ইন্টারনেট ও সোশ্যাল মিডিয়ার অপব্যবহার করে ছেলেরা পিছিয়ে - Alokitobarta
আজ : বুধবার, ১৯শে নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ৪ঠা অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

ইন্টারনেট ও সোশ্যাল মিডিয়ার অপব্যবহার করে ছেলেরা পিছিয়ে


মু.এবি সিদ্দীক ভুঁইয়া :চলতি বছরের এসএসসি ও সমমান পরীক্ষার প্রকাশিত ফলাফলে সবদিক দিয়ে এগিয়ে মেয়েরা। ছেলেদের ৮১ দশমিক ৫৭ শতাংশের বিপরীতে মেয়েদের পাসের হার ৮৪ দশমিক ৪৭ শতাংশ। ফল প্রকাশ অনুষ্ঠানে খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও ছেলেদের পিছিয়ে পড়ার কারণ অনুসন্ধানের তাগিদ দিয়েছেন।শেখ হাসিনা বলেন, ইদানীং দেখা যাচ্ছে কিশোর গ্যাং, কেন ছেলেমেয়েরা এ পথে যাবে, এটা তো গ্রহণযোগ্য নয়। তাদের পড়াশোনা করা দরকার, তারা কাজ করতে পারে, বিভিন্ন কাজে যোগ দিতে পারে। কিন্তু এ লাইনে (কিশোর গ্যাং) কেন গেলো, সেটা আমাদের বের করতে হবে। সেখান থেকে তাদের বিরত করা, তাদের একটা সুস্থ পরিবেশে নিয়ে আসা, সেটা আমাদের করতে হবে।আমাদের ছেলে শিক্ষার্থীরা এখন ব্যাপকহারে ইন্টারনেট ও সোশ্যাল মিডিয়ার মিসইউজ (অপব্যবহার) করছে। তারা গেমিংয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পার করছে। এতে পড়ার সময় তো নষ্ট হচ্ছেই। পাশাপাশি পড়ালেখায়ও অমনোযোগী হয়ে পড়ছে।জিপিএ-৫ পাওয়ার ক্ষেত্রেও এগিয়ে মেয়েরা। ৯৮ হাজার ৭৭৬ জন জিপিএ-৫ প্রাপ্ত মেয়ের বিপরীতে ছেলে ৮৩ হাজার ৩৫৩ জন।কয়েক বছর ধরেই পাবলিক পরীক্ষার ফলাফলে দেখা যাচ্ছে একই রকম চিত্র। ছাত্রীদের এগিয়ে যাওয়াকে সবাই ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন।তবে ছাত্ররা ক্রমেই কেন এত পিছিয়ে পড়ছে, তা নিয়েও বাড়ছে দুশ্চিন্তা।

ছেলেদের পিছিয়ে পড়ার কারণ কী? বিষয়টি নিয়ে কথা হয় শিক্ষাবিদ, শিক্ষক ও মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে। তাদের মতে, ছেলেদের পিছিয়ে পড়ার পেছনে মোবাইল ফোন, ইলেকট্রনিক ডিভাইস ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মাত্রাতিরিক্ত সময় ব্যয় করা প্রধানত দায়ী।

তারা বলছেন,ছেলেরা আগেও বাইরে ঘোরাফেরা করতো।তবে বাসায় ফিরে পড়তে বসতো। এখন বাইরে ঘোরাঘুরির পাশাপাশি বাসায় ফিরে মোবাইল ফোনে ডুবে যাচ্ছে। স্কুলপড়ুয়ারা অতি মাত্রায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করায় পড়ালেখায় মনোযোগী হতে পারছে না। ছাত্রীদের চেয়ে ছাত্ররা মোবাইল ফোন ব্যবহারের বেশি সুযোগ পাচ্ছে। পাশাপাশি কিশোর অপরাধে জড়িয়ে পড়াও ছেলেদের পিছিয়ে পড়ার অন্যতম কারণ।

শিক্ষকরাও শিক্ষাবিদদের সুরেই প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। তারা বলছেন,ছাত্রীদের মধ্যে তারা পড়াশোনায় বেশি আগ্রহ দেখছেন। আর ছেলে সন্তানদের চেয়ে মেয়েরা পড়াশোনায় আগ্রহী হয়ে ওঠায় তাদের পড়াশোনায় বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন বাবা-মাও। এমনকি মেয়েদের লেখাপড়ায় অভিভাবকরা বেশি ব্যয় করতেও দ্বিধা করছেন না।স্কুলপড়ুয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে মোবাইল ফোন ব্যবহারের প্রবণতা বাড়ছে। এতে তারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আসক্ত হয়ে পড়ছে। ফলে মনোযোগ হারাচ্ছে পড়াশোনায়।সবকিছুর একটা বয়স ও সময় আছে। একেবারে ষষ্ঠ-সপ্তম শ্রেণিতে পড়ুয়া একজন ছাত্রের হাতে যখন স্মার্টফোন দেওয়া হচ্ছে, তখন সে এটার সঠিক ব্যবহার কতটা করবে সে প্রশ্ন থেকে যায়।- অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দীন আহমদ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমিরেটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন,ছেলেরা পড়ছে কম, বাইরে ঘুরছে বেশি। ঘরে থাকলেও মোবাইল ফোনে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ডুবে থাকছে। আমি কয়েকটি জরিপ দেখেছি, নিজেও পর্যবেক্ষণ করেছি, স্কুলপড়ুয়া ছেলেটার হাতে বাবা-মা মোবাইল তুলে দিচ্ছে। কিন্তু মেয়েটার হাতে দিচ্ছে না। হয়তো অন্য কোনো চিন্তা থেকে দিচ্ছে না। তাতে মেয়েটা পড়াশোনায় মনোযোগ দিচ্ছে। আর ছেলেটা ফেসবুক, গেমিংয়ে সেটা ব্যবহার করছে। এভাবে ছেলেরা পড়ালেখায় ক্রমে চরম অমনোযোগী হয়ে পড়ছে।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও গণসাক্ষরতা অভিযানের প্রধান নির্বাহী রাশেদা কে চৌধুরী বলেন,আমাদের ছেলে শিক্ষার্থীরা এখন ব্যাপকহারে ইন্টারনেট ও সোশ্যাল মিডিয়ার মিসইউজ (অপব্যবহার) করছে। তারা গেমিংয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পার করছে। এতে পড়ার সময় তো নষ্ট হচ্ছেই। পাশাপাশি পড়ালেখায়ও অমনোযোগী হয়ে পড়ছে।

অতি মাত্রায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারে স্কুলপড়ুয়া শিক্ষার্থীরা পড়ালেখায় অমনোযোগী হয়ে পড়ছে বলে মনে করেন জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দীন আহমদও। তিনি বলেন, ‘সবকিছুর একটা বয়স ও সময় আছে। একেবারে ষষ্ঠ-সপ্তম শ্রেণিতে পড়ুয়া একজন ছাত্রের হাতে যখন স্মার্টফোন দেওয়া হচ্ছে, তখন সে এটার সঠিক ব্যবহার কতটা করবে সে প্রশ্ন থেকে যায়।

রাজশাহী গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাইস্কুল থেকে এবার এসএসসি পাস করেছে রিয়াজুল হক। ফলাফল আশানুরূপ না হওয়ায় তার মা রেবেকা সুলতানার মন খারাপ। তিনি বলেন,ছেলেটা অনেক মেধাবী। কিন্তু ঠিকমতো পড়ালেখা না করায় রেজাল্ট খুব ভালো হলো না। আমার ছেলেটা বাইরে বের হয় না। মোবাইল নিয়ে পড়ে থাকে। বকাঝকা করলে মন খারাপ করে। বাধ্য হয়ে মোবাইল ব্যবহার করতে দেই।

ক্লাস ছেড়ে কিশোর গ্যাংয়ে স্কুলপড়ুয়ারা
স্কুলপড়ুয়াদের মধ্যে কিশোর অপরাধে জড়ানোর প্রবণতা বেড়েছে। ক্লাস ছেড়ে কিশোররা দলবেঁধে ঘুরছে পাড়া-মহল্লায়—এমন চিত্র চোখে পড়ছে সব এলাকায়। অনেকে কম বয়সে জড়িয়ে পড়ছে রাজনীতিতেও। এতে মেধাবী ছাত্ররা পড়ালেখাবিমুখ হয়ে পড়ছে।

এ প্রসঙ্গে গণসাক্ষরতা অভিযানের প্রধান নির্বাহী রাশেদা কে চৌধুরী বলেন,ছেলেরা এখন অল্প বয়সে হিরোইজম দেখাতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে। তারা কিশোর গ্যাং গড়ে তুলছে। হিরোইজম দেখাতে অনেক ছেলে বাবা-মাকেও তোয়াক্কা করছে না। মেয়েদের মধ্যে যে মূল্যবোধ নিয়ে সচেতনতা বেড়েছে, সেটা ছেলেদের মধ্যেও ছড়িয়ে দিতে হবে। তাদের পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় দায়বদ্ধতা বোঝাতে হবে। তাহলে ছেলেরাও সমানতালে শিক্ষায় এগিয়ে যাবে।

অভিভাবকরাও ছেলেসন্তান নিয়ে এমন অভিজ্ঞতার কথা জানান। রাজধানীর মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের একজন অভিভাবক বলেন, ছেলেটা এসএসসিতে জিপিএ-৪.৩৮ পেয়েছে। পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে মিশে ও পড়াশোনায় পিছিয়ে পড়েছে। যদি বাইরের ছেলেদের সঙ্গে না মিশে পড়াশোনাটা ঠিকমতো করতো, ও নিশ্চয়ই জিপিএ-৫ পেতো।

