বাস্তব মূল্যায়নের একটি প্রতিফলন,জিপিএ-৫ এ হোঁচট - Alokitobarta
আজ : মঙ্গলবার, ১৮ই নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ৩রা অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

বাস্তব মূল্যায়নের একটি প্রতিফলন,জিপিএ-৫ এ হোঁচট


মোহাম্মাদ আবুবকর সিদ্দীক ভুঁইয়া : এ বছর সাধারণ নয়টি শিক্ষা বোর্ড, মাদরাসা ও কারিগরি শিক্ষা বোর্ড মিলিয়ে গড় পাসের হার ৫৮.৮৩ শতাংশ। এবার গত বছরের তুলনায় পাসের হার কমেছে ১৮ দশমিক ৯৫ শতাংশ। এ বছর জিপিএ-৫ পেয়েছেন ৬৯ হাজার ৯৭ জন শিক্ষার্থী।২০২৫ সালের এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফল প্রকাশ করা হয়েছে।পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত পাঁচ বছরের মধ্যে এবারই সাধারণ ৯টি শিক্ষা বোর্ডে জিপিএ-৫ প্রাপ্তদের সংখ্যা কমেছে উল্লেখযোগ্য হারে। মাদ্রাসা আর কারিগরি শিক্ষা বোর্ডেও জিপিএ-৫ প্রাপ্তদের সংখ্যায় লেগেছে বড় ধাক্কা। সবমিলিয়ে এ বছর জিপিএ-৫ নিয়ে ভরাডুবি হয়েছে।শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ বছরই জিপিএ-৫ প্রাপ্তির এই সংখ্যা বাস্তব মূল্যায়নের একটি প্রতিফলন। তারা বলছেন, এই ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে পারলে নিকট ভবিষ্যতে আমরা শিক্ষার মানোন্নয় করতে সক্ষম হবো। মেধাসম্পন্ন শিক্ষার্থীরাই কেবল জিপিএ-৫ পাবেন। সামগ্রিক বিষয় হচ্ছে সহজে পাসের দিন বা জিপিএ-৫ প্রাপ্তির প্রথা শেষ করতে হবে। এ ফলাফলের মধ্যে দিয়ে সেই যাত্রা শুরু হোক।

পাঁচ বছরে সর্বনিম্ন জিপিএ-৫ সাধারণ বোর্ডগুলোতে
সাধারণ ৯টি বোর্ডে গত পাঁচ বছরের জিপিএ-৫ এর পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০২১ সালে মোট জিপিএ-৫ পায় ১ লাখ ৭৮ হাজার ৫২২ জন শিক্ষার্থী। এদের মধ্যে ছেলে ৮০ হাজার ১১৯ জন এবং মেয়ে ৯৮ হাজার ৪০৩ জন। ২০২২ সালে জিপিএ-৫ প্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের সংখ্যা একটু কমে দাঁড়ায় ১ লাখ ৫৯ হাজার ৭৫৫ জন। এদের মধ্যে ছেলে ৭২৫১৯ জন এবং মেয়ে শিক্ষার্থী ৮৭ হাজার ৩৩৬ জন। ২০২৩ সালে জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীদের সংখ্যা নেমে আসে প্রায় অর্ধেকে। এ বছর জিপিএ-৫ পায় ৭৮ হাজার ৫২১ জন শিক্ষার্থী। এদের মধ্যে ছেলে শিক্ষার্থী ৩৬ হাজার ৭১৭ জন এবং মেয়ে শিক্ষার্থী ৪১ হাজার ৮০৪ জন। ২০২৪ সালে এই সংখ্যা আবারও বেড়ে দাঁড়ায় ১ লাখ ৩১ হাজার ৩৭৬ জন। এদের মধ্যে ছেলে ৫৮ হাজার ৫৮৮ জন এবং মেয়ে শিক্ষার্থী ৭২ হাজার ৭৮৮ জন। সবশেষ ২০২৫ সালে জিপিএ-৫ এ নামে বড় ধস। গত পাঁচ বছরের মধ্যে এ বছরই সর্বনিম্ন জিপিএ-৫ পায় শিক্ষার্থীরা। এ বছর মাত্র ৬৩ হাজার ২১৯ জন শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ পেয়েছে। এদের মধ্যে ছেলে ২৯ হাজার ৬১ জন এবং মেয়ে শিক্ষার্থী ৩৪ হাজার ১৫৮।

