তিন লাখ ভুয়া উপকারভোগী চিহ্নিত,কালো থাবা ১০ টাকার চালে
মোহাম্মাদ আবুবকর সিদ্দীক ভুঁইয়া:বিঘা বিঘা জমি, দোতলা বাসভবন,কোটি টাকার সম্পদ,সচ্ছল ব্যবসায়ী, চেয়ারম্যান-মেম্বারদের আত্মীয়স্বজনরা পাচ্ছে ‘খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির’ সুবিধা। প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ উদ্যোগের ১০ টাকা কেজি চাল তুলে নিয়মবহির্ভূতভাবে বিক্রি করে দিচ্ছে, কেউবা পুকুরের মাছকে খাওয়াচ্ছেন। একজনের পরিচয়পত্র দিয়ে তোলা হচ্ছে অন্যজনের চাল, ভূতুরে নামও ব্যবহার হচ্ছে। অনুসন্ধানে এমন চিত্র মিলেছে দেশের বিভিন্ন এলাকায়। ফলে বিশাল ভর্তুকি দিলেও প্রকৃত গরিবদের কাছে যাচ্ছে না সুবিধা। অনেকে একে ‘খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির’ বদলে ‘মেম্বার-চেয়ারম্যানবান্ধব কর্মসূচি’ হিসেবে অভিহিত করছেন। জেলা-উপজেলা পর্যায়ের কর্মকর্তারা বলছেন, চেয়ারম্যান-মেম্বাররা তালিকা করেন। প্রশাসনের কাছে অভিযোগ এলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেন তারা।খাদ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শেখ মুজিবর রহমানের কাছে এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিষয়টি কেন্দ্রীয়ভাবে দেখভাল করেন অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক। অতিরিক্ত মহাপরিচালক আব্দুল্লাহ আল মামুন খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির বিভিন্ন অনিয়মের কথা স্বীকার করেন। তিনি বলেন, অ্যানালগ পদ্ধতি থাকায় অনেক অনিয়ম বিভিন্নভাবে হচ্ছিল। এখন ছবিযুক্ত পরিচয়পত্র করা হয়েছে। এতে অনেক অনিয়ম কমেছে। তিনি বলেন, চাল বিতরণ প্রক্রিয়া আরও স্বচ্ছ করতে প্রযুক্তিগত উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয়ভাবে সফটওয়্যার তৈরির কাজ এগিয়ে গেছে। এখন ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারে উপকারভোগীদের তথ্য আপলোড করার মাধ্যমে প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হবে। এ কর্মকর্তা আরও জানান, এই প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হলে প্রকৃত উপকারভোগী আরও সুনির্দিষ্ট হবে, দূর হবে অনিয়ম।দেশের অতি দরিদ্র পরিবারের খাদ্য সমস্যার কথা চিন্তা করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে ১০ টাকা কেজিতে চাল বিক্রি শুরু হয়। ২০১৬ সাল থেকে ৫০ লাখ মানুষ এই সুবিধা পাচ্ছেন। মার্চ-এপ্রিল ও সেপ্টেম্বর-অক্টোবর-নভেম্বর এই পাঁচ মাস ১০ টাকা তথা শুভেচ্ছা মূল্যে তালিকাভুক্ত পরিবারকে মাসে ৩০ কেজি করে চাল দেওয়া হয়। এর মাধ্যমে গ্রামের দরিদ্র মানুষেরা অভাবের সময়ে কম দামে চাল পায়। কিন্তু এতে সমস্যা সৃষ্টি করছে বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতি। খাদ্য অধিদপ্তরের এক পরিচালক জানান, গত বছরের শুরুর দিকে সাড়ে তিন লাখের বেশি ভুয়া কার্ডধারী শনাক্ত করা হয়। সেখানে প্রকৃত উপকারভোগী নির্বাচন করা হয়েছে। এখনো অনিয়ম একেবারেই নেই তা বলা যাবে না। তবে অনিয়ম দুর্নীতি রোধের চেষ্টা চলছে।
