সিরিজ বোমা হামলার ১৬ বছর ১৫৯ মামলার ১১৬টির বিচার সম্পন্ন
আলোকিত বার্তা:আজ ১৭ আগস্ট। সারা দেশে সিরিজ বোমা হামলার ১৬ বছর। ২০০৫ সালে ৬৩ জেলার ৪ শতাধিক স্পটে সিরিজ বোমা হামলা চালিয়ে জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) আত্মপ্রকাশ ঘটে। ওই সময় পুলিশ ও র্যাব সাঁড়াশি অভিযান চালিয়ে জেএমবির সহস্রাধিক সদস্যকে গ্রেফতার করে। ফাঁসি কার্যকর করা হয় সংগঠনের শীর্ষ নেতাদের।চাঞ্চল্যকর ওই ঘটনায় দায়েরকৃত ১৫৯ মামলার মধ্যে ১১৬টির বিচার সম্পন্ন হয়েছে। বিচারাধীন রয়ে গেছে ৪৩টি মামলা। আইন বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, নানা কারণে এসব মামলার বিচারকাজ শেষ করতে দেরি হচ্ছে। অনেক মামলায় আসামিদের নাম-ঠিকানা কিছুই থাকে না। সাক্ষীদেরও ঠিকমতো পাওয়া যায় না। অনেকে সাক্ষ্য দিতেও আসেন না। বেশির ভাগ সাক্ষীর ঠিকানায় গিয়ে তাদের পাওয়া যায় না। এ রকম নানা কারণে মামলা শেষ করতে সময় বেশি লেগে যাচ্ছে। আবার সাক্ষীরা ঠিকমতো না আসায় জঙ্গিদের শাস্তিও সঠিকভাবে হচ্ছে না।আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্র জানিয়েছে, গত ২০ বছরে জঙ্গিদের বিরুদ্ধে সারা দেশে প্রায় দুই হাজার মামলা হয়েছে। এসব মামলায় আসামির সংখ্যা প্রায় নয় হাজার। এদের মধ্যে গ্রেফতার করা হয়েছে প্রায় ৭ হাজার। সূত্র মতে, এই মুহূর্তে জামিনপ্রাপ্ত জঙ্গির সংখ্যা ৩ শতাধিক। এদের মধ্যে দুই শতাধিক জঙ্গি পালিয়ে আছে। প্রায় ১০০ জঙ্গি আদালতে গরহাজির। জামিনপ্রাপ্ত পলাতক জঙ্গিদের নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন পুলিশের একাধিক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা।ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম বলেন, ঢাকা মহানগর এলাকায় ওই সময় (২০০৫ সালে) ১৮টি মামলা হয়েছিল। মামলাগুলো তদন্ত শেষে পুলিশ নয়টিতে চার্জশিট দিয়েছে। অপর নয়টি মামলায় ফাইনাল রিপোর্ট (চূড়ান্ত প্রতিবেদন) জমা দিয়েছে। যে নয়টি মামলায় চার্জশিট দেওয়া হয়েছে সেসবের মধ্যে তিনটি মামলায় সাজা হয়েছে। একটি মামলায় আসামিরা খালাস পেয়েছেন। পাঁচটি মামলা আদালতে বিচারাধীন আছে। তিনি বলেন, করোনা পরিস্থিতির উদ্ভব না ঘটলে হয়তো এতদিনে এই মামলাগুলো নিষ্পত্তি হয়ে যেত। করোনা পরিস্থিতিতে আদালত বন্ধ থাকায় পাঁচটি মামলা বিচারের জন্য পেন্ডিং আছে। এত বছর পর সাক্ষী খুঁজে পাওয়া খুব সহজ কাজ নয় বলে উল্লেখ করেন ডিএমপি কমিশনার।
অ্যান্টি টেরোরিজম ইউনিটের অতিরিক্ত ডিআইজি মনিরুজ্জামান বলেন, ২০০৫ সালের ১৭ আগস্টের ঘটনাসহ বিভিন্ন মামলায় যেসব জঙ্গি জামিন পেয়েছেন তাদের নিয়মিত নজরদারিতে রাখছি। প্রায়ই তাদের স্থায়ী ও বর্তমান ঠিকানায় গিয়ে খোঁজখবর রাখছি। তাদের কেউ কেউ ইতোমধ্যে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছে। যারা পলাতক আছে তারা মাঝে মধ্যেই ধরা পড়ছে। জঙ্গিদের ডাটাবেজ তৈরি করা হয়েছে। গত ২০ বছরে ১৯৪৫ জন জঙ্গিকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বিচার সম্পন্ন হওয়া ১১৬ মামলায় ৩২৫ জন আসামিকে আদালত বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দিয়েছেন। এদের মধ্যে অনেকে সাজা খেটে জেল থেকে বের হয়ে স্বাভাবিক জীবনযাপন করছেন। তাদের স্বাভাবিক জীবনযাপনে পুনর্বাসন করতে পুলিশ চেষ্টা করছে। ইতোমধ্যে সিরিজ বোমা হামলার মামলায় সাজাপ্রাপ্ত ১৯ জন জেএমবি সদস্যকে স্বাভাবিক জীবনযাপনে পুনর্বাসন করা হয়েছে।কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের প্রধান আসাদুজ্জামান বলেন, পুরোনো জেএমবির ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আমির সালাহউদ্দিন সালেহীন এখন ভারতে পলাতক। এছাড়া আরও কিছু জঙ্গি পলাতক আছে। আমরা তাদের সন্ধানে আছি। র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার এ কে খন্দকার আল মঈন বলেন, র্যাবের অভিযানেই জেএমবির প্রধান বা আমির শায়খ আবদুর রহমান, সেকেন্ড ইন কমান্ড সিদ্দিকুল ইসলাম বাংলা ভাইসহ শীর্ষ ৬৭ জঙ্গি নেতা গ্রেফতার হয়। তাদের বিচারের মুখোমুখিও করা হয়েছে।জঙ্গিরা এখন সাইবারের মাধ্যমে তাদের কার্যক্রম চালানোর চেষ্টা করছে। এ ব্যাপারে র্যাবের সাইবার মনিটরিং সেল কাজ করছে। তিনি বলেন, র্যাবের অভিযানে এ পর্যন্ত গ্রেফতার হয়েছেন জেএমবির এক হাজার ৩৭৩ সদস্যসহ দুই হাজার ৬০০ জঙ্গি। উদ্ধার করা হয়েছে বিপুল পরিমাণ গোলাবারুদ। ঢাকা মহানগর আদালতের রাষ্ট্রপক্ষের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) আব্দুল্লাহ আবু বলেন, ঢাকা মহানগরে ২০০৫ সালের ঘটনাগুলোতে দায়ের করা মামলায় বেশ কয়েকজন জঙ্গিকে আদালত বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দিয়েছেন।
কয়েকটি মামলায় সাক্ষ্য গ্রহণের কাজ চলছে। অনেক মামলায় আসামিদের নাম ও ঠিকানা কিছুই নেই বা ছিল না। সাক্ষীদেরও ঠিকমতো পাওয়া যায় না। অনেক সাক্ষী সাক্ষ্য দিতেও আসেন না। বেশির ভাগ সাক্ষীর ঠিকানাও পরিবর্তন হয়েছে। এ রকম নানা কারণে মামলা শেষ করতে সময় বেশি লেগে যাচ্ছে। আবার সাক্ষীরা ঠিকমতো না আসায় জঙ্গিদের শাস্তিও সঠিকভাবে হচ্ছে না।জানা গেছে, ২০০০ সালে দিনাজপুরের বালুবাড়িতে বোমা হামলার মধ্য দিয়ে জেএমবির কার্যক্রম শুরু হয়। তারা এখন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তাদের কার্যক্রম বিস্তারের চেষ্টা করছে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গে এদের শক্তিশালী নেটওয়ার্কের তথ্য মিলেছে। ২০১৪ সালের ২ অক্টোবর পশ্চিমবঙ্গের খাগড়াগড়ে এক বাড়িতে জেএমবির বোমা বিস্ফোরিত হলে ২ জন নিহত হয়। ওই ঘটনায় ভারতের জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থ এনআইএ ৩২ জন জেএমবি সদস্যকে গ্রেফতার করে।
উল্লেখ্য, ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট সিরিজ বোমা হামলার মাধ্যমে সারা দেশে জেএমবি সদস্যরা তাদের অস্তিত্ব জানান দেওয়ার চেষ্টা করে। এ ঘটনায় দুজন নিহত হন। আহত হন অর্ধশতাধিক। এ ঘটনার পর যেসব জঙ্গিকে গ্রেফতার করা হয় তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল- জেএমবির শীর্ষ নেতা শায়খ আবদুর রহমান, সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলা ভাই, আতাউর রহমান সানি, খালেদ সাইফুল্লাহ, আবদুল আউয়াল, হাফেজ মাহমুদ প্রমুখ। ঝালকাঠিতে দুই বিচারক হত্যা মামলায় জেএমবি প্রধান শায়খ আবদুর রহমান ও সিদ্দিকুল ইসলাম বাংলা ভাইসহ সাতজনের ফাঁসির আদেশ দেয় আদালত।২০০৭ সালের ২৯ মার্চ শায়খ আবদুর রহমান, সিদ্দিকুল ইসলাম, খালেদ সাইফুল্লাহ, আতাউর রহমান সানি, আবদুল আউয়াল, ইফতেখার হাসান আল মামুনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। ২০১৬ সালের ১৭ অক্টোবর এই মামলার ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি আসাদুল ইসলাম আরিফের ফাঁসি কার্যকর হয়।