বরিশালে পুলিশ হেফাজতে কলেজ ছাত্রের মৃত্যু
আলোকিত বার্তা:বরিশাল মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের নির্যাতনে রেজাউল করিম রেজা (৩০) নামে আইন কলেজের এক ছাত্রের মৃত্যুর অভিযোগ পাওয়া গেছে। শনিবার রাত ১২টা ৫ মিনিটে বরিশাল শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তার মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় এলাকায় ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে। স্থানীয়রা লাশ নিয়ে মিছিল করেন। বিক্ষুব্ধ এলাকাবাসী ঘটনার জন্য দায়ী মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের এসআই মহিউদ্দিন মাহির বাসভবনে হামলা ও ভাঙচুর চালিয়েছেন। এ ছাড়া তারা ঢাকা-কুয়াকাটা মহাসড়ক অবরোধ করেন। পরে পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তাদের আশ্বাসে তারা অবরোধ তুলে নিলে যান চলাচল শুরু হয়।এ বিষয়ে বরিশাল কেন্দ্রীয় কারা কর্তৃপক্ষ বলছে, ৩০ ডিসেম্বর আসামি রেজাউলকে গ্রহণ করার সময়ই তিনি অসুস্থ ছিলেন। রিসিভ কপিতেও তার অসুস্থতার কথা উল্লেখ ছিল। তার দুই পায়ের সংযোগস্থল থেকে রক্তক্ষরণ হচ্ছিল। আর এ কারণেই তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। হতভাগ্য রেজাউল করিম বরিশাল নগরীর ২৪ নম্বর ওয়ার্ডের হামিদ খান সড়কের বাসিন্দা ও ব্যবসায়ী ইউনুস মুন্সীর ছেলে।এ বিষয়ে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের এসআই মহিউদ্দিন মাহি জানান, ২৯ তারিখ রাত সাড়ে ১০টায় রেজাউলকে গ্রেফতার করা হয় ১৩৬ গ্রাম গাঁজা ও ৪ অ্যাম্পুল নেশাজাতীয় ইনজেকশনসহ। রাত পৌনে ১২টায় তাকে কোতোয়ালি মডেল থানায় হস্তান্তর করা হয়। রাতেই মামলা করা হয় এবং পরের দিন তাকে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়। নির্যাতনের অভিযোগ মিথ্যা। এ ছাড়া রেজাউলের বিরুদ্ধে আগেও একটি মাদকের মামলা ছিল। বরিশাল কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার প্রশান্ত কুমার বণিক জানান, ৩০ তারিখ এই আসামিকে রিসিভ করি। সেখানে ফরওয়ার্ডিং কাগজে অসুস্থতার কথা উল্লেখ রয়েছে। তা ছাড়া তার শরীরে ক্ষত ছিল। পায়ের ঊরু থেকে রক্তক্ষরণ হওয়ায় তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
বরিশাল শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের ইনচার্জ হরে কৃষ্ণ সিকদার জানান, রক্তক্ষরণজনিত কারণে ১ জানুয়ারি রাত ৯টা ৩৫ মিনিটে পুরুষ সার্জারি ইউনিটে তাকে ভর্তি করে কারা কর্তৃপক্ষ। তবে হাসপাতাল পরিচালক ডা. বাকির হোসেন এ ব্যাপারে গণমাধ্যমে কিছু বলতে রাজি হননি। হাসপাতালের লাশঘরে উপস্থিত বরিশাল কোতোয়ালি মডেল থানার এসআই আবদুল কুদ্দুস জানান, এ ঘটনায় একটি অপমৃত্যু মামলা হবে এবং লাশের ময়নাতদন্ত করা হবে। এরপর পরবর্তী আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
মৃত রেজাউলের ফুপা তারেক মিয়া জানান, হামিদ খান সড়ক থেকে ঘটনার দিন রাত ৮টার দিকে রেজাউলকে আটক করে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের এসআই মহিউদ্দিন মাহি। তখন সেখানে উপস্থিত এবং নিহতের স্বজনদের সামনেই রেজাউলকে ধরে দুজন মাদক ব্যবসায়ীর নাম জানতে চায়। এ সময় রেজাউল কিছু জানেন না বলে জানালে এসআই মহিউদ্দিন নিজের গাড়ির কাছে যান এবং সেখান থেকে ফিরে রেজাউলের পকেটে হাত দিয়ে একটি নেশাজাতীয় ইনজেকশন পান বলে জানান এবং পরে তাকে নিয়ে যান।হতভাগ্য রেজাউলের পিতা ইউনুস মুন্সী বলেন, ঘটনাস্থলেই আমি আমার ছেলেকে ধরার কারণ জানতে চাইলে পুলিশ কর্মকর্তা মহিউদ্দিন মিয়া জানান, জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তখনও রেজাউল দিব্যি সুস্থ ছিল। পরে জানতে পারি রেজাউলকে গাঁজাসহ আটক করা হয়েছে। পরে শুক্রবার রাত ৯টার দিকে আমাকে পুলিশ ফোন করে জানায়, বাথরুমে পড়ে গিয়ে রেজাউলের রক্তক্ষণ হয়েছে এবং তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। রেজাউলের সঙ্গে আমাদের দেখা করতে দেওয়া হয়নি। বরিশাল মহানগরী পুলিশ কমিশনার শাহাবুদ্দিন খান বলেন, নিয়মানুযায়ী সুস্থভাবে তাকে আদালতে পাঠিয়েছি। সেখান থেকে তাকে হাজতে পাঠানো হয়েছে। যেহেতু স্বজনরা অভিযোগ করেছেন সেহেতু বিষয়টা খতিয়ে দেখা হবে।