মাদ্রাসা বোর্ডে জিপিএ-৫ প্রাপ্তিতে এগিয়ে ছেলেরা
পরিসংখ্যান অনুযায়ী সাধারণ ৯টি শিক্ষাবোর্ডে জিপিএ-৫ এর দৌড়ে মেয়ে শিক্ষার্থীরা বরাবর এগিয়ে থাকলেও মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডে এই চিত্র একেবারেই আলাদা। এ বোর্ডে গত পাঁচ বছরেই ছেলে শিক্ষার্থীরা জিপিএ-৫ বেশি পেয়ে আসছে। তবে কারিগরি বোর্ডেও প্রায় প্রতিবছর জিপিএ-৫ প্রাপ্তিতে এগিয়ে মেয়েরা।এদিকে মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডেও গত পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন জিপিএ-৫ ধারী এ বছরেই। গত পাঁচ বছরের পরিসংখ্যান বলছে, ২০২১ সালে মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডে জিপিএ-৫ পায় ৪ হাজার ৮৭২ জন। ২০২২ সালে এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৯ হাজার ৪২৩ জন। ২০২৩ সালে জিপিএ-৫ পায় ৭ হাজার ৯৭ জন। ২০২৪ সালে জিপিএ-৫ পায় ৯ হাজার ৬১৩ জন। সবশেষে ২০২৫ সালে এ সংখ্যাতে বড় ধস নেমে চলে আসে মাত্র ৪ হাজার ২৬৮ জনে। যা গত পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন।

কারিগরিতে জিপিএ-৫ এ বড় ধস
কারিগরি শিক্ষা বোর্ডে জিপিএ-৫ এর এই বেহালদশা আরও প্রকট। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০২১ সালে কারিগরি শিক্ষাবোর্ড থেকে জিপিএ-৫ পায় ৫ হাজার ৭৭৫ জন। ২০২২ সালে জিপিএ-৫ পায় ৭ হাজার ১০৪ জন। ২০২৩ সালে এই সংখ্যা দাঁড়ায় ৬ হাজার ৯৭৭ জন। ২০২৪ সালে একটু কমে আসে ৪ হাজার ৯২২ জন। তবে ২০২৫ সালে এ শিক্ষাবোর্ডে করুণ দশা শুরু হয়। এ বোর্ডে ২০২৫ সালে মাত্র ১ হাজার ৬১০ জন শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ পায়।

জিপিএ-৫ প্রাপ্তিতে এগিয়ে বিজ্ঞান; সর্বনিম্ন মানবিক বিভাগ
ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা গেছে, জিপিএ-৫ প্রাপ্তিতে বিজ্ঞান শাখার শিক্ষার্থীরা বেশি এগিয়ে আছেন। এ বিভাগ থেকে ১ লাখ ২৮ হাজার ১০০ জন ছেলে শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশ নেয়। এদের মধ্যে জিপিএ-৫ পায় ২৪ হাজার ১৪৪ জন শিক্ষার্থী। যা শতকরা ১৮. ৮৫ শতাংশ। অপরদিকে ১ লাখ ৪০ হাজার ৫৯ জন মেয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে জিপিএ-৫ পায় ২১ হাজার ৪২৬ জন। যা শতকরা ১৫.৯৮ শতাংশ। ফলাফল অনুযায়ী বিজ্ঞান বিভাগে জিপিএ-৫ প্রাপ্তিতে ছেলেরা কিছুটা এগিয়ে আছে। মানবিক বিভাগের ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এ বিভাগে মোট ২ লাখ ৬২ হাজার ৫৮২ জন ছেলে শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশ নেন। এদের মধ্যে জিপিএ-৫ পায় মাত্র ২ হাজার ৮১১ জন। শতকরা হিসেবে যা মাত্র ১.০৭ শতাংশ। এ বিভাগে ৩ লাখ ৪৩ হাজার ৭০০ জন মেয়ে শিক্ষার্থী অংশ নেন। তবে জিপিএ-৫ পান মাত্র ৮ হাজার ৯৮২ জন। শতকরা হিসেবে যা মাত্র ২.৬১ শতাংশ।অপরদিকে ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগে মোট ৯৮ হাজার ৪০৫ জন শিক্ষার্থী অংশ নেন। এদের মধ্যে জিপিএ-৫ পায় মাত্র ২ হাজার ১০৬ জন। যা শতকরা ২.১৪ শতাংশ। এছাড়া ৮০ হাজার ৩৯৬ জন মেয়ে শিক্ষার্থী অংশ নিলেও জিপিএ-৫ পায় ৩ হাজার ৭৫০ জন। যা শতকরা ৪.৬৬ শতাংশ।