নাটোরের বড়াইগ্রামের নগর ইউনিয়নের থানাইখাড়া গ্রামের বাসিন্দা আরিফ আলীর (৪২) দোতলা বাড়ি, ৫ বিঘা জমি, গোডাউনসহ একাধিক ব্যবসা আছে। প্রায় কোটি টাকার মালিক এ ব্যবসায়ীর নামে রয়েছে ১০ টাকা কেজির খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির কার্ড। একই উপজেলার চান্দাই ইউনিয়নের দিয়ার গাড়ফা গ্রামের মোহাম্মদ আনোয়ারের (কার্ড নং ৩২৩) নামে নিয়মিত চাল তোলা হলেও তার নামে কোনো কার্ড হয়েছে এমনটি জানা নেই তার। নগর ইউনিয়নের বড়দেহা গ্রামের শুকুমুদ্দিন প্রামাণিকের স্ত্রী আমেরজান বেগম (কার্ড নং ৪০৮) দুই বছর আগে মারা গেলেও চাল উঠছে তার নামে। একই গ্রামের কার্ডধারী শাহিদুল ইসলামের স্ত্রী শাহনাজ পারভীন এবং রহমত আলীর ছেলে কাজল আলীর খোঁজ মেলেনি। ওই গ্রামের মতিউর রহমানের পুকুরসহ ১০ বিঘা জমি থাকলেও তিনি দিনমজুর পরিচয়ে খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির চাল তুলে পুকুরের মাছকে খাওয়াচ্ছেন বলে অভিযোগ আছে। বড়াইগ্রাম উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা আফরোজা পারভীন বলেন, এমন অভিযোগ আগে পাইনি। আমি এ ব্যাপারে খোঁজ নেব।
খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির চাল ডিলার পয়েন্ট থেকে তুলে বিক্রি করে দেওয়ার অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে ময়মনসিংহের ফুলপুর উপজেলার সিংহেশ্বর বাজারে। স্থানীয় ওই বাজারের শহীদুল নামের এক ব্যবসায়ীর ঘরে কয়েক টন খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির চাল পাওয়া যায়। এই ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটি সরেজমিন তদন্ত করে প্রতিবেদন দিয়েছে। প্রতিবেদনের একটি কপি যুগান্তরের কাছে রয়েছে। এতে দেখা যায়, যে ব্যক্তির ঘরে খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির চাল পাওয়া গেছে তাকে ও যারা চাল বিক্রি করেছে তাদেরও দোষী সাব্যস্ত করে তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদনে উভয়পক্ষের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে সুপারিশ করা হয়। তদন্ত কার্যক্রমে যুক্ত এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, যেখানে সঠিক উপকারভোগীর কাছে কার্ড যায় না সেখানে তারা কার্ড বিক্রি করে দেয়। অনেকেই এটা করে। কার্ড বরাদ্দের বিষয়ে আরও যাচাই-বাছাই হওয়া দরকার।হামাগরে থাকবার জায়গাও নাই, তাহোও হামরা পাওছি না ১০ টাকা কেজির চাল। যার আবাদি জমি, পাকা বাড়ি আছে-ওরায় পাওছে এই চাল।’ চরম অভাবে থাকলেও সরকারের খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির ১০ টাকা কেজির চাল না পেয়ে এমনই কথা জানালেন দিনাজপুরের বিরামপুর উপজেলার আদর্শ গুচ্ছগ্রামের আশ্রিত ৮০ বছরের বৃদ্ধ সৈয়দ আলী। বয়সের ভারে ন্যুয়ে পড়া এই উপার্জন অক্ষম বৃদ্ধ জানালেন, বাড়ির অবস্থা যাই থাক, চেয়ারম্যান-মেম্বারের লোক হলেই পাওয়া যায় ১০ টাকা কেজি চালের কার্ড। বিরামপুর উপজেলার জোতবানী ইউনিয়নের ১নং ওয়ার্ডের মঙ্গলপুর গ্রামের তানভীর হোসেনের রয়েছে ছয় বিঘা আবাদি জমি, আবু হোসেনের তিন বিঘা, বাবু মিয়ার তিন বিঘা, ধনসা গ্রামের আনিছুর রহমানের পাঁচ বিঘা আবাদি জমি থাকলেও প্রত্যেকেই পাচ্ছেন ১০ টাকা কেজির চাল। এদের কারও কারও আছে পাকা বাড়িও। এ বিষয়ে জোতবানী ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ভুলবশত কোনো মেম্বার এই কার্ড দিয়ে থাকলে তা বাতিল করা হবে।
কেন সঠিক উপকারভোগীর হাতে খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির কার্ড যাচ্ছে না, এমন প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে দেশের একাধিক জেলা ও উপজেলার খাদ্য কর্মকর্তার সঙ্গে কথা হয়েছে এ প্রতিবেদকের। মৌলভীবাজার জেলার একটি উপজেলার খাদ্য কর্মকর্তা বলেন, শুধু খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির নয়, সামাজিক নিরাপত্তার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে যেসব তালিকা স্থানীয় ইউনিয়ন চেয়ারম্যান-মেম্বাররা করেন। সেখানে সংসদ সদস্য ও উপজেলা চেয়ারম্যানরাও প্রভাব খাটিয়ে নিজেদের লোক ঢুকান। কিন্তু মূল দোষ পড়ে চেয়ারম্যান-মেম্বারদের ওপর।