দেশজুড়ে নির্বাচনি দামামা,ধীরে ধীরে কমছে শঙ্কা সন্দেহ মতবিরোধ
মু.এবি সিদ্দীক ভুঁইয়া:জাতীয় নির্বাচনসহ কয়েকটি ইস্যুতে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে শঙ্কা-সন্দেহ ও মতবিরোধ ছিল,তা ধীরে ধীরে কমতে শুরু করেছে।সমাধানের পথে জাতীয় জুলাই সনদ ও গণভোট ইস্যু।এমন পরিস্থিতিতে সোমবার ২৩৭ আসনে বিএনপি সম্ভাব্য একক প্রার্থী ঘোষণা করায় মুহূর্তে পালটে যায় মাঠের চিত্র। একই দিন এনসিপিও প্রার্থীদের একটি প্রাথমিক আংশিক তালিকার খসড়া ঘোষণা করেছে।এর আগে জামায়াতও প্রার্থীদের একটি প্রাথমিক তালিকা ঘোষণা করে। সব দলের অধিকাংশ প্রার্থী আসনভিত্তিক প্রচারণায় ব্যস্ত সময় পার করছেন। সরকারের আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক মধ্যস্থতায় বিএনপি,জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপি এখন ঐকমত্যের খুব কাছাকাছি অবস্থান করছে। অন্যদিকে নির্বাচন কমিশনও ভোটের জন্য প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ নিয়েছে। অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে প্রস্তুত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। পুলিশ, র্যাব, বিজিবি, আনসার, নৌ ও বিমানবাহিনীর বিপুলসংখ্যক সদস্যের পাশাপাশি থাকবেন ৯০ হাজার সেনা সদস্য। সব মিলিয়ে দেশজুড়ে বেজে উঠেছে নির্বাচনি দামামা।রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকার থেকে শুরু করে বিভিন্ন মহল বারবারই বলার চেষ্টা করছে আগামী ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই। নইলে দেশ ভয়াবহ সংকটে পড়বে। রাজনৈতিক দলগুলো এখন তা উপলব্ধি করছে। দেশ এখন নির্বাচনি ট্র্যাকে উঠে গেছে। কোনো ষড়যন্ত্র, কোনো গুজবই আর কাজে আসবে না। যেসব ইস্যু নিয়ে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপির মধ্যে অনৈক্য, তাও কেটে যাচ্ছে। সবচেয়ে বড় বিষয়-দেশের মানুষ প্রায় ১৫ বছর ভোট দিতে পারেননি। এখন ভোট দিতে তারা উন্মুখ হয়ে আছেন। রাজনৈতিক দলের প্রার্থী, দলীয় নেতাকর্মী ও সমর্থকদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষও ভোটের মাঠে নেমে পড়েছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কাজী মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান বলেন, নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট সময় যদি সরকার শুরুতেই ঘোষণা করত, রাজনৈতিক এসব দ্বন্দ্ব সামনে আসত না। এখন সরকার ও নির্বাচন কমিশন ভোটের জন্য প্রস্তুত। এ মুহূর্তে আরও বেশি করে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে মানুষ যুক্ত হবে। এর ফলে রাজনৈতিক বিরোধ, সহিংসতা, সরকারের বিরুদ্ধে যেসব অরাজনৈতিক ডিমান্ড-সব কমে আসবে। কেউ কেউ প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য, টিকে থাকার জন্য নানা ইস্যুতে নিজেকে স্বক্রিয় রাখছেন। কিন্তু এর সব অর্থ এই নয় যে, তারা একধরনের অনৈক্যের মধ্যে আছেন। সুতরাং সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে সব দল এক হয়ে যাবে, যা এখন দৃশ্যমান হচ্ছে।তিনি আরও বলেন, নির্বাচন নিয়ে নানা মতবিরোধ ছিল। আবার সবাই এখন নির্বাচনি কর্মকাণ্ডে সক্রিয় হচ্ছেন। এখন কেউ যদি নির্বাচনে বাধা দিতে আসে, সেটা হবে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে। কারণ, আগামী নির্বাচন সঠিক সময়ে হওয়া বাংলাদেশের জন্য খুব প্রয়োজন। যদি সঠিক সময়ে নির্বাচন না হয়, দেশই সংকটে পড়বে। সুতরাং রাষ্ট্র রক্ষা করতে হলে নির্বাচনকে প্রাধান্য দিতেই হবে, যা রাজনৈতিক দলগুলো বুঝতে পেরে এখন নির্বাচনে পুরোপুরি নেমে পড়েছে।
