ফটক ভেঙে নরসিংদী জেলা কারাগারে ঢুকে পড়েন। তারা কারাগারের সেলগুলো খুলে দেন এবং আগুন ধরিয়ে দেন। এসময় ৯ জঙ্গিসহ ৮২৬ বন্দি পালিয়ে যান।
কারাগারটির জেল সুপার মো. তারেক কামাল বলেন,ঘটনার পর প্রশাসন ঘোষণা করে, যারা আত্মসমর্পণ করবেন তাদের বিরুদ্ধে মামলা হবে না। তখন ৬২১ বন্দি আত্মসমর্পণ করেন। এছাড়া তিন জঙ্গিসহ ৩৮ জনকে গ্রেফতার করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এখনো ১৬৭ বন্দি পলাতক।
তিনি আরও জানান,কারাগারের অফিসের অনলাইন সিস্টেম ব্যবস্থা ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। ফলে পলাতক বন্দিদের বিষয়ে তাদের কাছে বিস্তারিত তথ্য নেই।
কারাগার সূত্র জানায়, গত বছরের ৫ আগস্ট সন্ধ্যায় দুর্বৃত্তরা প্রধান ফটক ভেঙে গাজীপুরের হাই সিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগারে ঢুকে পড়ে। এসময় তারা কারাগারের ভেতর তৃতীয় তলার একটি গুদাম ভবনে আগুন লাগিয়ে দেয়। নষ্ট করে বন্দিদের ফাইলপত্র। হুড়োহুড়ি করে পালাতে গিয়ে ছয় বন্দি মারা যান। ওই কারাগার থেকে ২০২ জন বন্দি পালিয়ে যান। তাদের অধিকাংশ জঙ্গিবাদের ঘটনায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনের মামলায় কারাগারে ছিলেন।
কারাগারটির জ্যেষ্ঠ কারা তত্ত্বাবধায়ক মোহাম্মদ আবদুল্লাহ-আল-মামুন বলেন, ‘পালিয়ে যাওয়া ৬৫ বন্দিকে এখন পর্যন্ত গ্রেফতার করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এখনো ১৩৭ বন্দি পলাতক।’
কারা সূত্র জানায়, গত ৫ আগস্ট সন্ধ্যায় কয়েকশ দুর্বৃত্ত সাতক্ষীরা কারাগারের সীমানাপ্রাচীর টপকে ভেতরে ঢুকে পড়ে। পরে তারা প্রধান ফটকের তালা ভেঙে কারাগারে ঢুকে তালা ভেঙে ৫৯৬ বন্দিকে বের করে নিয়ে যায়।
সাতক্ষীরা জেলা কারাগারের কারা তত্ত্বাবধায়ক দেব দুলাল কর্মকার বলেন, ‘এখন পর্যন্ত ৫২৯ বন্দি আত্মসমর্পণ করেছেন। এছাড়া আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গ্রেফতার করেছে পালিয়ে যাওয়া ২৩ বন্দিকে। এখনো দুই নারীসহ ৪৪ বন্দি পলাতক।’
শীর্ষ পর্যায়ের আসামিরা পলাতক অবস্থায় থাকলে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখা বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। এতে স্পষ্ট হয় যে পলাতক সাত শতাধিক আসামির প্রভাব ও সক্ষমতা হালকাভাবে দেখার সুযোগ নেই।- অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক
৫ আগস্ট বিকেলে দুর্বৃত্তরা শেরপুর জেলা কারাগারের প্রধান ফটক ভেঙে ভেতরে ঢুকে হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট চালায় এবং অগ্নিসংযোগ করে। ওই সুযোগে কারাগারে থাকা ৫১৮ বন্দি পালিয়ে যান। এসময় দুর্বৃত্তরা ওই কারাগার থেকে ৯টি আগ্নেয়াস্ত্র (৫ চায়নিজ রাইফেল ও ৪টি শটগান) লুট করে নিয়ে যায়।
জেলা কারাগারের ভারপ্রাপ্ত জেলার মুহাম্মদ আবদুস সেলিম বলেন, ‘এখন পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ১৩৮ জনকে গ্রেফতার করেছে। এখনো পলাতক ৩৮০ বন্দি। এছাড়া আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী লুট হওয়া ৯টি আগ্নেয়াস্ত্র এবং এসবের এক হাজার ১৭৫টি গুলি উদ্ধার করেছে।কারাগার সূত্র জানায়, ৭ আগস্ট দুপুরে কুষ্টিয়া জেলা কারাগারের ভেতর বন্দিরা বিদ্রোহ করেন। একপর্যায়ে কারারক্ষীদের ওপর হামলা চালিয়ে ৯৮ বন্দি পালিয়ে যান।
কুষ্টিয়া জেলা কারাগারের তত্ত্বাবধায়ক মোহাম্মদ আবদুর রহিমের তথ্য অনুযায়ী, পালিয়ে যাওয়ার পর ৭২ বন্দি আত্মসমর্পণ করেন। ৯ বন্দিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ১৭ বন্দি পলাতক।
পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) এ এইচ এম শাহাদাত হোসাইন বলেন,সারাদেশে অপারেশন ডেভিল হান্ট ফেজ–২ চলমান। প্রতিদিন ওয়ারেন্টভুক্ত আসামিসহ পলাতক আসামিদেরও গ্রেফতার করা হচ্ছে। নির্বাচনের আগে পলাতক আসামিদের ধরতে পুলিশ পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করছে।’
কারা অধিদপ্তরের মহাপরিদর্শক (আইজি-প্রিজন) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ মো.মোতাহের হোসেন বলেন,কারাগারগুলো থেকে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত, যাবজ্জীবন ও বিভিন্ন মেয়াদে সাজাপ্রাপ্ত বন্দিসহ বিচারাধীন মামলার দুই হাজার ২শ বন্দি পালিয়ে যায়, যার মধ্যে এক হাজার ৫শ জনকে গ্রেফতারের পর ফের কারাবন্দি করা হলেও এখনো ৭শ বন্দি পলাতক।তবে বর্তমানে দেশের আইনশৃঙ্খলার পরিস্থিতি তারা চরম অবনতি ঘটাতে পারবেন না উল্লেখ করে কারা মহাপরিদর্শক বলেন,পলাতক বন্দিদের গ্রেফতারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযান অব্যাহত।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক, সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বলেন, ‘শীর্ষ পর্যায়ের আসামিরা পলাতক অবস্থায় থাকলে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখা বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। এতে স্পষ্ট হয় যে পলাতক সাত শতাধিক আসামির প্রভাব ও সক্ষমতা হালকাভাবে দেখার সুযোগ নেই।