অবৈধ বাংলাদেশিদের বৈধতা দেওয়ার সম্ভাবনা
মোহাম্মাদ আবুবকর সিদ্দীক ভুঁইয়া :ভারত মহাসাগরের দেশ মালদ্বীপে বসবাসকারী বাংলাদেশিদের দুঃখের দিন শেষ হওয়ার পথে। সেখানে বসবাসকারী বাংলাদেশিরা বেশকিছু সুখবরের আশায় বুক বেঁধে আছেন। আছে অবৈধ বাংলাদেশিদের বৈধতা দেওয়ার সম্ভাবনাও। চিকিৎসকসহ নানা খাতে দক্ষ ও অদক্ষ কর্মী নিয়োগের মাধ্যমে শ্রমবাজার চাঙা হবে। এছাড়া সেখানে তৈরি পোশাকসহ নানা ধরনের পণ্য রপ্তানির সুযোগ তৈরির সম্ভাবনা আছে। এ নিয়ে আনন্দে ভাসছে মালদ্বীপে বসবাসকারী প্রায় এক লাখ বাংলাদেশি। তাদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে আছে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারি সফর। তাদের প্রত্যাশা-প্রধানমন্ত্রীর এই সফরেই দুঃখ ঘুচবে তাদের, সমস্যাগুলোর সমাধান হবে। বাংলাদেশি ডাক্তার, নার্স আর পর্যটন খাতসংশ্লিষ্ট লাখ লাখ দক্ষ কর্মী নিয়োগের অপার সম্ভাবনার খবর আসবে বলে আশায় আছেন তারা। সম্প্রতি ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের এক অনুষ্ঠানে বাংলাদেশি সাংবাদিকদের পেয়ে সেখানে বসবাসরত বাংলাদেশিরা জানান এসব তথ্য।এদিকে বাসস জানিয়েছে, মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম মোহাম্মদ সলিহর আমন্ত্রণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছয় দিনের সরকারি সফরে আজ দুপুরে মালের উদ্দেশে ঢাকা ছেড়ে যাবেন। শেখ হাসিনার মালদ্বীপ সফরকালে ২৩ ডিসেম্বর স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বন্দিবিনিময়, দ্বৈত কর পরিহারসহ দুটি চুক্তি এবং দুটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হতে পারে। সফরের সময় বিভিন্ন স্থানে সরেজমিন জানা যায়, কমপক্ষে এক লাখ বাংলাদেশি দেশটির রাজধানী মালে, আশপাশের এলাকা ও দ্বীপের রিসোর্টগুলোয় কাজ করেন। এশিয়া মহাদেশের ছোট এই দেশে ১ হাজার ১৯২টি ক্ষুদ্র দ্বীপ আছে। এর মধ্যে কেবল ২০০টিই বাসযোগ্য। বিচ্ছিন্ন এসব দ্বীপে নজরকাড়া রিসোর্টসহ পর্যটনবান্ধব সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা রয়েছে।মালদ্বীপে বাংলাদেশের হাইকমিশনার রিয়ার অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ নাজমুল হাসানও প্রায় একই ধরনের তথ্য দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, মালদ্বীপে সব মিলিয়ে বাংলাদেশি কর্মীর সংখ্যা প্রায় এক লাখ। তাদের মধ্যে ৫০ হাজারই এখন অনিয়মিত। তারা এখানে কাজ করলেও ওয়ার্ক পারমিট নেই। ২০১৯ সালে মালদ্বীপ সরকার একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তারা এক বছর বাংলাদেশ থেকে কোনো কর্মী নেবে না। সেই এক বছর পার হয়ে গেছে। সিদ্ধান্তটি এরই মধ্যে বাতিল হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু আমরা জেনেছি সিদ্ধান্তটি এখনো বহাল আছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারি সফরের পর অনেক সম্ভাবনার দুয়ার খুলে যাবে। হাইকমিশনের পক্ষ থেকেও এ বিষয়ে জোর তৎপরতা চালানো হচ্ছে।