সর্বোচ্চ জিপিএ-৫ ঢাকায়; সর্বনিম্ন সিলেটে
ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা গেছে, সাধারণ ৯টি বোর্ডের মধ্যে মোটা দাগে জিপিএ-৫ বেশি পেয়েছে ঢাকা বোর্ডের শিক্ষার্থীরা। এ বোর্ডে জিপিএ ৫ প্রাপ্তির হার ৮.৯২ শতাংশ। রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডে জিপিএ-৫ প্রাপ্তির হার ৭.৭৪ শতাংশ। চট্টগ্রাম বোর্ডে এই হার ৫.৯৮ শতাংশ। দিনাজপুর বোর্ডে এই হার ৫.৯১ শতাংশ। যশোর শিক্ষা বোর্ডে ৫.৩৩ শতাংশ। ময়মনসিংহ শিক্ষা বোর্ডে এই হার ৩.৫৪ শতাংশ। বরিশাল শিক্ষা বোর্ডে এই হার ২.৮৩ শতাংশ। কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডে এই হার ২.৭২ শতাংশ। সিলেট শিক্ষা বোর্ডে এই হার ২.৩২ শতাংশ।এদিকে মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডে জিপিএ-৫ পাওয়ার হার ৫.১৫ শতাংশ এবং কারিগরিতে মাত্র ১.৫২ শতাংশ।

বাস্তবভিত্তিক প্রশ্ন বা বিশ্লেষণধর্মী মূল্যায়নে পিছিয়ে পড়ছে
এ বিষয়ে শিক্ষাবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, এইচএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ প্রাপ্তির হার গত পাঁচ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম হওয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দেয়— আমরা শিক্ষার পরিমাণ বাড়ালেও গুণগত মানে পিছিয়ে যাচ্ছি। ফলাফলের এই ধস কোনো এক বছরের ঘটনা নয়, এটি কয়েক বছরের ধারাবাহিক অব্যবস্থাপনা ও নীতিগত শৈথিল্যের ফল।

তিনি বলেন, আমরা এখনো শিক্ষাকে কেবল ‘পরীক্ষা পাস’-এর মাধ্যমে পরিমাপ করি। স্কুল ও কলেজগুলোতে শেখার জায়গায় মুখস্ত নির্ভরতা তৈরি হয়েছে। শিক্ষক প্রশিক্ষণ, পাঠ্যসূচি ও মূল্যায়ন পদ্ধতির মধ্যে সমন্বয় নেই। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে করোনাকালীন শিক্ষার ক্ষতি, যা এখনো পুষিয়ে ওঠেনি। এ কারণেই শিক্ষার্থীরা বাস্তবভিত্তিক প্রশ্ন বা বিশ্লেষণধর্মী মূল্যায়নে পিছিয়ে পড়ছে।আরেকটি উদ্বেগের বিষয় হলো, মানবিক বিভাগে ফলাফলের দূরবস্থা। এটা শুধু কোনো বিভাগের দুর্বলতা নয়; এটি সমাজে সমালোচনামূলক চিন্তা, ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি অনাগ্রহের প্রতিফলন। যখন বিজ্ঞান, ব্যবসায় ও প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়, তখন মানবিক বিভাগ স্বাভাবিকভাবেই অবহেলিত হয়ে পড়ে। কিন্তু একটি টেকসই সমাজের জন্য মানবিক জ্ঞান অপরিহার্য— এই উপলব্ধি আমাদের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে এখনো যথেষ্ট দৃঢ় হয়নি।তবে এ বছর জিপিএ-৫ কমে যাওয়া নেতিবাচক ইঙ্গিত নয় যদি এটি কঠোর ও ন্যায়সংগত মূল্যায়নের ফল হয়। কিন্তু যদি তা শিক্ষার্থীদের মানসিক চাপ, অনুপ্রেরণার অভাব বা কোচিং নির্ভরতার কারণে ঘটে থাকে, তবে এটি উদ্বেগের বিষয়।তিনি বলেন, শিক্ষা প্রশাসনকে এখনই গবেষণাভিত্তিক বিশ্লেষণ করতে হবে— কেন এই পতন ঘটছে, কোন বিষয় বা অঞ্চলে বেশি প্রভাব পড়েছে এবং কীভাবে শেখার ঘাটতি পূরণ করা যায়। সবচেয়ে বড় কথা, আমাদের শিক্ষার লক্ষ্য হওয়া উচিত ‘শিক্ষিত মানুষ তৈরি করা’, কেবল জিপিএ-৫ অর্জন নয়। শেখার আনন্দ, যুক্তিবোধ এবং বাস্তবজীবনের দক্ষতা যদি শিক্ষার্থীরা অর্জন করতে না পারে, তবে শত জিপিএ-৫ ও শিক্ষার সাফল্যের মানদণ্ড হতে পারে না।

