আখের গোছাতে অনুপ্রবেশকারীদের দাপট ভুঁইফোড় সংগঠনে বিব্রত আ.লীগ - Alokitobarta
আজ : শনিবার, ২২শে নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ৭ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

আখের গোছাতে অনুপ্রবেশকারীদের দাপট ভুঁইফোড় সংগঠনে বিব্রত আ.লীগ


আলোকিত বার্তা:শহর-বন্দর-গ্রাম যেদিকে তাকাবেন, নামের আগে-পরে শুধু লীগ আর লীগ। কোথাও কোথাও আবার বঙ্গবন্ধু এবং তার পরিবারের সদস্যদের নামের আগে-পরেও ‘লীগ’ বসানো আছে। এভাবেই বাহারি পোশাকে সারা দেশে একের পর পর এক ভুঁইফোড় সংগঠন গড়ে উঠেছে। দুঃসময়-দুর্দিনে এদের দেখা মেলেনি, ‘দুধের মাছি’র মতো তারাই এখন আওয়ামী লীগের নাম ভাঙিয়ে দলের সুহৃদ সেজেছে। মিডিয়া পাড়ায় ‘রাজনৈতিক দোকান’ হিসাবে পরিচিত এসব ভুঁইফোড় সংগঠনের সুবিধাবাদী সুহৃদদের কারণে একরকম বিব্রত মহান মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ।রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, মূলত ধান্ধাবাজি, তদবিরবাজি আর চাঁদাবাজির মাধ্যমে নিজের আখের গোছানোর মতলবেই সরকারি দলের নাম ভাঙিয়ে এরা গজিয়ে ওঠে। ভুঁইফোড় এসব সংগঠন মূলত ব্যানার-ফেস্টুন, লিফলেট, ভিজিটিং কার্ডসর্বস্ব। বাস্তবে এদের যেমন কোনো কার্যক্রম নেই, তেমনি নেই কোনো কার্যালয়ও। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বঙ্গমাতা বেগম শেখ ফজিলাতুননেছা মুজিব, তাদের বড় মেয়ে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা, বঙ্গবন্ধুর ছোট ছেলে শেখ রাসেলসহ এ পরিবারের সদস্যদের নাম দিয়ে আগে-পরে ‘আওয়ামী’ কিংবা ‘লীগ’ শব্দটি বসিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে বিভিন্ন নামের ভুঁইফোড় সংগঠন।এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক, সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের শনিবার বলেন, ‘ভুঁইফোড় কোনোও সংগঠনের সঙ্গে আওয়ামী লীগের কোনোও সম্পর্ক নেই- এটা আমি প্রধানমন্ত্রী ও দলের সভাপতি শেখ হাসিনার নির্দেশে সবাইকে পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিতে চাই।’ তিনি বলেন, ‘ভুঁইফোড় সংগঠনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ইতোমধ্যে ব্যবস্থা নেওয়া শুরুও হয়ে গেছে। দলের কোনোও নেতাকে যদি এসব সংগঠনের কোনোও কর্মসূচিতে দেখা যায়, কিংবা পৃষ্ঠপোষকতা করে-তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

সংশ্লিষ্টদের মতে, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং শেখ হাসিনা ছাড়া অন্য কোনো নেতার ছবি দিয়ে পোস্টার, ব্যানার-ফেস্টুন ছাপানোর ব্যাপারে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে কঠোর নিষেধাজ্ঞা থাকলেও রাজধানীসহ সারা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে এসব পকেটসর্বস্ব ভুঁইফোড় সংগঠনের নেতাদের বড় বড় ছবি পা বাড়ালেই চোখে পড়বে। ক্ষমতার টানা তৃতীয় মেয়াদে আচমকা যেন মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে আসছে নামসর্বস্ব এ সংগঠনগুলো। কখনও কখনও উপর মহলকে ‘ম্যানেজ’ করে এসব সংগঠনের নেতারা আওয়ামী লীগের উপকমিটিতেও জায়গা করে নিচ্ছে।ক্ষমতাসীন দলের অনুমোদিত সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন থাকার পরও নিত্যনতুন ‘লীগ’ গড়ে ওঠাকে বিস্ময়কর মনে করছেন বিশ্লেষকরা। জানতে চাইলে এ প্রসঙ্গে স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ও সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার শনিবার বলেন, ‘আওয়ামী লীগ টানা তৃতীয় মেয়াদে রাষ্ট্রক্ষমতায়। ক্ষমতার সাধ নিতে, কিংবা ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে থেকে ফায়দা নিতে অনেকেই ব্যাঙের ছাতার মতো ভুঁইফোড় সংগঠনের দোকান খুলেছে। যারা এসব দোকান খোলে তারা জানে, এতে করে বহুরকম সুযোগ-সুবিধা যেমন পাওয়া যায়, তেমনি অন্যায়-অপকর্ম করেও নিজেকে রক্ষা করা যায়।’

