৭১’র চেতনা ফেরি করে রাজনীতি আর চলবে না,২৪’ কে ধারণ করতে হবে - Alokitobarta
আজ : বুধবার, ১৭ই সেপ্টেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ২রা আশ্বিন, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

৭১’র চেতনা ফেরি করে রাজনীতি আর চলবে না,২৪’ কে ধারণ করতে হবে


মোহাম্মাদ মুরাদ হোসেন: একাত্তরের চেতনা ফেরি করে রাজনীতি করা বাংলাদেশের মানুষ এখন আর পছন্দ করে না। মর্যাদাবান ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে সামনে এগিয়ে যেতে ২৪’এর অনুভূতি ধারণ করতে হবে। বিশ্লেষকরা বলছেন, খুনি হাসিনা যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ব্যবসা করে জাতিকে দ্বিধাবিভক্ত করে ফ্যাসিস্ট হয়ে উঠেছিলেন- তার চিরস্থায়ী অবসান চায় মানুষ। ২৪’র নজিরবিহীন গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী মানুষ চায় ফ্যাসিবাদ, ভারতীয় আধিপত্যবাদ, ভারতীয় হেজিমনি ও পুরনো রাজনৈতিক বন্দোবস্তের পুরোপুরি মূলোৎপাটন।

সম্প্রতি ফের আশঙ্কাজনকভাবে তৎপর হয়ে উঠেছে তথাকথিত প্রগতিশীল সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবীরা। আওয়ামী ফ্যাসিবাদের সহযোগী জনবিচ্ছিন্ন কয়েকটি রাজনৈতিক দলকেও এই তৎপরতায় যোগ দিতে দেখা যাচ্ছে। মূলত এদের নিরন্তর তোষামোদি শেখ হাসিনাকে ফ্যাসিস্ট হয়ে উঠতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। হাসিনার শাসন-শোষণকে তরা উৎসাহ দিয়েছেন। তারা আবারও ভারতীয় বয়ান ও একাত্তরের চেতনা বিক্রি করে ঘৃণিত আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনে সক্রিয় হয়ে উঠেছে। এতে ব্যাপক ক্ষোভ দেখা দিয়েছে সামাজিক মাধ্যমে।

পতিত স্বৈরাচারের একের পর এক ষড়যন্ত্র যখন ব্যর্থ হয়েছে, তখন প্রিন্ট মিডিয়া, টেলিভিশন চ্যানেল ও অন্যান্য গণমাধ্যমে ঘাপটি মেরে থাকা হাসিনার দোসর সাংবাদিকরা রং বদলে গণমাধ্যমে বহাল তবিয়তে রয়েছে। অনেকে গুহা থেকে মুখ বের করা শুরু করেছে। তারা এখন অন্তর্বর্তী সরকারের ভুল-ত্রুটি নিয়ে সমালোচনায় মেতে উঠেছে। যেকোনো ইস্যুতে সরকারের সমালোচনা করে ইংরেজি-বাংলায় ঢাউস সাইজের কলাম, প্রতিবেদন ইত্যাদি প্রকাশ করছে। বক্তব্য-বিবৃতিতে ফের একাত্তরের চেতনা হাজির করে ২৪’এর অভ্যুত্থানকে খাটো করার চেষ্টায় লিপ্ত হয়েছে, যা ক্ষুব্ধ করেছে সচেতন মহলকে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজনীতিতে অতীতকে আঁকড়ে না থেকে বর্তমান ও ভবিষ্যৎকে গুরুত্ব দিতে হবে। দীর্ঘ প্রায় ১৬ বছর ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ চেতনা ও বিভাজনকে যেভাবে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে, নতুন বাংলাদেশের মানুষ আর তা কখনও গ্রহণ করবে না। তারা মনে করেন, বারবার একাত্তরের চেতনার কথা বলে জনগনের বর্তমান সমস্যা যেমন—অর্থনৈতিক সংকট, বেকারত্ব, দুর্নীতি ইত্যাদি থেকে মনোযোগ সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। বিরোধী মতকে নিষ্ঠুরভাবে দমন করা হয়েছে।

