ভোটের আগে বাড়ছে উত্তাপ ,সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে রাজনৈতিক দলের প্রশ্ন
মু.এবি সিদ্দীক ভুঁইয়া:জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিতে যাওয়া রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে প্রধান তিনটি দল বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপির পরস্পরবিরোধী অবস্থান এ উত্তাপের মাত্রা আরও বাড়িয়েছে।মঙ্গল ও বুধবার প্রধান উপদেষ্টা ড.মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে পৃথক বৈঠকে কয়েকজন উপদেষ্টা, নির্বাচন কমিশন ও মাঠ প্রশাসনের নিরপেক্ষ ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে দলগুলো।এছাড়া নির্বাচন সামনে রেখে নিজেদের দাবি-দাওয়া জানানোর পাশাপাশি জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশ ও গণভোটের সময় নিয়েও বিপরীতমুখী অবস্থানে দলগুলো। ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনে আত্মবিশ্বাসী অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। নির্বাচন সামনে রেখে ইতোমধ্যে নানামুখী প্রস্তুতিও শুরু হয়েছে।বেশির ভাগ রাজনৈতিক দলও ভোটের মাঠে নেমে পড়েছে।তবে নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে,চ্যালেঞ্জও বাড়ছে।বিশেষ করে নির্বাচনের আগে সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে উঠছে নানা প্রশ্ন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন,পুরো বিষয়টি একটি রাজনৈতিক জটিলতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।এখানে সবাই কৌশলী আচরণ করছে।তবে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজনে সরকারকে রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থা ধরে রাখতে হবে। একই সঙ্গে নিজেদের নিরপেক্ষতা বজায় রাখাও খুব জরুরি। তা না হলে যদি অন্তর্বর্তী সরকারের নিরপেক্ষতার প্রশ্ন বাড়তে থাকে, বিশেষ করে উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য এবং নির্বাচনসংশ্লিষ্ট প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোর নাম উল্লেখ করে তালিকা দেওয়ার প্রেক্ষাপট তৈরি হয়, সেক্ষেত্রে আগামী নির্বাচন অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে যেতে পারে।
জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. সাব্বির আহমেদ বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের সময় তো রাজনৈতিক দলগুলোর তালিকা ছিল। তবে তারা কেউ এসব দলের সরাসরি অনুসারী নন। ফলে কোনো রাজনৈতিক দল যদি এখন কোনো উপদেষ্টাকে নিয়ে প্রশ্ন তোলে তাহলে তাকে রাখা উচিত হবে না। কারণ সরকারের নিরপেক্ষতার জায়গাগুলো শক্তভাবে হাত দিতে হবে। অনেক দিন পরে একটি বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের প্রশ্ন আমাদের সামনে এসেছে। ফলে এই দাবি তো যৌক্তিক। এই বিষয়গুলো সরকারকে বিবেচনায় নিতেই হবে।তিনি আরও বলেন, তবে নির্বাচন কমিশন নিয়ে কেন এতদিন পর প্রশ্ন আসছে-সেটি নিয়ে আমি খুব বেশি নিশ্চিত নই। এটা তাদের দলীয় প্রতীকের কারণে কি না, সেটি পর্যালোচনার দাবি রাখে। তবে এই বিষয়টি নিয়েও সরকারকে একটা ব্যাখ্যা দিতে হবে। কারণ একটা অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজনে রাজনৈতিক দলগুলোকে আস্থায় আনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং এটাই এই মুহূর্তে মূল বিষয়। কারণ রাজনৈতিক দলগুলো অসহযোগিতা করলে সরকার বিপদে পড়ে যাবে বলেও মনে করেন ড.সাব্বির আহমেদ।
একই বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ আইনুল ইসলাম বলেন, জুলাই সনদ নিয়ে ইতোমধ্যে একটি অনাস্থা তৈরি হয়ে গেছে। এর বাস্তবায়ন, আইনি ভিত্তি নিয়েও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতানৈক্য দেখা দিয়েছে। অন্যদিকে কেউ কেউ নির্বাচন কমিশনের প্রতি অনাস্থা জানাচ্ছে। আবার কেউ সরকারকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের চরিত্রে যেতে বলছে। অর্থাৎ পুরো বিষয়টি একটি রাজনৈতিক জটিলতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এখানে সবাই কৌশলী আচরণ করছে। আগামী দিনে সুশাসন বা গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করতে গেলে যে ধরনের বৃহত্তর ঐক্য হওয়া দরকার, সেটা না করে সবাই যার যার জায়গা থেকে রাজনৈতিক কৌশল অবলম্বন করছে।
এ অবস্থা চলতে থাকলে আগামী নির্বাচনই একটি অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে যাবে বলেও মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষক। তিনি আরও বলেন, কিছুদিনের মধ্যেই আমাদের শিডিউল ঘোষণা করতে হবে। এ অবস্থায় এসে দলগুলো যখন সরকারের ওপর অনাস্থা প্রকাশ করে, তখন তো তা উদ্বেগের বিষয়ও। তার মতে, নির্বাচনের বাকি আছে মাত্র কয়েক মাস। এ অবস্থায় নির্বাচন কমিশনের ওপর অনাস্থা প্রকাশ করা মানে নির্বাচনই অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে যাবে। অধ্যাপক মোহাম্মদ আইনুল ইসলাম বলেন, সব দলকে আরও কাছে আনার চেষ্টা করতে হবে সরকারকে। সবার ঐকমত্যের ভিত্তিতে এই সনদ বাস্তবায়ন করতে হবে। সবাইকে এক টেবিলে বসিয়ে রাজনৈতিক সমঝোতা তৈরি করা জরুরি।
