গণহত্যার বিচার ট্রাইব্যুনালে,শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আরও তিন মামলা - Alokitobarta
আজ : শুক্রবার, ২১শে নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ৬ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

গণহত্যার বিচার ট্রাইব্যুনালে,শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আরও তিন মামলা


মোহাম্মাদ নাসির উদ্দিন:বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর গুলি, হত্যার নির্দেশদাতা ও পরিকল্পনাকারী হিসাবে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ৯ জনের নামে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছে। আবেদনে সংগঠন হিসাবে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ ও এর অঙ্গসংগঠনগুলোর বিরুদ্ধে একই অভিযোগ করা হয়। একই সঙ্গে আসামিদের বিরুদ্ধে তদন্ত করে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ চাওয়া হয়েছে। আন্দোলনে গণহত্যা ও গুলিবর্ষণের ঘটনায় জড়িতদের বিচার হবে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে (আইসিটি)। ওই আন্দোলনে নিহত নবম শ্রেণির ছাত্র আরিফ আহমেদ সিয়ামের বাবা বুলবুল কবিরের পক্ষে বুধবার ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থায় আবেদনটি করেন সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী গাজী এমএইচ তামিম।এদিকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরসহ ২৪ জনের বিরুদ্ধে রাজধানীর কাফরুলে কলেজছাত্র ফয়জুল ইসলাম হত্যার অভিযোগে একটি মামলা হয়েছে। এছাড়া সুপ্রিমকোর্টের এক আইনজীবীকে অপহরণের অভিযোগে শেখ হাসিনাসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে আরেকটি মামলা হয়। আদালত দুটি আবেদনই মামলা হিসাবে গ্রহণ করতে সংশ্লিষ্ট থানাকে নির্দেশ দিয়েছেন।

এ নিয়ে গত ২ দিনে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মোট চারটি মামলা হয়েছে। এর আগে মঙ্গলবার পুলিশের গুলিতে রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকার মুদি দোকানি আবু সায়েদ নিহত হওয়ার ঘটনায় শেখ হাসিনাসহ সাতজনের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ মামলা হিসাবে গ্রহণ করতে নির্দেশ দেন আদালত। ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থায় দেওয়া আবেদনে আসামি হিসাবে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক, সাবেক তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত এবং তৎকালীন সরকারের কিছু মন্ত্রী,প্রতিমন্ত্রী ও সংসদ-সদস্যের নাম এসেছে।পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন, ঢাকা মহানগর ডিবির সাবেক প্রধান হারুন অর রশীদ, ঢাকা মহানগর পুলিশের সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমান, র‌্যাবের সাবেক মহাপরিচালক মো. হারুন অর রশিদ ও কিছু অসাধু র‌্যাব কর্মকর্তাসহ অজ্ঞাত অস্ত্রধারী আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মী এবং সংগঠন হিসাবে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ ও এর অঙ্গসংগঠনগুলোর কথা এতে উল্লেখ করা হয়েছে।

আবেদনে অপরাধের ধরনের বিষয়ে বলা হয়েছে-১ থেকে ৯ নম্বর আসামির নির্দেশ ও পরিকল্পনায় অন্য আসামিরা দেশি ও আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে নির্বিচার গুলি করে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারী সাধারণ নিরস্ত্র ছাত্র-জনতাকে হত্যা করে তাদের সমূল বা আংশিক নির্মূল করার উদ্দেশ্যে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের মতো অপরাধ করেছে। গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিষয়ে জানতে চাইলে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার উপ-পরিচালক আতাউর রহমান মামলার সত্যতা নিশ্চিত করেন। তিনি বলেন, আমরা অভিযোগটি নথিভুক্ত করেছি। নথিভুক্তির মাধ্যমে মামলার তদন্ত শুরু হলো। তদন্ত শেষ হওয়ার পর আমরা পরবর্তী কার্যক্রমের জন্য ট্রাইব্যুনালের প্রধান প্রসিকিউটর অফিসে প্রতিবেদন জমা দেব।

আইনজীবী গাজী এমএইচ তামিম বলেন, তদন্ত সংস্থায় আমরা আবেদনটি করেছি। এখন তদন্ত সংস্থা কাজ শেষে ট্রাইব্যুনাল বরাবরে আবেদন করে আসামিদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা চাইতে পারেন। তদন্ত কাজের জন্য আসামিদের হাজির করা দরকার। তখনই এটি ট্রাইব্যুনালের মামলা হিসাবে লিপিবদ্ধ হবে। আর যদি গ্রেফতারি পরোয়ানা না চান তাহলে-তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার পর চিফ প্রসিকিউটর একটা আনুষ্ঠানিক অভিযোগ ট্রাইব্যুনালের জমা দেবেন। এরপর আনুষ্ঠানিক বিচার শুরু হবে। বিদ্যমান আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালস অ্যাক্ট ১৯৭৩ অনুযায়ী এই অভিযোগের বিচার করতে আইনি কোনো বাধা আছে কিনা, জানতে চাইলে গাজী তামিম বলেন, কোনো বাধা নেই। কারণ এই আইনে চারটি অপরাধের বিচারের কথা বলা আছে। মানবতাবিরোধী অপরাধ, গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ ও শান্তির বিরুদ্ধে অপরাধ।

সর্বশেষ ঢাকায় অবস্থিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে তিনজন বিচারপতি ছিলেন। এরা হচ্ছেন ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. আবু আহমেদ জমাদার, সদস্য বিচারপতি কেএম হাফিজুল আলম ও বিচারপতি এএইচএম হাবিবুর রহমান ভূঁইয়া। এরই মধ্যে ১৩ জুন ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. আবু আহমেদ জমাদার অবসরে গেলে সেখানে আর কাউকে নিয়োগ দেওয়া হয়নি। মঙ্গলবার (১৩ আগস্ট) ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন প্যানেল থেকে ১০ জন প্রসিকিউটর পদত্যাগ করেন। বর্তমানে ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে।

১৫ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত দেশব্যাপী কমপক্ষে ৪৩৯ জন শিক্ষার্থী হত্যা : ট্রাইব্যুনালে তদন্ত সংস্থার আবেদনে বলা হয়েছে, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারীদের সমূলে নির্মূল করার হীন উদ্দেশ্যে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংবাদ সম্মেলনে আন্দোলন প্রতিহত করার জন্য উসকানিমূলক বক্তব্য দেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং আওয়ামী-লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতাকে সমূলে বা আংশিক নির্মূল করার নির্দেশনা দেন। এতে বলা হয়, শেখ হাসিনা, ওবায়দুল কাদের এবং অন্য আসামিদের নির্দেশে আওয়ামী-লীগ ও এর অঙ্গসংগঠন এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এ সময় দেশব্যাপী আন্দোলনরত সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের ওপর আগ্নেয় এবং দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে হামলা করে। তাদের নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করে। কুপিয়ে, পিটিয়ে মারাত্মক আহত করে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ সংগঠন করে। ১৫ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত সারা দেশে কমপক্ষে ৪৩৯ জন শিক্ষার্থী হত্যা করা হয় বলে এই আবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

সিয়ামের বাবার আবেদনে বলা হয়েছে, ৫ আগস্ট আরিফ আহমেদ সিয়াম সাভারে আন্দোলনরত অবস্থায় পুলিশের গুলিতে আহত হয়। পরে ৭ আগস্ট সে মারা যান। আবেদনটিতে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, শেখ হাসিনাসহ নয়জন আসামির নির্দেশ ও পরিকল্পনায় সারা দেশে ২৮৬টি মিথ্যা মামলায় সাড়ে চার লাখ আন্দোলনরত ছাত্র-জনতাকে আসামি করা হয়। এর মধ্যে বারো হাজার আন্দোলনকারীকে গ্রেফতার করে কারাগারে রেখে তাদের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হয়। এসব কার্যক্রমের মাধ্যমে সব আসামি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনানুযায়ী গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ সংগঠন করেছেন বলে দাবি করা হয় আবেদনটিতে। আসামিদের বিরুদ্ধে তদন্ত করে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ চাওয়া হয়েছে।