মুক্তিযুদ্ধের একচ্ছত্র মালিক বনে যাওয়া এবং চেতনা বাণিজ্য যে দেশের মানুষ পছন্দ করে না, তা দেশের মানুষ শেখ মুজিব ও তার মেয়ে শেখ হাসিনার পতন ঘটিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছে। এখনও এই চেতনা ব্যবসাকে যেসব সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবী আঁকড়ে ধরে আছেন, তারা তা থেকে শিক্ষা নেননি বলে প্রতীয়মান হচ্ছে।

স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ সৃষ্টি করে ঔপনিবেশিক ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ নীতির মাধ্যমে দেশকে বিভাজিত করে দীর্ঘ দেড় দশকের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশকে লুটেপুটে খেয়েছে গণহত্যাকারী আওয়ামী লীগ। ভোটাধিকার হরণ করে ভারতের সমর্থনে ক্ষমতায় থাকতে গিয়ে এদেশকে কার্যত দেশটির অঙ্গরাজ্যে পরিণত করে। গুম-খুন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, লুটপাট, দুর্নীতি-দুঃশাসনের মাধ্যমে চরমভাবে বিষিয়ে তোলে সাধারণ জনগণকে। ভারতীয় হেজিমনি প্রতিষ্ঠায় একমাত্র এজেন্ডা হয়ে ওঠে খুনি হাসিনা ও তার দোসরদের। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথিত সৌল এজেন্ট হাসিনা সাত খুন করলেও তা মাফ করে দেয়া যায়- এমন দায়মুক্তির পরিবেশ তৈরি করা হয় তার দীর্ঘ শাসনামলে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, গত এক বছরে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা, তার প্রভু মোদি এবং তাদের এদেশীয় দোসররা নানাভাবে সরকার ফেলে দেয়ার ষড়যন্ত্র করে ব্যর্থ হয়েছে। তাই এবার পুরনো চেতনা ব্যবসা চালু করার চেষ্টা করছে। কিন্তু মানুষ কখনও আর তা গ্রহণ করবে না। যার বিরুদ্ধে ২৪ এর গণঅভ্যুত্থান হয়েছে মানুষ এখন তার বাস্তবায়ন চায়। যারা মনে করছেন ৭১ দিয়ে ২৪ ভুলিয়ে দেওয়া যাবে তারা বোকার স্বর্গে বাস করছে, ভারতের এজেন্ডা বাস্তবায়নে কাজ করছে।

মানুষের এখন দাবি, সবার আগে আওয়ামী ফ্যাসিবাদের পুরোপুরি মূলোৎপাটন করতে হবে, ১৬ বছরের গুম-খুন ও ২৪ এর গণহত্যার বিচার করতে হবে, দুর্নীতি ও পাচার হওয়া অর্থ উদ্ধার করতে হবে। ১৬ বছরে যারা হাসিনার অপশাসনের ভুক্তোভুগী হয়েছে তারা জ্বলন্ত বিভীষিকাময় স্মৃতি ও ক্ষত বহন করে বেড়াচ্ছে। এমন লাখ লাখ মানুষকে ৭১ এর চেতনা দিয়ে ভুলিয়ে রাখা সম্ভব নয়। এতে আরও ক্ষোভ বাড়বে।

নেটিজেনরা বলছেন, হাসিনাকে দিয়ে ভারত দেশকে তার অঙ্গরাজ্যে পরিণত করলেও কখিত সুশীলরা তার কোনো প্রতিবাদ করেননি।বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীসহ সাধারণ মানুষের ওপর হাসিনার দমন-পীড়ন, খুন, গুম, জেল-জুলুম, মানবাধিকার ও বাকস্বাধীনতা হরণের বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো প্রতিবাদ করেনি।এখন তারা পরোক্ষভাবে নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিক্রির পক্ষে কথা বলছে। ইনিয়ে বিনিয়ে ‘আগেই ভালো ছিলাম’ এই বয়ান সামনে এনে বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে লিখছেন, কথা বলছেন। অন্তর্বর্তী সরকারকে এদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।

২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থান বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ইতিহাসে একটি নতুন অধ্যায়। এটি মূলত কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে শুরু হয়ে একটি বৃহত্তর গণদাবিতে পরিণত হয়। এই আন্দোলনের মূল চেতনা ছিল বৈষম্য দূরীকরণ, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা এবং একটি স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক শাসন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা।

পর্যবেক্ষকদের মতে, চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চেতনার স্বীকৃতি। এর মাধ্যমে শেখ হাসিনার মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ব্যবসার চূড়ান্ত পতন ঘটেছে। শুধু হাসিনারই পতন নয়, তার প্রভু ভারতেরও পতন হয়েছে। দেশের মানুষ বুঝিয়ে দিয়েছে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ব্যবসা আর চলবে না। তারা মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ধারণ করেই এগিয়ে যেতে চায়।

বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দিচ্ছেন, রাজনৈতিক দলগুলোকে একাত্তরের গৌরবময় ইতিহাসকে সম্মান জানানোর পাশাপাশি বর্তমানের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় নতুন ও কার্যকর নীতি নিয়ে আসতে হবে। রাজনীতিকে কেবল অতীতের ওপর ভিত্তি করে নয়, বরং বর্তমানের সমস্যাগুলোর সমাধান এবং ভবিষ্যতের জন্য একটি সুস্পষ্ট রূপরেখা তৈরি করতে হবে। সময়ের সাথে সাথে জনগনের প্রত্যাশা পরিবর্তিত হয় এবং সেই অনুযায়ী রাজনীতিকেও নতুন পথে চালিত করা উচিত।

এই গণঅভ্যুত্থান প্রমাণ করেছে, দেশের তরুণ সমাজ অন্যায় ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার। তারা শুধু অতীতের গৌরব নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে চায় না, বরং বর্তমানের সমস্যাগুলোর সমাধান চায়। এই আন্দোলনের চেতনা হলো পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা, যেখানে নাগরিকরা নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন এবং যেকোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে প্রস্তুত।

জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম শুক্রবার (৮ আগস্ট) সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে এক পোস্টে বলেছেন, ২৪-পরবর্তী সময়ে জন্ম নেওয়া নতুন প্রজন্ম ও নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতি পুরোনো ‘একাত্তরের পক্ষে বা বিপক্ষে’ বিভাজন অতিক্রম করেছে। ৭১ রাষ্ট্রের ভিত্তি ও শ্রদ্ধার নীতি হিসেবে ইতিহাসে থাকবে, কিন্তু রাজনৈতিক বৈধতার একমাত্র মানদণ্ড আর হবে না। এখন রাজনীতি হতে হবে ’২৪-এর মূল্যবোধের ভিত্তিতে।

তিনি আরও লিখেন, ‘আমরা আগেও বলেছি— ’২৪ হলো ’৭১-এর ধারাবাহিকতা। ১৯৭১ সালের সমতা, মর্যাদা ও ন্যায়বিচারের আকাঙ্ক্ষা ২০২৪ সালের অভ্যুত্থানের মাধ্যমে নতুনভাবে নিশ্চিত হয়েছে।মুজিববাদ ’৭১-কে ভারতীয় ন্যারেটিভে অন্তর্ভুক্ত করে জাতীয় সার্বভৌমত্ব বিসর্জনের চেষ্টা করেছিল, কিন্তু ’২৪ সেই স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চেতনাকে পুনরুদ্ধার করেছে।’

উল্লেখ করা প্রয়োজন, মুক্তিযুদ্ধ যে, কোনো দল বা পরিবারের একক যুদ্ধ ছিল না, ছিল দেশের সব শ্রেণীপেশা মানুষের এক জনযুদ্ধ, এ সত্যটি হাসিনা মেনে না নিয়ে মুক্তিযুদ্ধকে তার বাবার সম্পদ হিসেবে কুক্ষিগত করতে চেষ্টা করেছেন।কারণে-অকারণে ভারতের সহাযোগিতায় গদগদ হয়েছেন। যুক্তিযুদ্ধ নিয়ে হাসিনার চেতনা ব্যবসা ও ভারতের প্রভুত্বকে দেশের মানুষ মেনে নিতে পারেনি। দেশের স্বাধীনাত-সার্বভৌমত্বকে বিকিয়ে দেয়া নিয়ে হাসিনার ওপর তারা চরম ক্ষুব্ধ ছিল। তাদের এই ক্ষুব্ধতার বিস্ফোরণ ঘটে চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানে। শেষ পর্যন্ত তাকে জীবন নিয়ে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নিতে হয়েছে।

Top