হবিগঞ্জের বানিয়াচং উপজেলার হাওরাঞ্চল সুজাতপুর ইউনিয়নের শতমুখা গ্রামের বাসিন্দা আব্দুল হান্নানের স্ত্রী মমতাজ বেগম অন্যের জায়গায় ঘর বানিয়ে থাকেন। বৃদ্ধ স্বামী কোনো কাজ করতে পারেন না। কানেও ঠিকমতো শুনতে পান না। তার একমাত্র ছেলে হকার। তার সামান্য আয় থেকেই সংসার চলে। মমতাজ বেগম যুগান্তরকে বলেন, কখনোই সরকারি বরাদ্দের চাল পাইনি। চেয়ারম্যান, মেম্বারদের কাছে গেলে তারা বলেন, চাল দেয়া শেষ হয়ে গেছে। আর কত দরিদ্র হলে সরকারি চাল পাওয়া যায় জানি না।প্রকৃতপক্ষে এসব তদারকি করতে উপজেলা প্রশাসনের দায়িত্ব থাকলেও ইউএনওরা তা করতে পারেন না। তারা দায়িত্ব দেন সংশ্লিষ্টদের। অনেক ট্যাগ অফিসার এলাকায় থাকেন না, অনেক এলাকায় প্রভাবশালী ডিলার ও চেয়ারম্যানদের সঙ্গে বিরোধে যেতে চান না তারা। ফলে প্রকৃত উপকার ভোগীদের সুবিধা পাওয়া অনেক কঠিন। এমন দাবি করেছেন জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের খাদ্য কর্মকর্তারা। এ বিষয়ে হবিগঞ্জের রাজনগর উপজেলা খাদ্য কর্মকর্তা (অতিরিক্ত দায়িত্ব) বিনয় কুমার দেব যুগান্তরকে বলেন, ট্যাগ অফিসাররা খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির পাশাপাশি অন্যান্য দায়িত্বে থাকায় যথানিয়মে সময় দিতে কিছুটা হলেও বেগ পেতে হয়।নাটোরের নলডাঙ্গা উপজেলায় খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির কার্ড নবায়নে ভোক্তাপ্রতি ১৫০ টাকা পর্যন্ত উৎকোচ নেওয়ার অভিযোগ প্রমাণ হয়েছে। উপজেলার পশ্চিম মাধনগর গ্রামের এরশাদ সরদার বলেন, ডিলার তার কাছ থেকে ১২০ টাকা আদায় করেছেন। এ টাকা দিতে না চাইলে কার্ড বাতিলের হুমকি দেওয়া হয়। মাধনগর ইউনিয়নের অভিযুক্ত ডিলার মঞ্জুর আলম কার্ড নবায়নের জন্য টাকা নেওয়ার কথা স্বীকার করেছেন। তিনি যুগান্তরকে বলেন, কিছু কর্মচারীর আদায় করা টাকা ভুক্তভোগীদের ফেরত দেওয়া হয়েছে। পাটুল হাপানিয়া গ্রামের রশিদা বেগমের স্বামী আশরাফুল ইসলাম বলেন, উপজেলা খাদ্য কর্মকর্তার কার্যালয়ে তার স্ত্রীর নবায়ন করা কার্ড নিতে গেলেও ১০০ টাকা আদায় করা হয়েছে। তবে উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক রওশানুল কাওছার এ অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, ডিলারদের অফিস খরচ বাবদ টাকা নেওয়ার জন্য আমি কিছু বলিনি।গত ২০ এপ্রিল টাঙ্গাইলের গোপালপুর উপজেলার আলমনগর মধ্যপাড়ায় খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির ৬০ বস্তা চাল জব্ধ হয়েছে। গোপালপুর উপজেলার চাতুটিয়ার মধ্যপাড়ার লাল মিয়ার বাড়ি থেকে উদ্ধার করা হয়েছে ৭৬ বস্তা। এ ঘটনায় উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক কর্মকর্তা আবদুল্লাহ ইবনে হুসাইন বাদী হয়ে থানায় মামলা দায়ের করেছেন। এছাড়া গত ৮ নভেম্বর টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার উপজেলার ছিলিমপুর বাজারের একটি পাটের গুদাম থেকে ৭৩ বস্তা খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির চাল উদ্ধার করেছে র্যাব। এ সময় দুজনকে গ্রেফতারও করা হয়েছে। জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক কামাল হোসেন বলেন, ১০ টাকা কেজি দরের চালের কার্ডের তালিকা জনপ্রতিনিধিরা করছে। তারা স্বজনপ্রীতি করতে পারে। অভিযোগ পেলে আমরা ব্যবস্থা নিই।
** প্রতিবেদনটি তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন টাঙ্গাইল, নাটোর, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, নাটোর (বড়াইগ্রাম) ও দিনাজপুর প্রতিনিধি।