স্থানীয়রা বাসিন্দা সুজন জানান, রেজাউলের সারা শরীরে জখমের চিহ্ন রয়েছে। শরীরে রক্তের ছোপ ছোপ দাগ। বিশেষ করে তার দুই পায়ে স্পষ্ট জমাট রক্তের চিহ্ন রয়েছে। অমানবিক নির্যাতনেই রেজাউলের মৃত্যু হয়েছে।রেজাউলের ভাই আজিজুল করিম বলেন, কোনো অপরাধ ছাড়াই রেজাউলকে ধরে নেওয়া হয়েছে। তাকে নিয়ে আরও দুই ব্যক্তিকে ফাঁসানোর চেষ্টায় ব্যর্থ হওয়ায় তার ওপর নির্যাতন করা হয়েছে। নিহতের পরিবার ও স্থানীয়রা নির্যাতনকারী পুলিশের সদস্যদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছেন।
লাশ নিয়ে বিক্ষুব্ধ জনতার মিছিল : বরিশাল মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের এসআই মহিউদ্দিন মাহিসহ দায়ী পুলিশ সদস্যদের বিচার দাবিতে ঢাকা-কুয়াকাটা মহাসড়ক অবরোধ করেন স্থানীয়রা। এ সময় সড়কের দুপাশে কয়েকশ যানবাহন আটকা পড়ে। পরে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের আশ্বাসে অবরোধ তুলে নেন এলাকাবাসী। ২৪নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি নাজমুল হুদা, সাধারণ সম্পাদক সাফিন মাহামুদ তারেকসহ স্থানীয়রা পুলিশ সদস্যদের বিচার দাবি করেছেন। ২৪নং ওয়ার্ডের বাসিন্দারা রেজাউল করিমের লাশ নিয়ে নগরীর সাগরদি এলাকায় প্রায় দেড় ঘণ্টা ধরে বিক্ষোভ করেন। এ সময় সড়কে টায়ার জ্বালিয়ে তারা তাদের ক্ষোভ প্রকাশ করেন। পরে সন্ধ্যা সোয়া ৬টার দিকে বরিশাল নগরীর ধান গবেষণা রোডের এসআই মহিউদ্দিন মাহির বাসভবনে হামলা ও ভাঙচুর চালান স্থানীয়রা। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।
বরিশাল মহানগর পুলিশের ব্যাখা : পুলিশি নির্যাতনে কলেজছাত্রের মৃত্যুর অভিযোগ ওঠার পর এর ব্যাখ্যা দিয়েছে বরিশাল মহানগর পুলিশ। এতে বলা হয়েছে, রেজার বাম পায়ের সংযোগস্থলে ক্ষত ছিল। সেখান থেকে রক্তক্ষরণেই তার মৃত্যু হয়েছে।
রোববার সন্ধ্যায় বরিশাল মহানগর পুলিশের পক্ষ থেকে ই-মেইল বার্তায়ও এর ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। ওই বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়েছে, তদন্ত কর্মকর্তা ৩০ ডিসেম্বর আসামিকে আদালতে পাঠান, ওইদিনই তাকে বরিশালের কেন্দ্রীয় কারাগার পাঠানো হয় এবং কারা কর্তৃপক্ষ তাকে বুঝে নেয়। কারাগারে পাঠানো ২ দিনেরও বেশি সময় পর ১ জানুয়ারি রাতে আসামি কারাভ্যন্তরে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে প্রাথমিকভাবে কারা হাসপাতালে তাকে চিকিৎসা দেওয়া হয়। অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় ওইদিন রাতে শেবাচিম হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। শেবাচিম হাসপাতালের প্রিজন সেলের দায়িত্বে থাকা কারারক্ষীদের মাধ্যমে তাকে প্রিজন সেলে রেখে চিকিৎসা দেওয়া এবং ওই অবস্থায়ই কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এ ব্যাপারে কোতোয়ালি মডেল থানায় অপমৃত্যু মামলা করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, রেজাউল আগে থেকেই এলাকায় মাদক বিক্রেতা ও মাদকসেবী হিসেবে চিহ্নিত ছিল এবং ইতঃপূর্বে তার বিরুদ্ধে মাদকের একাধিক মামলা হয়। তার শরীরের বাম পায়ের পাশের কুঁচকিতে ক্ষত ছিল। প্রাথমিক অনুসন্ধানে পুলিশি নির্যাতনের কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। তার শরীরের ক্ষতস্থান থেকে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের ফলে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন মর্মে প্রতীয়মান হয়। এরপরও বিষয়টি তদন্তের জন্য বরিশাল মহানগর পুলিশ কমিশনার শাহাবুদ্দিন খান উপপুলিশ কমিশনারকে (দক্ষিণ) প্রধান করে ৩ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন।