থেমে আছে গ্রেফতারের উদ্যোগ - Alokitobarta
আজ : রবিবার, ২৬শে জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ১২ই মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

থেমে আছে গ্রেফতারের উদ্যোগ


মোহাম্মাদ রফিকুল ইসলাম : জুলাই-আগস্ট ছাত্র-জনতার কঠোর আন্দোলনকালে পতিত আওয়ামী লীগ সরকারকে রক্ষায় পুলিশ, বিজিবি, র‌্যাব ও আনসার বাহিনীর কতিপয় সদস্য সারাদেশে হাজার হাজার নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা করেছে। এ সময় পুলিশসহ বিভিন্ন বাহিনীর কর্মকর্তারা ছাত্র-জনতাকে প্রতিহত করতে যুবলীগ-ছাত্রলীগের সশস্ত্র ক্যাডারদের সাথে নিয়ে নিজেদের শক্তি বৃদ্ধি করে। আওয়ামী সরকারকে রক্ষায় নির্বিচারে গুলি ও ধারালো অস্ত্রের আঘাতে হাজার হাজার সাধারণ যুবক-কিশোর আহত হয়ে রাজধানীসহ দেশে বড় বড় শহরগুলোতে চিকিৎসাধীন। এদের মধ্যে অনেকেই হাত-পা ও চোখ হারিয়ে বেঁচে থাকার সংগ্রাম করছেন। অথচ এসব নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড এবং নির্যাতনের ঘটনায় দায়েরকৃত মামলায় জড়িতদের গ্রেফতারের কোন উদ্যোগ নেই পুলিশ প্রশাসনে। আন্দোলনে গুলি করে লাশ ফেলার মাস্টারমাইন্ড হিসেবে কাজ করেছেন শতাধিক পুলিশ কর্মকর্তা। তাদের অনেকেই এখনো পুলিশ সদর দফতরসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ইউনিটের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসে পলাতক পুলিশ কর্মকর্তাদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমান সরকারের প্রথম উদ্যোগ হওয়া উচিত যারা জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের সময় নিরিহ ছাত্র-জনতাকে নির্মম ও নিষ্ঠুরভাবে হত্যার নির্দেশদাতা এবং সরাসরি হত্যার সাথে জড়িত তাদের দ্রুত আইনের আওতায় এনে বিচার নিশ্চিত করা। সারাদেশে দায়েরকৃত হত্যা মামলায় যে সব দুর্বলতা রয়েছেন তা দূর করতে বিশেষজ্ঞ কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে একটি বিশেষ সেল তৈরি করা। পুলিশ সদর দফর থেকে ওই সেলের মাধ্যমে সারাদেশের মামলাগুলো মনিটরিং করে দ্রুত চার্জশিট দাখিলের ব্যবস্থা গ্রহণ করা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও স্থানীয়দের কাছ থেকে ভিডিও, স্টিল ছবিসহ সব ধরনের তথ্য সংগ্রহ করা। যা মামলার আলামত হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