তিনি বলেন, খোঁজ নিলে দেখা যাবে এরা বেশিরভাগই অনুপ্রবেশকারী। আখের গোছানোই এদের মূল লক্ষ্য। ফলে এসব ভুঁইফোড় সংগঠন ও তাদের নেতাদের দিয়ে ক্ষমতাসীন সরকারের উপকার কতটা হচ্ছে জানি না, তবে এসব সংগঠনের নেতাদের নেতিবাচক কর্মকাণ্ডে সরকারের অর্জন ম্লান হচ্ছে। সরকারের উচিত এখনই এদের লাগাম টেনে ধরা।আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্র ঘেঁটে দেখা গেছে, দলটির আটটি সহযোগী ও দুটি ভ্রাতপ্রতিম সংগঠন রয়েছে। সহযোগী সংগঠনগুলো হলো-যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, মহিলা লীগ, যুব মহিলা লীগ, কৃষক লীগ, তাঁতী লীগ, মৎস্যজীবী লীগ ও আওয়ামী লীগ আইনজীবী পরিষদ। আর ভ্রাতপ্রতিম সংগঠন দুটি হলো-ছাত্রলীগ ও শ্রমিক লীগ। গঠনতন্ত্রে না থাকলেও চিকিৎসকদের পেশাজীবী সংগঠন স্বাধীনতা চিকিৎসা পরিষদের কর্মকাণ্ডে ক্ষমতাসীনদের ‘সায়’ আছে। এ ছাড়া পঁচাত্তরের পর বৈরী পরিবেশে রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন উপেক্ষা করে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ প্রচার করায় বঙ্গবন্ধু পরিষদ, বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোট, শেখ রাসেল শিশু-কিশোর, বঙ্গবন্ধু শিশু-কিশোর মেলার মতো সংগঠনের কর্মকাণ্ডে রাজনৈতিক স্বীকৃতি রয়েছে আওয়ামী লীগের।খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, স্বীকৃত সংগঠনের বাইরে গিয়ে ‘আওয়ামী’ কিংবা ‘লীগ’ শব্দ দুটি বসিয়ে নানা নামে শত শত সংগঠন গড়ে উঠেছে ক্ষমতাসীনদের শাসনামলে। এর বাইরে বঙ্গবন্ধু, বঙ্গমাতা, শেখ রাসেল ও বঙ্গবন্ধু পরিবারের বিভিন্ন সদস্যের নামও জুড়ে দেওয়া হয়েছে। এমনকি মুক্তিযোদ্ধাদের নাম ব্যবহার করেও জানান দিচ্ছে অনেক সংগঠন। এরই ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি ফেসবুকে ‘আওয়ামী চাকরিজীবী লীগ’ নামের নতুন সংগঠনের নেতা বানানোর ঘোষণা দিয়ে ছবি পোস্ট করে আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দেন ব্যবসায়ী হেলেনা জাহাঙ্গীর। এ ঘটনার পরপরই তাকে আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক উপকমিটির সদস্যপদ থেকে বাদ দেওয়া হয়। প্রতারণাসহ নানা অভিযোগে বৃহস্পতিবার হেলেনা জাহাঙ্গীরকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। পরে তার মালিকানাধীন জয়যাত্রা আইপি টিভি ও জয়যাত্রা ফাউন্ডেশনের ভবনে অভিযান চালানো হয়।

এর আগে করোনা পরীক্ষার নামে প্রতারণাসহ বিভিন্ন অভিযোগে পররাষ্ট্রবিষয়ক উপকমিটির সদস্য থেকে বাদ দেওয়া হয় রিজেন্ট হাসপাতালের মালিক মো. শাহেদকে। তাকেও গ্রেফতার করে র‌্যাব। এরও কিছুদিন আগে অভিজাত এলাকায় জমজমাট নারী ব্যবসাসহ ভয়ংকর সব অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেফতার হন নরসিংদী জেলা যুব মহিলা লীগের সাধারণ সম্পাদক শামীমা নূর পাপিয়া। পরে তাকেও বহিষ্কার করা হয়। পাপিয়ার স্বামী মফিজুর রহমান চৌধুরী সুমন ছিলেন নরসিংদী শহর ছাত্রলীগের সাবেক আহ্বায়ক সুমন। দল থেকে বাদ দেওয়া হয় তাকেও। স্বামী-স্ত্রী দুজনেই এখন কারাগারে।আওয়ামী লীগের একাধিক সূত্র জানায়, দলটি এ নিয়ে টানা তৃতীয় মেয়াদে সরকার গঠন করেছে। প্রতিবার নির্বাচনের আগে বা সরকার গঠনের পর কিছু সংগঠন গজিয়ে ওঠে। মূলত, মন্ত্রিসভায় স্থান না পাওয়া কিংবা বাদ পড়া এবং দলের মনোনয়নপ্রত্যাশী নেতাদের কেউ কেউ এসব সংগঠনের অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে থাকেন। কেউ কেউ আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতাও করেন। মূলত কথিত এসব সংগঠনগুলোকে দিবসভিত্তিক অনুষ্ঠান বা চলমান রাজনৈতিক বিষয়ে আলোচনার নামে জাতীয় প্রেস ক্লাব, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি ও ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে অনুষ্ঠান ও মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করতে দেখা যায়। সরকারি কর্মকর্তারাও ভুঁইফোড় সংগঠনের নেতাদের তদবিরে অতিষ্ঠ হয়ে নালিশ করেছেন। এরই প্রেক্ষিতে ২০১৫ সালে দলের নীতিনির্ধারকদের পক্ষ থেকে শতাধিক সংগঠনের তালিকা গোয়েন্দা সংস্থাকে দিয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বলা হয়। এরপর কিছুদিন এদের তৎপরতা কিছুটা কমে গেলেও ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে ও পরে নতুন করে তৎপর হয়ে ওঠে ভুঁইফোড় সংগঠনগুলো। প্রচারের লোভে এসব সংগঠনের কর্মসূচিতে দু-একজন মন্ত্রী-নেতাকেও উপস্থিত থাকতে দেখা গেছে বিভিন্ন সময়।সম্প্রতি ভুঁইফোড় সংগঠনগুলোর নতুন করে অপতৎপরতা বেড়ে যাওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকদের পক্ষ থেকে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে এ বিষয়ে নির্দেশনা দেওয়া হয়। প্রথমে এসব ভুঁইফোড় সংগঠনের উদ্যোক্তাদের কর্মকাণ্ড ও সম্পদের খোঁজ নেওয়া হবে। সরকার বা আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের মধ্যে কারা এসব সংগঠনের পেছনে পৃষ্ঠপোষকতা করছেন, সেটাও খোঁজা হবে।

আওয়ামী লীগের বিভিন্ন সূত্র বলছে, সাম্প্রতিক সময়ে গজিয়ে ওঠা, বিশেষ করে আওয়ামী লীগ টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর আরও বেশ কিছু সংগঠন হয়েছে। গত প্রায় এক যুগে গড়ে ওঠা এমন ৭৩টি সংগঠনের নাম পেয়েছে দলটি। আওয়ামী লীগই বলছে, এর বাইরে আরও অনেক সংগঠন আছে, যেগুলোর কথা তাদের জানা নেই। সুযোগসন্ধানী এসব সংগঠনের সঙ্গে আওয়ামী লীগের কোনো সম্পর্ক নেই।ভুঁইফোড় সংগঠনগুলোর কর্মকাণ্ড নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার মধ্যে ক্ষমতাসীনরা বারবারই বলে এসেছে, তাদের গঠনতন্ত্রে উল্লেখ করা সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাড়া বাকি কোনো সংগঠনের সঙ্গে সম্পর্ক নেই। এর মধ্যে ‘ওলামা লীগ’ নামে একটি ধর্মীয় সংগঠনের কর্মকাণ্ডে সরকারকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেললে এ সংগঠনের সঙ্গে সম্পর্ক না থাকার কথা দাবি করেছে দলটি। জানতে চাইলে এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কর্নেল (অব.) ফারুক খান শনিবার বলেন, ‘ভুঁইফোড় সংগঠনগুলোর কারণে দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন্ন হয়। আমরা তা হতে দিতে পারি না। এসব ভুঁইফোড় সংগঠনের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।

Top