প্রসঙ্গত, বেশ কিছু দিন ধরেই নাম উল্লেখ না করেই কয়েকজন উপদেষ্টার বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ করে আসছেন বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপির নেতারা। দলগুলো প্রতিপক্ষ দলগুলোকে জড়িয়েও নানা অভিযোগ তুলছে। মঙ্গলবার প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠকে অন্তর্বর্তী সরকারকে এখন থেকে নিরপেক্ষ ‘তত্ত্বাবধায়ক’ সরকারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার পরামর্শ দিয়েছে বিএনপি। এছাড়া দলটির পক্ষ থেকে দুই উপদেষ্টা সম্পর্কেও আপত্তি জানানো হয়।
পরদিন বুধবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক অনুষ্ঠানে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী এর ব্যাখ্যাও করেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ, পুরোপুরি নিরপেক্ষ অবস্থানে যাওয়া উল্লেখ করে তিনি বলেন, সরকারের ভেতরে-বাইরে যাদের নিরপেক্ষতা ভঙ্গ করার সুযোগ আছে, তাদের রেখে নিরপেক্ষতা বজায় রাখা যাবে না। এই প্রশ্ন আসছে বিভিন্ন কারণে। বিএনপির এই নেতা আরও বলেন, বেশ কয়েকজন উপদেষ্টা এ সরকারের বেশ কিছু পদে পদায়নের ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করেছেন। তাই যাদের নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে অথবা যারা আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবেন অথবা যারা কোনো দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত, তারা সরকারে থাকলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের যে ভূমিকা, তা ব্যাহত হতে পারে।
বিএনপির সঙ্গে বৈঠকের পরদিন জামায়াত ও এনসিপির সঙ্গে বৈঠক করেন প্রধান উপদেষ্টা। বুধবার সন্ধ্যায় রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় এ বৈঠক শেষে জামায়াতের নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের সাংবাদিকদের বলেন, আমরা বলেছি, কিছু কিছু লোক আপনাকে (প্রধান উপদেষ্টা) বিভ্রান্ত করে। আপনার প্রতি আমাদের আস্থা আছে। কিন্তু আপনার কিছু লোক আপনার পাশে আপনাকে বিভ্রান্ত করে এবং ওরা কোনো একটি দলের পক্ষে কাজ করে বলে আমরা মনে করি। তাদের ব্যাপারে আপনাকে হুঁশিয়ার থাকা দরকার।
এসময় বর্তমানে নির্বাচন কমিশন, সচিবালয়, পুলিশ প্রশাসনে ৭০-৮০ শতাংশ কর্মকর্তা একটি দলের আনুগত্য করছেন বলে অভিযোগ করেন আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের। তিনি বলেন, আমরা গেলে তারা বলে যে প্রচণ্ড চাপ। তো চাপ কোথায় থেকে? একটি দল থেকে আসছে, তারা বলেছে। পুলিশেও একই অবস্থা আছে। সারা দেশের আদালতে পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) যারা হয়েছেন, ওখানে ৮০ শতাংশ একটি বিশেষ দলের বলেও অভিযোগ করেন জামায়াতে ইসলামীর এই নেতা।অন্যদিকে বৈঠক শেষে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, আমরা মনে করি,একটি নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য উপদেষ্টা পরিষদের নিরপেক্ষতা এবং দক্ষতা নিশ্চিত করা লাগবে।সে দাবির সঙ্গে ভিন্নমত নেই। কিন্তু এই উপদেষ্টা পরিষদ পুরো পরিবর্তন করতে হবে,এটার আসলে সুযোগ নেই।নির্বাচন কমিশন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশনের গঠন প্রক্রিয়া ও বর্তমান আচরণ নিরপেক্ষ নয়। প্রতিষ্ঠানটি সাংবিধানিকভাবে কাজ করছে না। তারা কোনো দলের পক্ষে কাজ করছে আবার কোনো দলের সঙ্গে বিমাতাসুলভ আচরণ করছে। এ কমিশন পুনর্গঠন করা প্রয়োজন। বিগত দিনে কীভাবে তাদের পক্ষপাতযুক্ত আচরণ ফুটে উঠেছে তা প্রধান উপদেষ্টাকে জানানো হয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, নির্বাচন সামনে রেখে সরকারের অবস্থান ও প্রস্তুতি সন্তোষজনক। এ কারণে বর্তমান সরকারের অধীনেই নির্বাচন চায় ক্রিয়াশীল সব রাজনৈতিক দল। তবে তাদের সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এর অন্যতম হচ্ছে নিরপেক্ষতা। অন্তর্বর্তী সরকারের ভেতরে-বাইরে যাদের নিরপেক্ষতা ভঙ্গ করার সুযোগ আছে, তাদের রেখে নিরপেক্ষতা রক্ষা করা যাবে না। এ বিষয়ে সরকারকে আরও বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। জুলাই সনদ বাস্তবায়ন ও গণভোটের সময়ের বিষয়ে দলগুলোর ঐকমত্য আনতে হবে। এছাড়া নিরপেক্ষতার প্রশ্নে সব দলের আস্থা অর্জন করে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের দিকে এগোতে হবে।