মনোরোগবিদ ডা. হেলাল উদ্দীন আহমদ বলেন, কিশোররা এখন হিরোইজম দেখাতে চায়। ভিনদেশি সংস্কৃতিতে বেশি আকৃষ্ট হচ্ছে ওরা। এজন্য কিশোর গ্যাংয়ে জড়িয়ে পড়ে। ওখানে হিরোইজম দেখানোর সুযোগ পায়। ধীরে ধীরে তারা বড় বড় অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। এতে শিক্ষাক্ষেত্রে ছেলেরা পিছিয়ে পড়ছে। অভিভাবকদের সচেতন হওয়া ছাড়া এ থেকে পরিত্রাণের উপায় নেই।

নারী শিক্ষা নিয়ে সচেতনতা বেড়েছে
ছাত্রীদের মধ্যে সচেতনতা বেড়েছে, দেশের শিক্ষার জগতে তার প্রভাব পড়তে শুরু করেছে বলে মনে করেন অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এ ইমিরেটাস অধ্যাপক বলেন, ‘মেয়েদের কেন পড়তে হবে, স্বাবলম্বী হতে হবে; তা নিয়ে তো বাংলাদেশে কয়েক দশক ধরে খুব নিবিড়ভাবে কাজ হয়েছে, এখনো হচ্ছে। সেটার তো একটা বড় প্রভাব রয়েছে। এটাই কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেখা যাচ্ছে। এসএসসি, এইচএসসি বলেন, আর উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে বলেন, মেয়েরা খুব দারুণভাবে নিজেদের অবস্থান জানান দিচ্ছে।

মেয়েদের পড়ালেখায় মনোযোগী হওয়ার পেছনে পারিবারিক দায়বদ্ধতাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে বলে মনে করেন রাশেদা কে চৌধুরী। তিনি বলেন,এখনো একটা মেয়েকে পড়াশোনা করতে অনেক কষ্টের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। উদাহরণ দিয়ে যদি বলি ছেলেরা অনেক সময় সাইকেলে চড়ে স্কুলে চলে যায়। সেক্ষেত্রে একটা মেয়েকে রিকশা, ভ্যান বা গাড়িতে চড়তে হয়। পরিবার সেই খরচটা বহন করে। পরিবার যে তার পেছনে ব্যয় করছে, তা নিয়ে অনেক মেয়ে ভাবে। এ দায়বদ্ধতা থেকেও গ্রাম, এমনকি শহরের অনেক মেয়েও পড়ালেখায় মনোযোগী হয়।

মেয়েদের এই এগিয়ে যাওয়াকে বাঁকা চোখে না দেখার আহ্বান জানিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. সিদ্দিকুর রহমান। তিনি বলেন, ‘মেয়েরা এগোলে সামনে ছেলেরাও এগোবে। কারণ মা শিক্ষিত সচেতন হলে সেই জাতিও শিক্ষিত জাতিতে পরিণত হবে। তবে হ্যাঁ, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ভারসাম্য ঠিক রাখতে ছেলেদেরও পড়ালেখা, কর্মক্ষেত্র সব জায়গায় সমানতালে এগোতে হবে।

রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের বসুন্ধরা শাখার ছাত্রী আন্বিষা আক্তার উষা। এবার এসএসসি পরীক্ষায় সব বিষয়ে জিপিএ-৫ পেয়েছে সে। উষার বাবা অহিদুল ইসলাম একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। মেয়ে ভালো ফল করায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে স্ট্যাটাস দিয়েছেন তিনি।

অহিদুল ইসলাম বলেন, ‘মেয়েকে অনেক কষ্টে পড়িয়েছি। ভিকারুননিসায় পড়াতে বেশ খরচ। আমার আয় কম। তারপরও মেয়েকে সাধ্যমতো টিউশন দিয়েছি। ওর আগ্রহও অনেক। নবম ও দশম দুই শ্রেণিতেই ও ভালো করে পড়েছে। কোনো সময় গ্যাপ দেয়নি। পড়াশোনার প্রতি ওর যে ঝোঁক তা দেখে, আমরা ওকে ডাক্তারি পড়াতে চাই।

ছাত্রদের চেয়ে পড়ালেখায় ছাত্রীরা বেশি আগ্রহী হওয়ায় ফলাফলেও তাদের অবস্থান ভালো বলে মনে করেন শিক্ষকরা। ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষক জগদীশ চন্দ্র পাল বলেন, ‘ছাত্রীদের পড়াশোনায় আগ্রহটা বেশি দেখা যায়। আমাদের এখানে সব ছাত্রী। তাদের মধ্যে একে-অন্যের চেয়ে কীভাবে ভালো ফলাফল করবে, তা নিয়ে প্রতিযোগিতা বেশি। এজন্য বরাবরই তারা ভালো করছেন।

মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষক রেজোয়ান মল্লিক বলেন, ছাত্রীরা ক্লাসে যেমন মনোযোগী, আবার বাসায় পড়ালেখার ক্ষেত্রে মনোযোগী। সেই তুলনায় ছাত্রদের মনোযোগ কম। অনেকে মেধাবী কিন্তু ক্লাসে মনোযোগ না থাকায় পিছিয়ে পড়ে।

Top