নাজমুল হাসান বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশকে টপকে ইতোমধ্যে পর্যটনশিল্পে শীর্ষস্থানীয় দেশ হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছে মালদ্বীপ। ৫ লাখেরও কম জনসংখ্যার দেশটিকে ওয়ার্ল্ড বেস্ট ট্যুরিস্ট ডেস্টিনেশন হিসাবে ঘোষণা করেছে ওয়ার্ল্ড ট্যুরিজম অর্গানাইজেশন। ২০২০ সালে এই ঘোষণা দেয় সংগঠনটি।মালদ্বীপে বাংলাদেশিদের কাজের সুযোগের বিষয়ে নাজমুল হাসান বলেন, এখানে কর্মরত বাংলাদেশিরা দেশটির অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছেন। এটি মালদ্বীপ সরকারও স্বীকার করে। তাদের অবকাঠামো, ফিশিং, পর্যটনসহ সব খাতেই বাংলাদেশি কর্মীরা আছেন। অনেক ক্ষেত্রে বাংলাদেশিরা এখানে যেসব কাজ করেন, সেটা অন্যদেশের কর্মীরা করতে চান না। মালদ্বীপে সামনে অবকাঠামো খাতে অনেক প্রকল্প শুরু হবে। আমি মনে করি, এক্ষেত্রে বাংলাদেশি কর্মীর বিকল্প নেই। করোনার পর নতুন করে মালদ্বীপের পর্যটন খাত খুলতে শুরু করেছে। এক্ষেত্রেও তাদের অনেক বিদেশি কর্মী লাগবে, যার ভালো জোগান আসতে পারে বাংলাদেশ থেকে।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) ২০২১ সালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২০ সালে মালদ্বীপে ১ লাখ ৮০ হাজার অভিবাসী শ্রমিক কর্মরত ছিলেন। এর মধ্যে অন্তত ৬৫ হাজার অবৈধভাবে কাজ করছেন। এই অবৈধদের মধ্যে একটি বড় অংশ বাংলাদেশ থেকে আসা। এদেশে অভিবাসী শ্রমিকদের ভিসা নিয়োগকর্তার অধীনে। কাজেই নিয়োগকর্তার অনিচ্ছায় কেউ চাকরি ছাড়লেই তিনি অবৈধ হয়ে পড়েন।মালদ্বীপের হোটেল, রিসোর্ট, কাপড়ের দোকান, চা-কফির দোকানগুলোর প্রায় প্রতিটিতেই একাধিক বাংলাদেশি কর্মীকে কাজ করতে দেখা গেছে। ট্যাক্সি ও অন্যান্য গাড়ির ড্রাইভার পেশায়ও নিয়োজিত আছেন অনেক বাংলাদেশি। গাড়ি মেরামত, ইলেকট্রিশিয়ান, কাঠমিস্ত্রি হিসাবেও কাজ করছেন অনেকে।শ্রমিকদের আসা-যাওয়ার কারণে দেশটিতে নতুন রুট খুলছে এয়ারলাইন্সগুলো। ১৯ নভেম্বর ঢাকা থেকে মালে রুটে ফ্লাইট চালু করে ইউএস-বাংলা। ওই ফ্লাইটের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ইউএস-বাংলার ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুল্লাহ আল মামুন জানান, এতদিন ঢাকা থেকে একবার (ওয়ানওয়ে) মালদ্বীপে যেতে ভাড়া গুনতে হতো ৬৫ হাজার টাকা। ইউএস বাংলা সরাসরি ফ্লাইটের ভাড়া প্রায় অর্ধেকে নামিয়ে এনেছে।এই বিমান সংস্থাটির পাশাপাশি দেশি-বিদেশি আরও একাধিক এয়ারলাইন্স এই রুটে ফ্লাইট চালু করার চিন্তা করছেন বলে জানায় বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)। সংস্থার এক শীর্ষ কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, করোনা মহামারি শেষ হওয়ায় মালদ্বীপ সরকার পর্যটন সেক্টর খুলে দিয়েছে। ফলে বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে হাজার হাজার পর্যটক এখন মালদ্বীপ যাচ্ছেন। পর্যটন আইল্যান্ডগুলোয় কাজ করার জন্য বিভিন্ন দেশ থেকে কর্মী নেওয়ারও চিন্তাভাবনা করছে ওই দেশের সরকার। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ যদি এই সুযোগ পায়, তাহলে এয়ারলাইন্সগুলো ফ্লাইট পরিচালনা করে শেষ করতে পারবে না।জানা যায়, ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর থেকে বিভিন্ন দেশের অবৈধ কর্মীদের বৈধ হওয়ার সুযোগ দেয় মালদ্বীপ। তখন ৪০ হাজার অনিয়মিত প্রবাসী কর্মী রেজিস্ট্রেশন করেন। কিন্তু রেজিস্ট্রেশন করলে আটক করে দেশে পাঠিয়ে দিতে পারে-এমন আশঙ্কায় ২০ হাজার কর্মী রেজিস্ট্রেশনই করেননি। তবে রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন হলেও কারও নামে এখনো ওয়ার্ক পারমিট ইস্যু করেনি সরকার। কাজেই বৈধ হওয়ার অপেক্ষায় আছেন প্রায় ৪০ হাজার বাংলাদেশি শ্রমিক।
সরেজমিন মালদ্বীপের বিভিন্ন শপিংমল, রেস্টুরেন্ট, ট্যাক্সিক্যাব চালকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রায় প্রতিটি জায়গায় বাংলাদেশি কর্মী আছেন। মালের বিমানবন্দরে নেমে হোটেলে ফেরার জন্য যে গাড়িটি ভাড়া করা হয়েছিল, তার চালকের বাড়ি মৌলভীবাজারের শায়েস্তাগঞ্জে। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে স্বল্পশিক্ষিত হলেও তিনি বাংলা, হিন্দি, দিবাহি (মালদ্বীপের ভাষা) ও তামিল ভাষায় অনর্গল কথা বলতে পারেন। শিখে নিয়েছেন কাজ চালানোর মতো ইংরেজিও। সাংবাদিকদের তিনি বলেন, মহামারির প্রথম ধাক্কাতেই তাকে দেশে ফিরতে হয়। পর্যটকরা আসতে শুরু করায় চার মাস আগে তিনি মালদ্বীপে পুরোনো পেশায় ফিরতে পেরেছেন।মালের কাপড়ের দোকানের কর্মী আরেক বাংলাদেশি কাউসার জানান, মহামারির শুরুতে চাকরি হারালেও তিনি দেশে ফেরেননি। কারণ তিনি অবৈধভাবে কাজ করছিলেন। তার শঙ্কা ছিল, একবার চলে গেলে আর ফিরতে পারবেন না। জমানো টাকা ভেঙে কিছুদিন কাটিয়েছেন। পরে কাপড়ের দোকানে কাজ করছেন।মালদ্বীপের হুলহুমালে এলাকায় বাংলাদেশ মিশনের কাছেই লমুনেলি রেস্তোরাঁয় কয়েক বছর ধরে কাজ করেন কুমিল্লার মিলন হোসেন। তিনি বলেন, যারা কোম্পানির হয়ে কাজ করছেন, মহামারির মধ্যেও তারা কর্মহীন হননি। কোম্পানিগুলো তাদের থাকা-খাওয়া বাবদ খরচ জুগিয়েছে। এখন আবার কাজের বাজার খুলছে। কিন্তু ২০১৯ সাল থেকে বাংলাদেশের লোক নিচ্ছে না মালদ্বীপ। ফলে কোম্পানিগুলো মাসে ৩০০ ডলার বেতনেও লোক খুঁজে পাচ্ছে না। অন্যদেশ থেকে কর্মীরা আসছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে মালদ্বীপ থেকে বৈধ পথে প্রবাসীরা ২ কোটি ২০ লাখ ১০ হাজার ডলার দেশে পাঠান, যা পরের অর্থবছরে দ্বিগুণ হয়েছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে প্রবাসী আয় এসেছে ৪ কোটি ৪৭ লাখ ৪০ হাজার ডলার। আর গত অর্থবছরে তা সামান্য বেড়ে ৪ কোটি ৬০ লাখ ৩০ হাজার ডলার হয়েছে। অভিবাসন বিশেষজ্ঞ শরিফুল বলেন, মালদ্বীপে বাংলাদেশি শ্রমিকদের একটা বড় অংশ ট্যুরিস্ট ভিসায় অবৈধভাবে কাজ করেন। এ কারণে তারা বেতনভাতাসহ সব ক্ষেত্রেই বঞ্চিত হন। তাদের বৈধ করার পাশাপাশি নতুন অভিবাসী শ্রমিক যাওয়ার বিষয়েও সরকারের দ্রুত উদ্যোগ প্রয়োজন। এক্ষেত্রে প্রবাসী আয় আরও অনেক বাড়বে।