পরিবর্তন টেকসই করতে হলে নীতিনির্ধারকদের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নিতে হবে
গ্রিন ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. খাজা ইফতেখার উদ্দিন আহমেদ বলেন, গত পাঁচ বছরের পরিসংখ্যান বলছে, এ বছর জিপিএ-৫ প্রাপ্তিতে বড় ধস নেমেছে—যা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার গুণগত সংকটকে প্রকটভাবে সামনে নিয়ে এসেছে। শিক্ষা মাত্র পরীক্ষার ফল নয়, এটি সমাজের মান ও প্রস্তুতির প্রতিফলন। কিন্তু আমরা দেখছি, শিক্ষার্থীদের মৌলিক দক্ষতা বিকাশের জায়গায় কেবল নম্বরমুখী প্রতিযোগিতা জেঁকে বসেছে। এই ধারায় পড়াশোনা করলে পরীক্ষার কাঠামো একটু কঠিন হলেই ফলাফল নেমে আসে। সহজে পাশের দিন বা জিপিএ-৫ প্রাপ্তির প্রথা শেষ করতে হবে। এ ফলাফলের মধ্যে দিয়ে সেই যাত্রা শুরু হোক।

অনলাইন শিক্ষার প্রভাব, কোচিং নির্ভরতা, পরীক্ষাভীতি এবং মুখস্তনির্ভর পাঠ্যপুস্তক সংস্কৃতি— সব মিলিয়ে শিক্ষার্থীরা বিশ্লেষণধর্মী প্রশ্নে দুর্বল। তাই এবারের কঠোর মূল্যায়ন বা সামান্য মান পরিবর্তনেই তারা জিপিএ-৫ ধরে রাখতে পারেনি। আরেকটি বড় বিষয় হচ্ছে, শহর-গ্রামের শিক্ষার বৈষম্য। গ্রামীণ শিক্ষার্থীরা প্রযুক্তি, শিক্ষক ও মানসম্মত গাইডলাইনের অভাবে পিছিয়ে পড়ছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় যদি এখনই পাঠদানের পদ্ধতি ও মূল্যায়ন কাঠামোয় কাঠামোগত সংস্কার না আনে, তাহলে পরবর্তী বছরগুলোতে এই নিম্নগতি আরও গভীর হবে। জিপিএ-৫ সংখ্যা কমেছে— এটা হয়ত ভালো দিকও হতে পারে যদি এর মাধ্যমে প্রকৃত মূল্যায়নের সংস্কৃতি শুরু হয়। কিন্তু এই পরিবর্তন টেকসই করতে হলে নীতিনির্ধারকদের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নিতে হবে।

