কনডেম সেল নয় মৃত্যুদণ্ড চূড়ান্ত না হলে
মু.এবি সিদ্দীক ভুঁইয়া :সব ধরনের বিচারিক ও প্রশাসনিক প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার আগে মৃত্যুদণ্ডাদেশ পাওয়া দণ্ডিতকে কনডেম সেল বা নির্জন কারাকক্ষে রাখা যাবে না। কনডেম সেলে বন্দি তিন কয়েদির রিট আবেদনের রুল নিষ্পত্তি করে সোমবার বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ ও বিচারপতি মো. বজলুর রহমানের হাইকোর্ট বেঞ্চ পর্যবেক্ষণসহ এ রায় দেন। মৃত্যুদণ্ডাদেশ চূড়ান্ত হওয়ার আগেই যাদের কনডেম সেল বা কারাগারে নির্জন প্রকোষ্ঠে রাখা হয়েছে, তাদের পর্যায়ক্রমে সাধারণ সেলে স্থানান্তরের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আর এ কাজের জন্য দুই বছর সময় বেঁধে দিয়েছেন হাইকোর্ট।আদালত রায়ের পর্যবেক্ষণে বলেছেন, মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত বন্দিদের সঙ্গে অন্য বন্দিদের মতোই আচরণ করা উচিত। ব্যতিক্রম পরিস্থিতি, যেমন-ছোঁয়াচে রোগ বা সমকামিতা থাকলে বিশেষ বিবেচনায় যে কোনো বন্দিকে বিচ্ছিন্ন কক্ষে রাখা যেতে পারে। এ ছাড়া মৃত্যুদণ্ডাদেশ পাওয়া বন্দিদের অন্য বন্দিদের মতো জামিন আবেদনের অনুমতি দেওয়া উচিত। উপযুক্ত ক্ষেত্রে হাইকোর্টের উচিত ফৌজদারি কার্যবিধির ৪২৬ ধারা অনুসারে আবেদনকারীকে জামিন দেওয়া।এদিকে উচ্চ আদালতের এ রায়কে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত বলে উল্লেখ করেছেন দেশের আইন বিশেষজ্ঞরা। সরকার যেন এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল না করেন সে পরামর্শও দিয়েছেন তারা। এদিকে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করবে কিনা এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ডিএজি। রিটের পক্ষে আইনজীবীরা বলেছেন, এটি একটি ঐতিহাসিক রায়। রিটকারীদের পক্ষে আদালতে শুনানি করেন আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল অমিত তালুকদার।
প্রসঙ্গত, ২০২২ সালের ৩ সেপ্টেম্বর মামলা চূড়ান্তভাবে নিষ্পত্তি হওয়ার আগে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিকে কনডেম সেলে রাখার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট দায়ের করা হয়। চট্টগ্রাম কারাগারে কনডেম সেলে থাকা জিল্লুর রহমানসহ মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত তিন বন্দির পক্ষে আইনজীবী শিশির মনির এ রিট দায়ের করেন। গত বছরের ৫ এপ্রিল এ বিষয়ে রুল জারি করেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে কনডেম সেলে থাকা বন্দিদের বিষয়ে ছয় মাসের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেওয়া হয়। গত বছরের ১২ ডিসেম্বর মৃত্যুদণ্ডাদেশ চূড়ান্ত হওয়ার আগে আসামিদের কনডেম সেলে বন্দি রাখা কেন বেআইনি হবে না এবং কেন জেলকোডের ৯৮০ বিধি অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হবে না, এই মর্মে জারি করা রুলের শুনানি শেষ হয়। হাইকোর্ট বেঞ্চ শুনানি শেষে মামলাটি রায় ঘোষণার জন্য অপেক্ষমাণ রাখেন।রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, দণ্ডবিধিতে কনডেম সেলে রাখাই এক ধরনের শাস্তি। কাজেই মৃত্যুদণ্ডের রায়ের পর কনডেম সেলে রাখা হলে তা দুইবার সাজার সমতুল্য। আদালত বলেছেন, সরকার কারাবিধি সংস্কারের যে কাজ করছে, সেখানে যেন এই রায় ও পর্যবেক্ষণের প্রতিফলন থাকে।
রায়ের পর শিশির মনির বলেন, রায়ে আদালত বলেছেন, প্রথমত, কোনো ব্যক্তির মৃত্যুদণ্ড চূড়ান্ত হওয়ার আগে তাকে মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত আসামি বলা যাবে না এবং তাকে মৃত্যু (কনডেম) সেলে রাখা যাবে না। বিচারিক প্রক্রিয়া (ডেথ রেফারেন্স, আপিল ও রিভিউ) ও প্রশাসনিক প্রক্রিয়া (রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমার আবেদন) শেষেই কেবল একজন আসামিকে মৃত্যু সেলে বন্দি রাখা যাবে। দ্বিতীয়ত, কোনো ব্যক্তির অসুস্থতা বা বিশেষ কারণে আলাদা সেলে রাখার আগে তাকে নিয়ে শুনানি করতে হবে। এটি ব্যতিক্রম। রাষ্ট্রপক্ষ বলেছে, নতুন জেলকোড তৈরি করা হচ্ছে। নতুন আইন হচ্ছে, প্রিজন অ্যাক্ট। হাইকোর্ট বলছেন, রায়ের পর্যবেক্ষণ যেন নতুন আইনে প্রতিফলিত হয়, তা বিবেচনা করতে।মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত বন্দির বিষয়ে তথ্য চাইলে (সাংবাদিক, গবেষক) আইন অনুসারে তা দিতে কারা কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামির বিষয়ে সুপ্রিমকোর্ট রেজিস্ট্রারকেও আইন অনুসারে তথ্য দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া সুপ্রিমকোর্টের বার্ষিক রিপোর্টেও এ আসামিদের তথ্য সন্নিবেশিত করতে বলা হয়েছে। পাশাপাশি দুই বছরের মধ্যে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত বন্দিদের ক্রমান্বয়ে কনডেম সেল থেকে সরিয়ে সাধারণ কয়েদিদের সঙ্গে রাখার ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে।
শিশির মনির আরও বলেন, পর্যবেক্ষণে আদালত নির্দিষ্টভাবে সাগর-রুনির ঘটনা উল্লেখ করে বলেছেন, প্রায় ১২ বছর ধরে তদন্ত হচ্ছে, এখনো তদন্ত শেষ হচ্ছে না। বিচার তো আরও পরের স্টেজ (ধাপ)। আমাদের দেশে ট্রায়াল স্টেজ শেষ হতে ৫-১০ বছর সময় লেগে যায়। এ ধরনের বিলম্ব যেখানে হয়, সেখানে মৃত্যুদণ্ডের আসামিকে নির্জন সেলে ১৫ থেকে ২০ বছর পর্যন্ত যদি বন্দি রাখা হয়, তাহলে এটি ডাবল (দ্বিগুণ) শাস্তি। নির্জন কক্ষে বসবাস তার সাজা নয়, সাজা মৃত্যুদণ্ড। ভারতীয় সুপ্রিমকোর্টও এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দিয়েছেন। ভারতের ওই রায় আমাদের রায় দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক ভূমিকা পালন করেছে।
অ্যাটর্নি জেনারেল অমিত তালুকদারের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন,রায়ের বিষয়টি অ্যাটর্নি জেনারেলকে অবহিত করা হয়েছে। তিনি আপিলের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন।এদিকে হাইকোর্টের এই রায়কে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত বলে উল্লেখ করেছেন বিশিষ্ট আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক। তিনি সোমবার বলেন, বিচারিক আদালত যখন মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন তখন ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী মৃত্যুদণ্ড নিশ্চিত করতে অভিযুক্ত ব্যক্তি না করলে সরকারকেই আপিল করতে হয়। শুনানির পর ওই রায় হাইকোর্ট বহাল রাখলে পরে আপিল বিভাগে আপিল করতে হয়। এমন অবস্থায় সাধারণত বিচারিক আদালতের রায়ের পর আপিল বিভাগ পর্যন্ত বিচার শেষ হতে কমপক্ষে দশ বছর সময় লেগে যায়।
তিনি বলেন, এই দীর্ঘ সময় অভিযুক্তকে কনডেম সেলে রাখা তার প্রতি নিষ্ঠুর ও অমানবিক আচরণ করা। এটা সংবিধানের ৩৫(৫) অনুচ্ছেদে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। শাহদীন মালিক বলেন, এটা ব্রিটিশ আমলে মধ্যযুগীয় ব্যবস্থায় ছিল। হাইকোর্ট এ ব্যবস্থা বাতিল করে রায় দিয়েছেন যা অত্যন্ত ইতিবাচক সিদ্ধান্ত। আমি আশা করব যে, সরকার এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করবে না।সুপ্রিমকোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ বলেন, বর্তমান প্রেক্ষাপটে এ ধরনের আইনগুলো পরিবর্তন হওয়া দরকার। কারণ এখন ৩০ বছরেও মামলা নিষ্পত্তি হয় না। তিনি বলেন, বিচারিক আদালতে একজনের মৃত্যুদণ্ড হলো, আর তাকে ২০ বছর কনডেম সেলে রেখে দেবেন এটা আইনের যে মূল স্পিরিট তার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল না। এই আইনের সংশোধন দরকার ছিল। আদালত সেই কারণেই হয়তো বলেছেন, সব ধরনের বিচারিক ও প্রশাসনিক প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার আগে মৃত্যুদণ্ডাদেশ পাওয়া দণ্ডিতকে কনডেম সেল বা নির্জন কারাকক্ষে রাখা যাবে না। মনজিল মোরসেদ বলেন, আমাদের দেশের কনডেম সেলের অবস্থা খুবই নাজুক। বিডিআর বিদ্রোহের মামলায় কত লোকের মৃত্যুদণ্ড হয়েছে, এত লোক রাখার জায়গাও কারাগারে নেই। এগুলো তো সরকারের দেখার কথা ছিল।রিট আবেদনকারীরা হলেন, চট্টগ্রাম কারাগারের কনডেম সেলে থাকা সাতকানিয়ার জিল্লুর রহমান, সিলেট কারাগারে থাকা সুনামগঞ্জের আব্দুল বশির ও কুমিল্লা কারাগারে থাকা খাগড়াছড়ির শাহ আলম। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত এই তিন আসামির আপিল হাইকোর্ট বিভাগে বিচারাধীন রয়েছে।