এদিকে ফেব্রুয়ারিতে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনে প্রস্তুতি নিয়ে এগোচ্ছে সরকার। নির্বাচনসংক্রান্ত সব প্রস্তুতি ১৫ নভেম্বরের মধ্যে শেষ করতে বলেছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। সম্প্রতি রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে নির্বাচন অবাধ, অংশগ্রহণমূলক ও সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতিনিধিদের নিয়ে নির্বাচন কমিশনের বৈঠক হয়। বৈঠক শেষে ইসি সচিব আখতার আহমেদ জানান, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৯০ হাজার থেকে ১ লাখ সেনা সদস্য দায়িত্ব পালন করবেন। একই সঙ্গে দায়িত্ব পালন করবেন দেড় লাখ পুলিশ সদস্য। এছাড়া সারা দেশে দায়িত্ব পালন করবেন সাড়ে ৫ লাখ আনসার সদস্য। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে কমিশনে কোনো উদ্বেগ নেই।
অন্যদিকে, কয়েকদিনের আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্ঠানিক আলোচনার ভিত্তিতে সরকার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে-জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নে গণভোট এবং আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন একই দিনে হবে। এই গণভোটে জুলাই জাতীয় সনদের প্রস্তাবগুলোর ওপর বিভিন্ন দলের দেওয়া নোট অব ডিসেন্ট (ভিন্নমত) উল্লেখ থাকবে না। তবে ঐকমত্য কমিশনের পক্ষ থেকে সনদ বাস্তবায়নে ২৭০ দিনের বাধ্যবাধকতার যে সুপারিশ করা হয়েছে, সেটিও তুলে দেওয়া হবে। এছাড়া পিআর (আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব) পদ্ধতিতে গঠিত হবে সংসদের উচ্চকক্ষ। অর্থাৎ জুলাই জাতীয় সনদ নিয়ে বিএনপি ও জামায়াত উভয় পক্ষের যে দাবি রয়েছে, সেসব দাবি মানার ক্ষেত্রে সরকার ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা করছে। সোমবার রাজধানীর তেজগাঁওয়ে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত উপদেষ্টা পরিষদের জরুরি সভায়ও এসব বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। তবে এখনই এসব সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিয়ে দলগুলোর সঙ্গে সরাসরি বিরোধে যেতে চায় না সরকার। এজন্যই দলগুলোকে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত জানাতে কমপক্ষে এক সপ্তাহের সময় দেওয়া হয়েছে। তা না হলে সরকার পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবে।
সূত্রমতে, জুলাই সনদকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে মতবিরোধ, তা সমাধানে পর্যার আড়ালেও চলছে নানা বৈঠক-আলোচনা। বিশেষ করে বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপির নেতাদের সঙ্গে সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত কয়েকজন উপদেষ্টা দলগুলোকে ঐকমত্যে আনার চেষ্টা করছেন। এর অগ্রগতিও আছে। যার ফল ধীরে ধীরে দৃশ্যমান হচ্ছে বলেও ওই সূত্র জানিয়েছে।