মূল্যায়ন প্রক্রিয়া তুলনামূলক কঠোর ও বাস্তবমুখী হয়েছে
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ২০২৫ সালের এইচএসসি ফলাফল আমাদের শিক্ষা প্রশাসনের জন্য এক ধরনের সতর্কবার্তা। জিপিএ-৫ এর সংখ্যা কমে যাওয়া মানেই যে শিক্ষার্থীরা কম পড়েছে, তা নয়— বরং এটি ইঙ্গিত দেয় যে মূল্যায়ন প্রক্রিয়া তুলনামূলক কঠোর ও বাস্তবমুখী হয়েছে। তবে এই পরিবর্তন কতটা পরিকল্পিত, সেটিই এখন প্রশ্ন। কারণ, গত কয়েক বছরে প্রশ্নপত্র প্রণয়ন, পরীক্ষার সময়সূচি, মূল্যায়নের ধরন ও নম্বর বণ্টনে ঘনঘন পরিবর্তন আনা হয়েছে, যা শিক্ষার্থীদের মানসিক প্রস্তুতিকে প্রভাবিত করেছে।তিনি বলেন, বিশেষ করে মানবিক বিভাগে ফলাফল নিম্নমুখী হওয়া আমাদের সামাজিক বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি। আমরা এখনো বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নির্ভর শিক্ষাকে প্রাধান্য দিচ্ছি, কিন্তু ভাষা, সাহিত্য, দর্শন, সমাজবিজ্ঞান— এই মানবিক শাখাগুলোকে গুরুত্বহীন করে ফেলছি। এর ফলে শিক্ষার ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে এবং আগামী দিনে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরিতে ঘাটতি দেখা দিতে পারে।মাদ্রাসা ও কারিগরি বোর্ডের ফলাফলেও একই সংকট প্রতিফলিত হচ্ছে। এসব ধারার শিক্ষার্থীরা রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ ও মনোযোগ থেকে দীর্ঘদিনই বঞ্চিত। এখন সময় এসেছে এই দুই ধারাকে মূলধারার শিক্ষার সমান মর্যাদায় আনা, যাতে তারা শুধু পরীক্ষায় নয়, কর্মক্ষেত্রেও প্রতিযোগিতা করতে পারে। ফলাফলের এই ‘ধস’ আসলে শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কারের আহ্বান— এটি অবহেলা করলে আমরা ভবিষ্যতে আরও বড় শিক্ষা সংকটে পড়ব।

শিক্ষার্থীরা মূলত পরীক্ষার মেশিনে পরিণত হচ্ছে : রাশেদা রওনক
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক শিক্ষাবিদ ড. রাশেদা রওনক খান বলেন, জিপিএ-৫ প্রাপ্তির হার কমে যাওয়া নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার আগে আমাদের বুঝতে হবে— শিক্ষা পদ্ধতি যান্ত্রিক হয়ে পড়েছে। শিক্ষার্থীরা মূলত পরীক্ষার মেশিনে পরিণত হচ্ছে, যেখানে সৃজনশীল চিন্তা বা সমালোচনামূলক বিশ্লেষণের জায়গা খুব কম। এবারের ফলাফল সেই বাস্তবতাকেই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে।তিনি বলেন, গত কয়েক বছর ধরে শিক্ষা ব্যবস্থায় পরীক্ষানির্ভরতা ও কোচিং সংস্কৃতি এতটা গভীরভাবে ঢুকে গেছে যে শিক্ষার্থীরা বই পড়ে ভাবতে শেখে না, বরং ‘প্রস্তুত উত্তর’ মুখস্ত করে। যখন প্রশ্নের ধরন বদলায় বা মূল্যায়ন কঠোর হয়, তখন তাদের ভরসা ভেঙে পড়ে— যা এবারের ফলাফলে স্পষ্ট। অন্যদিকে মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টিও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যেও এখন উদ্বেগ ও আত্মবিশ্বাসহীনতা দেখা যাচ্ছে, যার শিকড় মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরে। প্রতিযোগিতার চাপে তারা মানবিক বিকাশের জায়গা হারাচ্ছে। তাই শুধু পরীক্ষার ফল দেখে শিক্ষা ব্যবস্থার মান নির্ধারণ করা উচিত নয়।এই শিক্ষাবিদ বলেন, এখন প্রয়োজন পরীক্ষার কাঠামোতে বৈচিত্র্য আনা, বিশ্লেষণধর্মী প্রশ্নের পরিমাণ বাড়ানো এবং শিক্ষক প্রশিক্ষণে নতুন বিনিয়োগ। একইসঙ্গে শিক্ষা প্রশাসনকে শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের দিকেও নজর দিতে হবে— নইলে পরিসংখ্যানগত পতনের চেয়ে মানবিক সংকট আরও ভয়াবহ আকার নেবে।

Top