‘গরিবের ট্রেন’ হিসাবে পরিচিত এসব বাহনে যেন গরিবি-দশা
মোহাম্মাদ মুরাদ হোসেন: গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙা রাখতে এগুলোর রয়েছে ভালো ভূমিকা। সার্ভিসও লাভজনক। কিন্তু ‘গরিবের ট্রেন’ হিসাবে পরিচিত এসব বাহনে যেন গরিবি-দশা। লোকাল ও মেইল ৭০টি ট্রেন বন্ধ হয়ে আছে বছরের পর বছর। চালুর কোনো উদ্যোগই নেই। আর যে কটি চলছে, সেগুলোও চরম দুর্দশাগ্রস্ত।লোকাল ও মেইল ট্রেন গ্রাম ও শহরতলির লাইফলাইন। সাধারণ মানুষের রুজি-রুটির অবলম্বন। স্বল্প দূরত্বে চলা এসব ট্রেন খুবই জনপ্রিয়।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত ১৫ বছর মন্ত্রী, এমপিদের আবদার ও রাজনৈতিক কারণে নতুন নতুন আন্তঃনগর ট্রেন উদ্বোধন করা হয়। বন্ধ ট্রেন চালু না করে পরিকল্পনাহীন নতুন ট্রেন চালুতে ব্যস্ত ছিলেন তখনকার রেলপথমন্ত্রী ও সচিবরা। আওয়ামী লীগ সরকার ৬৬টি নতুন আন্তঃনগর ট্রেন চালু করে। অপরদিকে খুবই জনপ্রিয় প্রায় মেইল ও লোকাল ট্রেন একের পর এক বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। যদিও আন্দোলনের মুখে পরে কয়েকটি চালু করা হয়।
২০১০ সালে দেশে লোকাল ও মেইল ট্রেন চলত ১১৫টি। ওই সময় আন্তঃনগর ট্রেন ছিল ৭৭টি। বর্তমানে আন্তঃনগর চালু রয়েছে ১১১টি। যেখানে আন্তঃনগর ট্রেন বেড়েছে ৩৪টি, সেখানে লোকাল ও মেইল বন্ধ হয়ে যায় দুই-তৃতীয়াংশের বেশি। তবে যাত্রী ও স্থানীয় বাসিন্দাদের চাপ, প্রতিবাদ-বিক্ষোভ ইত্যাদির মুখে এর কিছু চালু করা হয়। সব মিলিয়ে এখন ৪৫টি লোকাল ও মেইল ট্রেন চালু রয়েছে। আবার নানা অজুহাতে এর কয়েকটি মাঝেমধ্যেই থাকছে বন্ধ। চলন্ত অবস্থায় অকেজো হয়ে পড়ছে কতগুলো। এতে সাধারণ যাত্রীদের নিদারুণ দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।
মেইল-লোকাল ট্রেন বন্ধে কাজ হারিয়েছেন অজস্র হকার, প্ল্যাটফর্মের দোকানদার, খুদে ব্যবসায়ী, দিনমজুর থেকে শুরু করে বিভিন্ন বাড়িতে যারা পরিচারিকার কাজ করেন, যারা দূর থেকে শহরে আসেন কোনো কাজে-তাদের কর্মেও টান পড়ছে। এক-দেড় ঘণ্টার ট্রেনযাত্রার পথ বাসে বা অন্য যানবাহনে যেতে তিন-চার ঘণ্টা লাগছে, সেই সঙ্গে লাগছে তিন-চারগুণ ভাড়াও-সামান্য মাইনের বেসরকারি কর্মচারী, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, কৃষক-দিনমজুরদের পক্ষে যা প্রায় অসম্ভব ঠেকছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. ফাহিমুল ইসলাম বলেন, স্বল্প দূরত্বে যাত্রী চলাচলের জন্য মেইল ও লোকাল ট্রেনের চাহিদা সব সময়ই রয়েছে। রেলে আয় ও সেবা বাড়াতে পর্যাপ্ত লোকাল ও মেইল ট্রেন চালু জরুরি। আমরা চেষ্টা করছি শুধু বন্ধ ট্রেন চালু নয়, নতুন করে মেইল ও লোকাল ট্রেনও চালু করতে। চাহিদা অনুযায়ী ইঞ্জিন-কোচ ও অন্যান্য সামগ্রী কেনা হচ্ছে। এর সঙ্গে চালক নিশ্চিত হলে ক্রমান্বয়ে বন্ধ থাকা ট্রেনগুলো চালু করা যাবে।
রেলওয়ে অপারেশন দপ্তর বলছে, জ্বালানি খরচ, লোকবল ও অন্যান্য খরচ বিবেচনায় আন্তঃনগর ট্রেন চালিয়ে লোকসান গুনতে হচ্ছে। এসব ট্রেনে গড়ে ৮৭ শতাংশের কম টিকিট বিক্রি হচ্ছে। তারপরও সংশ্লিষ্টরা এর ইঞ্জিন-কোচ সংগ্রহের দৌড়ে ব্যস্ত। অথচ লোকাল ও মেইল ট্রেন সবই লাভজনক। এসব ট্রেনে খরচ ও লোকবল কম লাগে।
হবিগঞ্জ-আখাউড়া-আশুগঞ্জ রুটে চলত বাল্লা ট্রেন। স্থানীয়রা জানান, এ ট্রেনটি যেমন ঐতিহ্য ছিল, তেমনই যাত্রী চাহিদার দিক থেকেও ছিল সেরা। ট্রেনটি বন্ধ রয়েছে ২০ বছর ধরে। ওই ট্রেনের যাত্রী আমিনুল ইসলাম জানান, ওই রুটসহ কুমিল্লা পর্যন্ত অন্তত ১১টি ট্রেন বন্ধ রয়েছে। সবাই তো আর ঢাকা শহরে বাস করে না। তাহলে গ্রাম ও শহরতলির হাজার হাজার মানুষ কোন পরিবহণব্যবস্থায় কর্মক্ষেত্রে পৌঁছাবেন?
চিলাহাটি-খুলনা রুটে রকেট মেইল ছিল উত্তর ও দক্ষিণবঙ্গের নিম্ন-আয়ের মানুষ ও ছোট ব্যবসায়ীদের সবচেয়ে প্রিয় বাহন। মাঝে বেশ কিছুদিন বন্ধ থাকার পর এখন এটি সংক্ষিপ্ত রুটে চলছে। সান্তাহার-পঞ্চগড় রুটের উত্তরবঙ্গ মেইল বন্ধ ৬ বছর ধরে। স্থানীয় বাসিন্দাদের ভাষ্য, উত্তরবঙ্গ মেইল ট্রেনটি নিম্ন-আয় ও শ্রমজীবী মানুষের অল্প খরচে যাতায়াতের একমাত্র যানবাহন ছিল। পূর্বাঞ্চলের ময়মনসিংহ-দেওয়ানগঞ্জ বাজার রুটের দুটি লোকাল, ময়মনসিংহ-ভৈরববাজার রুটের চারটি লোকাল, সিলেট-ছাতকবাজার রুটের চারটি লোকাল, আখাউড়া-সিলেট রুটের দুটি মেইল, লাকসাম-চঁদপুর রুটের দুটি কমিউটার, লাকসাম-নোয়াখালী রুটের দুটি কমিউটার, চট্টগ্রাম-নাজিরহাট রুটের ছয়টি কমিউটার, চট্টগ্রাম-চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় রুটের চারটি কমিউটার, ঢাকা-হাইটেক সিটি রুটের দুটি কমিউটার ও ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটের চারটি কমিউটার ট্রেন বন্ধ রয়েছে। অথচ এসব ট্রেন ওইসব সেকশনের গুরুত্বপূর্ণ লোকাল ট্রেন ছিল।