ছাত্র হত্যার অভিযোগে শেখ হাসিনাসহ ২৪ জনের বিরুদ্ধে মামলা : রাজধানীর কাফরুলে কলেজছাত্র ফয়জুল ইসলাম হত্যার অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরসহ ২৪ জনের বিরুদ্ধে কাফরুল থানায় মামলা রেকর্ড করার আদেশ দেন আদালত। ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতের ম্যাজিস্ট্রেট আহমদ হুমায়ুন কবির বুধবার এ আদেশ দেন। এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন ওই আদালতের বেঞ্চ সহকারী মো. হেলাল উদ্দিন। ঢাকা মডেল ডিগ্রি কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী ফয়জুল ইসলাম খুনের মামলার বাদী হয়েছেন ফয়জুল ইসলামের ভাই রাজীব।

মামলায় শেখ হাসিনা ও ওবায়দুল কাদের ছাড়াও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, সাবেক বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাসান মাহমুদ, সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ এ আরাফাত, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, সাবেক সংসদ-সদস্য মইনুল হোসেন খান নিখিল, ঢাকা উত্তর আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক এমএ মান্নান, স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি গাজী মেজবাউল হক সাচ্চু, সাবেক সংসদ-সদস্য কামাল আহম্মেদ মজুমদার, সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন, অতিরিক্ত আইজিপি ও র‌্যাবের সাবেক মহাপরিচালক হারুন অর রশিদ, ডিএমপির সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমান, ডিবির সাবেক প্রধান হারুন অর রশীদ, সাবেক যুগ্ম কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার, স্থানীয় আওয়ামী লীগের ওয়ার্ড সভাপতি মোফাজ্জল হোসেন, উত্তর সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর জামাল মোস্তফা, ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দাম হোসেন, সাধারণ সম্পাদক ওয়ালী আসিফ ইনান, ঢাকা মহানগর উত্তর ছাত্রলীগ নেতা সালামত উল্লাহ সাগর ও ঢাকা মহানগর উত্তর ছাত্রলীগের সদস্য দীপংকর বাসারকে আসামি করা হয়েছে। অজ্ঞাত আসামি করা হয়েছে স্থানীয় আওয়ামী লীগের ৫০০ থেকে ৬০০ নেতাকর্মীকে। মামলায় বাদীর অভিযোগ, ১৯ জুলাই হত্যার উদ্দেশ্যে নির্বিচার গুলি চালিয়ে ফয়জুল ইসলামকে মিরপুর-১০ গোলচত্বরসংলগ্ন ফায়ার সার্ভিস স্টেশনের সামনে হত্যা করা হয়। সেদিন তিনি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে অংশ নেন।

শেখ হাসিনাসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে অপহরণ মামলা : সুপ্রিমকোর্টের এক আইনজীবীকে অপহরণের অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ মামলা হিসাবে গ্রহণ করতে নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতের ম্যাজিস্ট্রেট ফারজানা শাকিল সুমু চৌধুরী বুধবার এই আদেশ দেন। উত্তরা পশ্চিম থানাকে এই আদেশ দেওয়া হয়েছে বলে জানান সিএমএম আদালতের বেঞ্চ সহকারী রাকিব চৌধুরী। আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনার পাশাপাশি এ মামলার অন্য আসামিরা হলেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) একেএম শহীদুল হক এবং র‌্যাবের সাবেক মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ। এ ছাড়া মামলায় র‌্যাবের ২০ থেকে ২৫ জন অজ্ঞাতপরিচয় সদস্যকে আসামি করা হয়েছে।মামলায় সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী সোহেল রানা দাবি করেছেন, ২০১৫ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি রাত ৮টার দিকে উত্তরা এলাকা থেকে তাকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে আটক করা হয়। পরে তাকে শারীরিক ও মানসিকভাবে নানা নির্যাতন করা হয়। নির্যাতনে তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলেন।

Top