বিশেষজ্ঞরা আরো বলছেন, পুলিশ সদর দফতরের পিআইএমএস-এ বসেই সারাদেশের মামলাগুলো তদারকি করা সম্ভব। একই সাথে তদন্তের সাথে জড়িত কর্মকর্তাদের অল্প সময়ের প্রশিক্ষণ দেয়া যেতে পারে। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও অনেক ক্ষেত্রে তদন্তের সুষ্ঠু গাইডলাইন দিয়ে মামলার তদন্ত গতিশীল করার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারেন। হত্যা মামলায় নিরীহ অনেক মানুষকে ব্যক্তিগত শত্রুতা, এলাকাভিত্তিক দ্বন্দ্ব বা রাজনীতির হয়রানি করা না হয় সে বিষয়েও মনিটরিং করতে পারবেন তদারকি কর্মকর্তারা। অনেক হত্যা মামলায় আসামি করা হয়েছে হাজার হাজার ব্যক্তিকে। এছাড়া কোনো কোনো মামলায় অজ্ঞাত হিসেবে আরো কয়েক শতাধিক ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে। সঠিক তদারকির মাধ্যমে এসব বিষয়ে অভিজ্ঞ পুলিশ কর্মকর্তারা ভূমিকা রাখতে পারবেন বলে অপরাধ বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, জুলাই-আগস্ট ছাত্র-জনতাকে হত্যার ঘটনায় রাজধানীসহ সারা দেশে দুই হাজার ৩০০ মামলা দায়ের করা হয়েছে। এসব মামলায় আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মী, পতিত সরকারের সহযোগী হিসেবে চিহ্নিত আমলা, ব্যবসায়ী ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সাবেক-বর্তমান কর্মকর্তা ও সদস্যদের আসামি করা হয়েছে। এদের মধ্যে গ্রেফতার করা হয়েছে মাত্র ২৫ পুলিশসহ ১১০ হাই প্রোফাইল ব্যক্তিকে। হত্যা মামলায় জড়িত শতাধিক পুলিশ কর্মকর্তা-সদস্য ও কয়েকশ’ আওয়ামী লীগের হাই প্রোফাইল নেতা এখনো ধরাছোয়ার বাইরে। এদের প্রত্যেকের নামে একাধিক মামলা রয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, এদের কেউ কেউ ইতোমধ্যেই দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছে পুলিশ ও বিজিবি সহযোগিতায়। সূত্র জানায়, ছাত্র-জনতার তীব্র আন্দোলনের মুখে মধ্য জুলাই থেকে শুরু করে ৫ আগস্ট পর্যন্ত নির্বিচারে গুলি চালায় পুলিশ। বিশেষ করে, ঢাকা শহরে পুলিশের গুলিতে নিহত হয় হাজার হাজার ছাত্র-জনতা। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। এরপর থেকে সাবেক মন্ত্রী-এমপি, নেতাকর্মী, পুলিশ ও আমলাদের বিরুদ্ধে শুরু হয় মামলা।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শেখ হাসিনা সরকারের পতনের দিন ৫ আগস্ট বিকালেও রাজধানীর যাত্রাবাড়ি, গাজীপুর জেলাসহ বিভিন্ন এলাকায় বেপরোয়া পুলিশ সদস্যদের নেতৃত্বে নির্বিচারে আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি চালানো হয়। আন্দোলন দমাতে শেখ হাসিনা সরকার দফায় দফায় ইন্টারনেট বন্ধ করে, যাতে ওই সময়ে পুলিশ সদস্যদের বেপরোয়া তাণ্ডব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ না পায়। সম্প্রতি পর্যায়ক্রমে সেসব নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ভিডিও ফুটেজ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হতে শুরু করেছে। পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে দায়ের করা কিছু মামলার এজাহার এবং ওই সময়ের ঘটনার ছবি ও ভিডিও ফুটেজ বিশ্লেষণ করে পুলিশের তাণ্ডবের বেশকিছু প্রমাণ পাওয়া গেছে।সরকার পতনের পর ভাইরাল ভিডিওতে দেখা যায়, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে গুলি করা নিয়ে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মো. আসাদুজ্জামান খান কামালকে ব্রিফ করছেন ডিএমপির ওয়ারী বিভাগের ডিসি মোহাম্মদ ইকবাল হোসাইন। তার মোবাইলে একটি ভিডিও দেখিয়ে তিনি বলছিলেন, গুলি করে লাশ নামানো লাগছে স্যার। গুলি করি, মরে একটা, আহত হয় একটা। একটাই যায় স্যার, বাকিগুলো যায় না। এইটা হলো স্যার সবচেয়ে বড় আতঙ্কের এবং দুশ্চিন্তার বিষয়। কিন্তু ওই কর্মকর্তাকেও গতকাল পর্যন্ত গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ।