একইভাবে গোয়ালন্দ-ঈশ্বরদী ও ঈশ্বরদী-রাজবাড়ী রুটে একটি করে মিশ্র ট্রেন, রাজবাড়ী-গোয়ালন্দঘাট রুটে একটি লোকাল, ঈশ্বরদী-পার্বতীপুর রুটে দুটি লোকাল, পার্বতীপুর-চিলাহাটি রুটে দুটি মিশ্র, রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জ রুটে দুটি শাটল, রাজবাড়ী-ভাঙ্গা রুটে দুটি কমিউটার, ঢাকা-ভাঙ্গা রুটে দুটি কমিউটার, সান্তাহার-পঞ্চগড় রুটে দুটি মেইল, পার্বতীপুর-লালমনিরহাট রুটে দুটি কমিউটার, পার্বতীপুর-পঞ্চগড় রুটে দুটি কমিউটার, লালমনিরহাট-পার্বতীপুর রুটে দুটি কমিউটার, রংপুর-লালমনিরহাট রুটে একটি কমিউটার, কাউনিয়া-রমনাবাজার রুটে একটি কমিউটার এবং রমনাবাজার-রংপুর রুটে একটি কমিউটার ট্রেন বন্ধ রয়েছে। এর বাইরে লালমনিরহাট-পার্বতীপুর রুটে দুটি করে লোকাল ও মিশ্র ট্রেন, পার্বতীপুর-পঞ্চগড় রুটে দুটি করে লোকাল ও মিশ্র ট্রেন, লালমনিরহাট-বুড়িমারী রুটে দুটি করে লোকাল ও মিশ্র ট্রেন এবং সান্তাহার-লালমনিরহাট রুটে দুটি লোকাল ট্রেন বন্ধ রয়েছে।
রেলওয়ে অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন) মো. নাজমুল হোসেন বলেন, রেলে বর্তমানে ইঞ্জিন ও চালকস্বল্পতা চরমে। এ কারণে ৭০টি লোকাল ট্রেন বন্ধ আছে। এর মধ্যে পূর্বাঞ্চলে ২৮টি এবং পশ্চিমাঞ্চলে ৪২টি। এগুলো শিগ্গিরই চালু করার সম্ভাবনা কম।
পূর্বাঞ্চল রেলওয়ের চিফ অপারেটিং সুপারিনটেনডেন্ট মো. সফিকুর রহমান জানান, এ অঞ্চলে মেইল ও লোকাল ট্রেনের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। বন্ধ থাকা ট্রেনগুলো চালু করতে পারলে আয়ের সঙ্গে সেবাও বৃদ্ধি পেত। কিন্তু রোলিংস্টক স্বল্পতায় ট্রেনগুলো চালু করা সম্ভব হচ্ছে না। পশ্চিমাঞ্চল রেলের প্রধান বাণিজ্যিক কর্মকর্তা সুজিত কুমার বিশ্বাস বলেন, পশ্চিমাঞ্চলে ৪২টি ট্রেন বন্ধ রয়েছে। এসব ট্রেন খুবই জনপ্রিয় ছিল। একেকটি ট্রেনের সঙ্গে নানান ঐতিহ্য জড়িয়ে রয়েছে। নতুন ইঞ্জিন-কোচ ও চালক পাওয়া গেলে বন্ধ ট্রেন চালু সম্ভব হবে।
রেলওয়ে পরিকল্পনা দপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, বন্ধ ট্রেন চালুর বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের কোনো তাড়া নেই। ঢাকা-যশোর, দোহাজারি-কক্সবাজারসহ ৪টি নতুন রেলপথে অর্ধশত ট্রেন চলাচলের কথা থাকলেও গড়ে মাত্র ৯টি ট্রেন চলছে। এসব রুটে নতুন লোকাল ও মেইল ট্রেন চালু করা হলে রেলের আয় বাড়ত।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. এম সামছুল হক বলেন, রেলে লোকসান বাড়ছে। কিন্তু আয় বাড়াতে কোনো উদ্যোগই নেই। বন্ধ ট্রেনগুলো চালু করলে আয়ের সঙ্গে সাধারণ যাত্রীদের সেবা ও নিরাপত্তাও নিশ্চিত হতো। ট্রেন নিরাপদ ও সাশ্রয়ী বাহন; কিন্তু সেই বাহনে সাধারণ মানুষ চলতে পারছে না। রাজনৈতিক কারণে নতুন রেলপথ, ট্রেন উদ্বোধন সাধারণ মানুষের কাজে আসছে না।