ইমেজ সংকট কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা,ঢেলে সাজাতে ব্যাপক রদবদল
মু.এ বি সিদ্দীক ভুঁইয়া:পর্যায়ক্রমে পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটে আসে নতুন নেতৃত্ব। যদিও দুই-একটি ইউনিট প্রধানের পদ এখনো ফাঁকা। এরই মধ্যে বিভিন্ন রেঞ্জ ডিআইজি, বিভিন্ন মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার, ৬৪ জেলার এসপি, সব থানার ওসি পরিবর্তন করা হয়। এছাড়া পুলিশকে ঢেলে সাজাতে ব্যাপক রদবদল করা হয় অন্যান্য সব পদে। এসবের মাধ্যমে ইমেজ সংকট কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা চালচ্ছে পুলিশ। তবে সুযোগ সন্ধানী কতিপয় কর্মকর্তার কারণে এই প্রচেষ্টা কিছুটা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।অসাধু পুলিশ কর্মকর্তাদের অনিয়ম, দুর্নীতি এবং উচ্চাভিলাষী মানসিকতায় পুরো বাহিনীতে তৈরি হয় ইমেজ সংকট। গত প্রায় ১৬ বছরে শাসক দলের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে বেপরোয়া হয়ে ওঠে এসব অসৎ কর্মকর্তা। এ কারণে ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর ক্ষোভের টার্গেট হয় পুলিশ বাহিনী। উত্তেজিত জনতা হামলা, ভাঙচুর এবং অগ্নিসংযোগ চালায় সদর দপ্তরসহ পুলিশের বিভিন্ন স্থাপনা ও যানবাহনে। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন থানা ও ট্রাফিক পুলিশের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। আত্মগোপনে চলে যায় পদস্থ কর্মকর্তারা। বিদ্রোহ সৃষ্টি চেষ্টা চালান নিুপদস্থ পুলিশ সদস্যরা। ওই সময় নেতৃত্বশূন্য হয়ে পড়ে পুলিশ বাহিনী। ভেঙে পড়ে চেইন অব কমান্ড। এমন প্রেক্ষাপটে আসে পুলিশের নেতৃত্বের পরিবর্তন।৮ আগস্টের আগেই নিয়োগ দেওয়া হয় নতুন আইজিপি, ডিএমপি কমিশনার এবং র্যাব মহাপরিচালক। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।ডিএমপি সদর দপ্তর থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, আগের বছরের আগস্ট-সেপ্টেম্বরের তুলনায় গত দুই মাসে খুনের ঘটনা বেড়েছে। তবে উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে অন্যান্য অপরাধ। পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০২৩ সালের আগস্ট মাসে দস্যুতার ১৩টি ঘটনা ঘটে। আর ২০২৪ সালের আগস্ট মাসে এ ধরনের ঘটনা ঘটে মাত্র চারটি। গত বছরের আগস্টে ৫২টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। আর চলতি বছরের আগস্ট মাসে ১৯টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। গত বছরের আগস্টে নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনায় ১৫৭টি মামলা হয়। অন্যদিকে এ বছরের একই মাসে এ ধরনের ঘটনা ঘটে ৫১টি। ২০২৩ সালের আগস্টে খুনের ঘটনা ছিল ১০টি। চলতি বছরের আগস্টে খুনের ঘটনা ঘটে ১১৯টি। গত বছরের আগস্টে রাজধানীতে চুরির মামলা হয় ২০৬টি। চলতি বছরের আগস্টে এ সংক্রান্ত মামলা হয় ৫৮টি। ডিএমপির পরিসংখ্যান বলছে, ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে দস্যুতার ২০টি ঘটনা ঘটে। আর ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ঘটে ১৩টি। গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে ৪৭টি ধর্ষণের মামলা হলেও এ বছরের সেপ্টেম্বরে ধর্ষণের মামলা হয় ১৩টি। ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা ছিল ১৪১টি। আর চলতি বছরের একই মাসে এ ধরনের ঘটনা ছিল ৪১টি। ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে খুনের মামলা হয় ১১টি। অপরদিকে চলতি বছরের একই মাসে খুনের মামলা হয় ১২৯টি। ২০২৩ সালের সেপ্টম্বর মাসে ১৭৭টি চুরির ঘটনা ঘটলেও চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে চুরির ঘটনা ঘটে ১০০টি।
সূত্র জানায়, পুলিশ বাহিনীতে শৃঙ্খলা ফেরাতে গত দুই মাসে ৯৭৫ জন পুলিশ সদস্যের পদোন্নতি হয়েছে। এদের মধ্যে অতিরিক্ত আইজি (গ্রেড-১) একজন, ডিআইজি ৮০ জন, অতিরিক্ত ডিআইজি ৪৮ জন, ৩০০ এসপি এবং ৬৪ পুলিশ পরিদর্শক আছেন। কনস্টেবল থেকে এসআই পদমর্যাদার ছয়টি পদে ৭৫৩ জন পুলিশ সদস্যের পদোন্নতি হয়েছে গত দুই মাসে। এদের মধ্যে টিএসআই ছয়জন, এসআই (স.) ১৫ জন, এসআই (নি.) ১৮ জন, এএসআই (নি.) ১২ জন। কনস্টেবল থেকে নায়েক হয়েছেন ৬৭৭ জন। শিগগিরই অতিরিক্ত আইজিপি পদে কয়েকজনের পদোন্নতি হওয়ার সম্ভাবনা আছে। কেবল পদোন্নতিই নয়, পুলিশের সংস্কারের জন্য সরকার গঠিত সফর রাজ হোসেনের নেতৃত্বাধীন একটি কমিশন কাজ করছে। এছাড়া পুলিশ সদর দপ্তরের পক্ষ থেকে একটি সংস্কার কমিটি গঠন করা হয়েছে। সংস্কার কার্যক্রম চলমান থাকলেও আস্থার সংকট কাটিয়ে এখনো পুরোদমে সক্রিয় হতে পারেনি বাহিনীটি। অভ্যন্তরীণ দাবি-দাওয়া ও পদোন্নতি পদায়ন নিয়ে পুলিশের ভেতরে এখনো অস্থিরতা কাজ করছে, যা মাঠের কাজে সমস্যা সৃষ্টি করছে।
সূত্র জানায়, বিসিএস ক্যাডার পুলিশ কর্মকর্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের কমিটি গঠন নিয়েও চলছে অস্থিরতা। অ্যাসোসিয়েশনের বর্তমান সভাপতি পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) প্রধান অতিরিক্ত আইজি মনিরুল ইসলামকে চাকরি থেকে বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া হয়েছে। সাধারণ সম্পাদক নারায়ণগঞ্জের সাবেক পুলিশ সুপার গোলাম মোস্তফা রাসেল আত্মগোপনে। এ কারণেই নতুন কমিটি গঠন সংক্রান্ত কাজে সম্প্রতি আলোচনায় বসেন শীর্ষ কর্মকর্তারা। একটি অংশ সরাসরি নির্বাচনের মাধ্যমে কমিটি গঠনের অনুরোধ জানান। অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি পদে অতিরিক্ত আইজি পদের কর্মকর্তার বিধান থাকায় ১২তম ব্যাচের একজনের নাম প্রস্তাব করলে ১৭তম ব্যাচের কর্মকর্তারা তা সমর্থন করেন। কিন্তু ১৫তম ব্যাচের কর্মকর্তারা আপত্তি জানায়। তাদের দাবি, পদোন্নতিবঞ্চিত থাকার কারণে তাদের ব্যাচের অনেকেই এখনো ডিআইজি হিসাবে রয়ে গেছেন। বর্তমান সরকার যেহেতু দ্রুত সংস্কার কাজ করছে সেহেতেু তারাও যেকোনো দিন অতিরিক্ত আইজি হয়ে যাবেন। তাই অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি তাদের ব্যাচ থেকেই হওয়া উচিত। এ নিয়ে ১২ ও ১৫তম ব্যাচের কর্মকর্তাদের মধ্যে হইচই শুরু হলে ১৭তম ব্যাচের কর্মকর্তারা দাবি করেন, ডিআইজি পদমর্যাদার কাউকে সভাপতি করা হলে তাদের ব্যাচ থেকে করা হোক। কারণ দীর্ঘদিন পদোন্নতি না হওয়ায় ১৭তম ব্যাচের কর্মকর্তারাও ডিআইজি হিসাবে অনেকেই রয়েছেন। দ্রুত পদোন্নতি হলে তারাও অতিরিক্ত আইজি হয়ে যাবেন। এছাড়া সাধারণ সম্পাদক পদ নিয়ে নিজ নিজ ব্যাচ থেকে দাবি তোলেন ২১, ২২ ও ২৪তম ব্যাচের কর্মকর্তারা। এ নিয়ে উত্তেজনাকর পরিস্থিতি তৈরি হয়। আইজিপির হস্তক্ষেপে কমিটি গঠন প্রক্রিয়া আপাতত স্থগিত আছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর পরই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীতে থাকা স্বৈরাচার সরকারের দোসররা দেশকে অস্থিতিশীল করার অপচেষ্টা চালায়। পতিত সরকারের এজেন্ডা বাস্তবায়নে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে রাস্তায় নামিয়ে নতুন সরকারকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলার চেষ্টা চালায়। পুলিশের কৌশলী