এদিকে বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপি পুরোপুরি নির্বাচনকেন্দ্রিক কর্মকাণ্ড শুরু করেছে। সোমবার বিএনপি ২৩৭ (মঙ্গলবার একটি আসন স্থগিত করা হয়) আসনে সম্ভাব্য একক প্রার্থী ঘোষণা করেছে। আগেই ২৯৮ আসনে একক প্রার্থী ঘোষণা করেছিল জামায়াত। শিগ্গিরই দলটি চূড়ান্তভাবে আনুষ্ঠানিক প্রার্থী ঘোষণা করবে। প্রায় সব আসনেই প্রার্থী দেওয়ার চিন্তা করছে এনসিপি। এরই মধ্যে শীর্ষ নেতারা কে কোথায় নির্বাচন করবেন, তাও চূড়ান্তের পথে। সব জল্পনাকল্পনার অবসান ঘটিয়ে শাপলা কলি প্রতীকসহ চূড়ান্ত নিবন্ধনও পেয়েছে এনসিপি। নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য সার্বিক প্রস্তুতি ও পরিকল্পনা, প্রার্থী বাছাই, মাঠ পর্যায়ের সমন্বয়, আইনি ও প্রশাসনিক কার্যক্রম, মিডিয়া ও প্রচারণা এবং প্রশিক্ষণ ও মনিটরিংয়ের লক্ষ্যে শীর্ষ নেতা নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারীকে প্রধান করে ১০ সদস্যের কেন্দ্রীয় নির্বাচনি পরিচালনা কমিটিও করেছে দলটি।
এদিকে ৫০ আসনে একক প্রার্থী ঘোষণা করেছে গণঅধিকার পরিষদ। এছাড়াও ১৩৮ আসনে প্রার্থী দিয়েছে গণতন্ত্র মঞ্চে থাকা ৬ দল। এছাড়া এবি পার্টি ১০৯, খেলাফত মজলিস ২৫৬, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস ২৬৮ এবং ইসলামী আন্দোলন প্রায় ৩০০ আসনে একক প্রার্থী চূড়ান্ত করেছে।এর বাইরেও অধিকাংশ দল সম্ভাব্য একক প্রার্থী ঘোষণা করেছে।
জানা যায়, আসনগুলোয় এখন প্রায় সব দলের প্রার্থীরা গণসংযোগ করছেন। বিভিন্ন দলের বেশ কয়েকটি আসনের সম্ভাব্য প্রার্থীরা জানান, এলাকায় এখন ভোটের উৎসব চলছে। যেখানেই যাচ্ছেন, সেখানেও ভোটের আলাপ। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ বলেন, নির্বাচনি উৎসব শুরু হয়ে গেছে। প্রার্থীরা নিজ নিজ আসনে ঐক্যবদ্ধভাবে গণসংযোগ করছেন। জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান মঙ্গলবার ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের বলেন, ‘সবাইকে নিয়েই ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন দেখতে চাই। আমরা এক বছর আগেই সম্ভাব্য প্রার্থী তালিকা বিভিন্নভাবে, আঞ্চলিকভাবে জানিয়ে দিয়েছি। চূড়ান্ত তালিকাটা সময়মতো কেন্দ্রের পক্ষ থেকে ঘোষণা করব। তবে যেহেতু আমরা একা ইলেকশন করব না, আরও অনেককে আমরা ধারণ করব দেশ ও জাতির স্বার্থে। সবদিক বিবেচনা করেই চূড়ান্তভাবে যথাসময়ে প্রার্থী ঘোষণা করব।’ ভোটের মাঠে সৌহার্দও লক্ষ করা গেছে। ইতোমধ্যে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিপক্ষে কোনো প্রার্থী দেবে না বলে জানিয়েছে এনসিপি। মঙ্গলবার দলটির মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেন, খালেদা জিয়ার আসনে এনসিপি কোনো প্রার্থী দেবে না। গণ-অভ্যুত্থানের পর নতুন একটি সৌন্দর্য এসেছে-খালেদা জিয়া প্রার্থী হয়েছেন। তার আপসহীন ও লড়াকু নেতৃত্ব বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে অনেক শক্তিশালী করেছে।