ফের পদোন্নতি পাচ্ছেন আ’লীগের আমলারা,প্রশাসনে তিন স্তরের পদোন্নতি তালিকা প্রস্তুতি
মোহাম্মাদ আবুবকর সিদ্দীক ভুঁইয়া : সচিব পদে শূন্য থাকা মন্ত্রণালয় ও বিভাগে পদায়নের গতি ফিরছে না জনপ্রশাসনে। মন্ত্রণালয় ও বিভাগ এবং অধিদপ্তরগুলোতে সচিব ও ডিজি পদের কর্মকর্তার পদ শূন্য রয়েছে। এর মধ্যে দুর্নীতি দমন কমিশনের সচিব, বাংলাদেশ কর্মচারী কল্যাণ বোর্ডের মহাপরিচালক (সচিব), জাতীয় পরিকল্পনা ও উন্নয়ন একাডেমির মহাপরিচালক (সচিব), ভূমি আপিল বোর্ডের চেয়ারম্যান (সচিব), জাতীয় উন্নয়ন প্রশাসন একাডেমির রেক্টর (সচিব), বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশনের চেয়ারম্যান (গ্রেড-১) সচিব পদ শূন্য রয়েছে। এসব সচিব পদে আবারো স্বৈরাচার শেখ হাসিনার দোসর ও ফ্যাসিস্ট আমলাদের পদোন্নতি দেয়ার প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। সুবিধাভোগীদের প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়ন, বঞ্চিত কর্মকর্তাদের কম গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়ন, দরকারি ক্ষেত্রে বঞ্চিতদের উপেক্ষা, চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ, কর্মরত কর্মকর্তাদের সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখা, চেয়ার হারোনোর ভয়ে তটস্থ থাকাসহ নানা কারণে এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। ইতোমধ্যে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নিয়োগ,পদোন্নতি ও প্রেষণ অনুবিভাগ থেকে বিএনপি-জামায়াতপন্থী বেশ কয়েকজন কর্মকর্তাকে সরিয়ে ছাত্রলীগের নেতাদের পদায়ন করেছে জনপ্রশাসন।
এবারো বঞ্চিতদের সচিব পদে নিয়োগ দেয়া হচ্ছে না। প্রশাসনে তিন স্তরে অতিরিক্ত সচিব থেকে সচিব পদে নিয়োগ, যুগ্মসচিব থেকে অতিরিক্ত সচিব পদোন্নতির প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যে ১৭ ও ১৮ ব্যাচের এবং ২০ ব্যাচের কর্মকর্তাদের চাকরিজীবনের যাবতীয় তথ্য যাচাই-বাছাই ও বিশ্লেষণ করছে পদোন্নতির সুপারিশকারী কর্তৃপক্ষ সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ড (এসএসবি) সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। আরো হতে পারে। আবার উপদেষ্টা পরিষদের সভায় ১০ থেকে ১২ জন নতুন সচিব নিয়োগ দেয়ার সুপারিশ প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে সার-সংক্ষেপ পাঠানো হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা অনুমোদন দিলেই চলতি সপ্তাহে নতুন সচিব পদে নিয়োগ দেয়া হতে পারে বলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্রে এ তথ্য নিশ্চিত করেছে। জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সুপারিশ দ্রুত বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের ১৮টি সংস্কার প্রস্তাব আশু বাস্তবায়নযোগ্য হিসেবে বাছাই করা হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে বলা হয়, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের ১৮টি সংস্কার প্রস্তাব আশু বাস্তবায়নযোগ্য হিসেবে বাছাই করা হয়েছে। এতে বলা হয় ১৬ জুন প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন প্রস্তাবিত আশু বাস্তবায়নযোগ্য সুপারিশগুলো দ্রুত বাস্তবায়নের লক্ষ্যে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টার মুখ্য সচিব এম সিরাজ উদ্দিন মিয়া সভায় সভাপতিত্ব করেন। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রশাসনের শীর্ষ পর্যায়ে বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে জনপ্রশাসন নিয়োগ,পদোন্নতি ও প্রেষণ (এপিডি) শাখার এক কর্মকর্তা বলেন, সচিবের শূন্য পদ পূরণে সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এসএসবির সভা করা হচ্ছে। আশা করি কাজগুলো দ্রুত শেষ করতে পারব।