ভূমিকায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ হয়। বাহিনীর ভেতর বিদ্রোহ সৃষ্টির অপপ্রয়াসকারী একাধিক পুলিশ সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়। এর পরই শৃঙ্খলা ফিরতে শুরু করে পুলিশে। ইতোমধ্যেই সব থানার কার্যক্রম চালু হয়েছে। ট্রাফিক পুলিশ সদস্যরা ফের মনোবল নিয়ে কাজ শুরু করেছে। তবে এখনো মাঠ পর্যায়ে কিছু পুলিশ সদস্য সরকার এবং পুলিশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। তারা সেবা প্রত্যাশীদের সঙ্গে অসদাচরণ করছেন। গ্রেফতার বাণিজ্যের অভিযোগও উঠছে কোনো কোনো পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে। মামলায় আসামি করার ভয় দেখিয়ে যেমন টাকা আদায় করা হচ্ছে, তেমনি এজাহার থেকে নাম বাদ দেওয়ার বিনিময়েও তারা বাণিজ্য করছেন বলে অভিযোগ উঠছে। সেবাপ্রার্থীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করার অভিযোগও রয়েছে কারও কারও বিরুদ্ধে।
জানা যায়, আওয়ামী লীগ আমলে বিভিন্ন জেলায় দায়িত্বপ্রাপ্ত মাঠ পর্যায়ের অনেক কর্মকর্তা (এসআই থেকে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার পদমর্যাদার) এখনো বহাল তবিয়তে আছেন। তারা দীর্ঘদিন ধরে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের সঙ্গে নিয়ে নানা অপকর্ম করেছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তারা কৌশলে ওই নেতাদের বাঁচানোর চেষ্টা করছেন। আবার ৫ আগস্টের পর দায়িত্বপ্রাপ্ত কোনো কোনো কর্মকর্তা নিজেদের ব্যাপক ক্ষমতাধর বলে মনে করছেন। শনিবার সন্ধায় গাজীপুরের এসপি আবুল কালাম আযাদের সঙ্গে যুগান্তরের সাংবাদিক কথা বলতে গেলে তিনি বলেন, ‘আমি কোনো সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বলি না।’ জানতে চাইলে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) মহাপরিচালক একেএম শহিদুর রহমান বলেন, ৫ আগস্টের পর যখন দায়িত্ব নিয়েছিলাম, তখন পরিস্থিতি অনেক খারাপ ছিল। এখন আর সেই পরিস্থিতি নেই। র্যাবের কোনো সদস্য কর্মক্ষেত্রে অনুপস্থিত নেই। তারা পূর্ণ উদ্যমে কাজ শুরু করেছে। মানুষকে এক জায়গা থেকে ধরে এনে অন্য জায়গায় গুলি করার যে অভিযোগ ছিল সেটা আর হবে না। বিচারবহির্ভূত কোনো হত্যাকাণ্ড র্যাব বরদাশত করবে না। র্যাবের কোনো সদস্য অপেশাদার কাজে জড়ালে তার বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) ইনামুল হক সাগরবলেন, গত ৫ আগস্টের আগ পর্র্যন্ত দেশে যে অবস্থা তৈরি হয়েছিল, তাতে পুলিশে নেতৃত্বে পরিবর্তন অনিবার্য ছিল। নতুন নেতৃত্ব দায়িত্ব গ্রহণের পর মাঠ পর্যায়ে ভিজিট করে পুলিশ সদস্যদের মনোবল বৃদ্ধির চেষ্টা করা হয়। জুলাই-আগস্টের আন্দোলন ঘিরে পুলিশের এক হাজার ৭৪ টি গাড়ি ও ৪৯৭টি স্থাপনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ইতোমধ্যেই সেগুলো মেরামত করা হয়েছে। পুলিশের মনোবল ফিরিয়ে আনা হয়েছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতির শুরুতে পুলিশের আভিযানিক কাজ বন্ধ থাকলেও ইতোমধ্যেই চাঙা মনোভাব নিয়ে তারা অভিযান চালচ্ছে। দ্রুতই পরিস্থিতির আরও উন্নতি হবে।ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারের উপকমিশনার মুহাম্মদ তালেবুর রহমান বলেন, জুলাই-আগস্টের আন্দোলন ঘিরে আমাদের ২২টি থানা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। এছাড়া অনেক সমস্যা দেখা দিয়েছিল। সব সমস্যা কাটিয়ে পুলিশ এখন পুরোদমে কাজ করছে। ট্রাফিক এবং থানার কার্যক্রমে গত দুই মাসে অনেক ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে। দ্রুতই আরও ভালোর দিকে যাবে।