সূত্র আরো জানায়, সাবেক সিআইডি প্রধান মোহাম্মদ আলী মিয়ার বিরুদ্ধে দুটি, পুলিশ হেডকোয়ার্টারের অতিরিক্ত আইজি খন্দকার লুৎফুল কবির ও জামিল আহমেদের বিরুদ্ধে একটি, র‌্যাবের সাবেক মহাপরিচালক এম খুরশিদের বিরুদ্ধে একটি, ডিএমপির সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার এ কে এম হাফিজ আক্তারের (অতিরিক্ত আইজিপি পদে পদোন্নতিপ্রাপ্ত) বিরুদ্ধে ছয়টি, ডিএমপির সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার ড. খ. মহিদ উদ্দিনের বিরুদ্ধে দুটি মামলা হয়েছে। ঢাকা রেঞ্জের সাবেক ডিআইজি সৈয়দ নুরুল ইসলামের বিরুদ্ধে একটি, সাবেক সিটিটিসি প্রধান মো. আসাদুজ্জামানের বিরুদ্ধে তিনটি, সিটিটিসির সাবেক যুগ্ম পুলিশ কমিশনার কামরুজ্জামানের বিরুদ্ধে দুটি, সাবেক ডিআইজি রিপন সরদারের বিরুদ্ধে একটি, সাবেক ডিআইজি খালিদ হাওলাদারের বিরুদ্ধে একটি, সাবেক অতিরিক্ত ডিআইজি প্রলয় কুমার জোয়াদ্দারের বিরুদ্ধে ৩টি, ডিএমপি সাবেক যুগ্ম-পুলিশ কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকারের বিরুদ্ধে ২৭টি, সাবেক যুগ্ম-পুলিশ কমিশনার এস এম মেহেদী হাসানের বিরুদ্ধে ৮টি, সাবেক যুগ্ম পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ আনিসুর রহমানের বিরুদ্ধে একটি ও সঞ্জিত কুমার রায়ের বিরুদ্ধে একটি, রংপুর রেঞ্জের সাবেক অতিরিক্ত ডিআইজি রশিদুল হকের বিরুদ্ধে একটি, ঢাকা রেঞ্জের সাবেক অতিরিক্ত ডিআইজি মারুফ হোসেন সরদারের বিরুদ্ধে একটি মামলা হয়েছে। রমনা বিভাগের সাবেক ডিসি মোহাম্মদ আশরাফ ইমামের বিরুদ্ধে একটি, ডিএমপির সাবেক ডিসি তানভির সালেহীন ইমনের বিরুদ্ধে একটি, গোয়েন্দা লালবাগ বিভাগের সাবেক ডিসি মশিউর রহমানের বিরুদ্ধে দুটি, সাবেক ডিসি মাহফুজুল আল রাসেলের বিরুদ্ধে একটি করে মামলা, সিটিটিসির সাবেক ডিসি জাহিদ তালুকদার, উত্তরার সাবেক ডিসি আশরাফুল আজিমের বিরুদ্ধে দুটি, তেজগাঁও বিভাগের সাবেক ডিসি এইচ এম আজিমুল হক ও হাফিজ আল ফারুকের বিরুদ্ধে একটি, লালবাগের সাবেক ডিসি মাহাবুব-উজ-জামানের বিরুদ্ধে একটি ও লালবাগ বিভাগের সাবেক ডিসি জাফর হোসেনের বিরুদ্ধে দুটি মামলা হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে পুলিশ সদর দফতরের একজন কর্মকর্তা বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে নিহতের ঘটনায় রুজুকৃত মামলার তদন্তে যাতে কোনো ধরনের গাফিলতি না হয় এ জন্য বিশেষ তদারকির ব্যবস্থা করা হয়েছে। মামলার তদন্তকারীর কাছ থেকে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তদন্তের নিয়মিত আপডেট নিচ্ছেন। একই সঙ্গে তদন্তে যাতে কোনো ধরনের ফাঁকফোকর ও দুর্বলতা না থাকে তা নিশ্চিত করার জন্য মামলার সুপারভিশন কর্মকর্তাদের সতর্ক করা হয়েছে। মামলার এজাহারভুক্ত আসামি হলেও নির্দোষ কোনো ব্যক্তি যাতে ফেঁসে না যায় সে ব্যাপারে তারা সতর্ক। পাশাপাশি এজাহারভুক্ত আসামি না হলেও হত্যাকাণ্ডে সম্পৃক্ত কোনো ব্যক্তি যেন পার পেয়ে না যায় সেদিকে বিশেষ নজর রাখতে তদন্তকারী কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।পুলিশ সদর দফতরের এআইজি মিডিয়া ইনামুল হক সাগর বলেন, যাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছিল তাদের অনেককেই আমরা ইতোমধ্যে আইনের আওতায় এনেছি। যেসব আসামিকে এখনো গ্রেফতার করা যায়নি, তাদের ধরতে আমাদের অভিযান অব্যাহত আছে।

Top