প্রশাসনে বিতর্কিত- চুক্তিভিত্তিক নিয়োজিত কর্মকর্তাদের চুক্তি বাতিল ও স্বৈরাচারের দোসর কর্মকর্তাদের অপসারণ করা হচ্ছে না। এবার প্রশাসনে চুক্তিভিত্তিক নিয়োজিত চুক্তি বাতিল ও স্বৈরাচারের দোসর কর্মকর্তাদের অপসারণের দাবিতে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ঘেরাও এবং এসব কর্মকর্তাদের পদত্যাগের দাবিতে লিখিত আবেদন দিয়েছে বৈষম্যবিরোধী কর্মচারী ঐক্য ফোরাম। তারা বলেছে বিগত পতিত আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা অবৈধভাবে টিকে রাখতে প্রশাসনের শীর্ষ ও গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোয় দলবাজ কর্মকর্তাদের বারবার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিয়েছিলো। এসব নিয়োগে কর্মকর্তাদের যোগ্যতা বা মেধা-দক্ষতার চেয়ে দলীয় আনুগত্য এবং দুর্নীতি-অনিয়মের পারদর্শিতাকেই বিবেচনায় নিয়ে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। অনৈতিক লেনদেনের মাধ্যমে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাগিয়ে নেওয়ার নজিরও রয়েছে ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে। আমরা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে কাছে মেধা ও যোগ্য কর্মকর্তাদের সচিব পদে নিয়োগ চাই। অপরদিকে প্রশাসনে গণহত্যা ও ফ্যাসিবাদ কায়েমের সহযোগী ৪৪ জন আমলার অপসারণের দাবিতে রাজধানীতে পোস্টারিং করা হয়েছে। বেঁধে দেওয়া সময় পেরিয়ে গেলেও বিভিন্ন মন্ত্রণালয়সহ সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে কর্মরত স্বৈরাচার শেখ হাসিনার দোসর আমলাকে অপসারণ করার পোস্টার সাঁটানো হয়েছে। ‘জুলাই মঞ্চ’-এর ব্যানারে এসব পোস্টারিং করা হয়েছে। ৪৪ জন আমলার মধ্যে গতকাল ৭ জন সচিবকে অবসরে পাঠানো হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার ও গতকাল পর্যন্ত জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে বিভিন্ন দপ্তরে কর্মরত ৭জন সচিব বা সমপদমর্যাদার এবং একজন গ্রেড-১ কর্মকর্তাকে অবসর দেয়া হয়েছে। অবসরে পাঠানো কর্মকর্তারা হলেন, গতকাল মঙ্গলবার দুনীতি দমন কমিশনের সচিব খোরশেদা ইয়াসমীন, বাংলাদেশ কর্মচারী কল্যাণ বোর্ডের মহাপরিচালক (সচিব) কাজী এনামুল হাসান, জাতীয় পরিকল্পনা ও উন্নয়ন একাডেমির মহাপরিচালক (সচিব) সুকেশ কুমার সরকার, ভূমি আপিল বোর্ডের চেয়ারম্যান (সচিব) মুহম্মদ ইব্রাহিম, জাতীয় উন্নয়ন প্রশাসন একাডেমির রেক্টর (সচিব) মো. সহিদ উল্যাহ এবং ওএসডি সচিব মোহাম্মদ সালাহ উদ্দিন। এ ছাড়া বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশনের চেয়ারম্যান (গ্রেড-১) লিপিকা ভদ্রকে অবসরে পাঠানো হয়েছে।
সচিবসহ মোট ৭জন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাকে সরকারি চাকরি আইন, ২০১৮-এর ৪৫ ধারা অনুযায়ী,কোনো সরকারি কর্মচারীর চাকরির মেয়াদ ২৫ বছর পূর্ণ হওয়ার পর যেকোনো সময় সরকার জনস্বার্থে কারণ দর্শানো ছাড়াই তাকে চাকরি থেকে অবসর প্রদান করতে পারবে। সেই ধারায় এসব কর্মকর্তাদের অবসর দিয়েছে সরকার। অন্তর্বর্র্তী সরকারের এই পদক্ষেপকে প্রশাসনের সংস্কার প্রক্রিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হিসেবে দেখা হচ্ছে। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি সচিব পদে চুক্তিভিক্তি নিয়োগ দেয়ার কথা ভাবছে সরকার। এর মধ্যে প্রশাসনে কর্মরত ১৭ ব্যাচের কর্মকর্তাদের মধ্যে থেকে পদোন্নতি দিয়ে সচিব করা হবে। অন্যদিকে ২০ ব্যাচের কর্মকর্তাদের অতিক্তি সচিব পদে পদোন্নতি দেয়ার প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছে। এবার পদোন্নতি বঞ্চিত কর্মকর্তাদের পদোন্নতির তালিকায় রেখেছে সরকার। এসব প্রক্রিয়া শেষে ৩০ ব্যাচের কর্মকর্তাদের উপসচিব পদে পদোন্নতি দেয়া হবে বলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্রে এ তথ্য নিশ্চিত করা হয়েছে। আবার নারী কেলেঙ্কারী ঘটনায় এক ডিসিকে ওএসডি করা হয়েছে। বাকিরা বহাল থাকলেও তাদের বিষয়ে যেকোনো সময় সিদ্ধান্ত আসতে পারে বলে জানা গেছে।
প্রশাসনের যেসব কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে সচিবালয়সহ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় পোস্টারিং করা হয়েছে, এর মধ্যে ৭জন সচিবকে অপসারণ করা হয়েছে। এসব ফ্যাসিবাদী কর্মকর্তাদের মধ্যে যারা রয়েছেন তারা হলেন, অর্থ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের সচিব ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান আব্দুর রহমান খান, পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব নাজমুল আহসান, অর্থ বিভাগের সচিব খায়রুজ্জামান মজুমদার, কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়ান, অর্থ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব নাজমা মোবারেক, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. ফারহিনা আহমেদ, পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য রুহুল আমিন, পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের সচিব আমিন উল আহসান, বিপিএটিসির রেক্টর সাঈদ মাহবুব খান, বিজ্ঞান প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোকাব্বির হোসেন, স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের সচিব সাঈদুর রহমান, শ্রম মন্ত্রণালয়ের সচিব এ এইচ এম সফিকুজ্জামান, বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. আব্দুর রউফ, সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মফিদুর রহমান এবং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. তোফাজ্জল হোসেন, জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নির্বাহী চেয়ারম্যান নাসরীন আফরোজ, বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান মো.জয়নুল বারি, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. আশরাফ উদ্দিন, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব ইশরাত চৌধুরী, বিশ্ব ব্যাংকের বিকল্প নির্বাহী পরিচালক শরিফা খান, স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের সচিব ডা. মো. সারোয়ার বারী, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সমন্বয় ও সংস্কার বিভাগের সচিব জাহেদা পারভীন, ইআরডি সচিব শাহরিয়ার কাদের সিদ্দিকী, মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মমতাজ আহমেদ, প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের সংযুক্ত সচিব মোহাম্মদ মাহমুদুল হোসাইন খান, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মোহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমান, বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস একাডেমির রেক্টর ড. মো. ওমর ফারুক, ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদফতরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ সাইদুর রহমান, যুব উন্নয়ন অধিদফতরের মহাপরিচালক গাজী মহম্মদ সাইফুজ্জামান, জাতীয় স্থানীয় সরকার ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক মো. আব্দুল কাইয়ুম, জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর মহাপরিচালক সালেহ আহমেদ মোজাফফর, মহিলা বিষয়ক অধিদফতরের মহাপরিচালক কেয়া খান। এর আগে একইভাবে চলতি বছরের মার্চ মাসের শেষ সপ্তাহে একই স্থানগুলোতে ‘ফ্যাসিবাদবিরোধী শিক্ষার্থীদের’ ব্যানারে সরকারের পাঁচ জন সচিব ও তিনটি অধিদফতরের তিন শীর্ষ কর্মকর্তার ছবি সম্বলিত পোস্টারিং করা হয়েছিল। ‘গণহত্যা ও ফ্যাসিবাদ কায়েমের সহযোগী আমলাদের অপসারণ চাই’ শিরোনামে এই পোস্টারিং করা হয়।