নানা জটিলতা থেকে মুক্তি পাননি জাতীয়করণকৃত শিক্ষকরা - Alokitobarta
আজ : বৃহস্পতিবার, ২০শে নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ৫ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

নানা জটিলতা থেকে মুক্তি পাননি জাতীয়করণকৃত শিক্ষকরা


আলোকিত বার্তা:পৌনে আট বছরেও নানা জটিলতা থেকে মুক্তি পাননি জাতীয়করণকৃত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা।বরং এক জটিলতা দূর হলে আটকে পড়েন আরেকটিতে।
আইন ও বিধির অপব্যাখ্যা দিয়ে ইতোমধ্যে এসব শিক্ষককে বঞ্চিত করা হয়েছে জ্যেষ্ঠতা থেকে। এর ধারাবাহিকতায় তাদের দেয়া হয়নি প্রধান শিক্ষকের চলতি দায়িত্ব।সর্বশেষ হাত দেয়া হয়েছে এসব শিক্ষকের আর্থিক সুবিধায়। প্রায় অর্ধলাখ শিক্ষককে গৃহীত টাইম স্কেল ফেরত দিতে বলা হয়েছে। এছাড়া ভবিষ্যতে এসব শিক্ষকের পদোন্নতি বঞ্চিত হওয়ার পথও খুলে দেয়া হয়েছে।জাতীয়করণকৃত প্রাথমিক শিক্ষক মহাজোটের সমন্বয়ক আমিনুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, কিছু অসাধু কর্মকর্তার লোভের বলি হচ্ছেন তারা। ২০১৭ সালে দেশের বিভিন্ন সরকারি স্কুলে প্রধান শিক্ষকের চলতি দায়িত্ব দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হয়। তখন জাতীয়করণকৃত স্কুলের শিক্ষকদের এই চলতি দায়িত্ব প্রদান থেকে বঞ্চিত করতে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের (ডিপিই) ওই অসাধু কর্মকর্তারা জ্যেষ্ঠতার তালিকায় রাখেননি। এর সূত্র ধরে উপজেলা পর্যায়ের হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তারা এসব শিক্ষকের টাইম স্কেল প্রাপ্তির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। কেননা বেসরকারি চাকরিজীবনের অভিজ্ঞতা (অধ্যাদেশের ভাষায় কার্যকর চাকরিকাল) ধরেই দেয়া হয় টাইম স্কেল।
যদি মূল মন্ত্রণালয়ই অভিজ্ঞতা বাদ দিয়ে জ্যেষ্ঠতার তালিকা করতে পারে; তাহলে টাইম স্কেল গ্রহণটা অবৈধ বলা অযৌক্তিক নয়। অথচ ২০১৩ সালের জাতীয়করণ অধ্যাদেশের ৯ নম্বর ধারা অনুযায়ী শিক্ষকরা কার্যকর চাকরিকাল, জ্যেষ্ঠতা, পদোন্নতি এবং টাইম স্কেল সবই পাবেন। এটা অনুযায়ী মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠতা নির্ধারণ ও চলতি দায়িত্বে প্রধান শিক্ষক পদায়নের সিদ্ধান্ত সঠিক নয়। লক্ষাধিক শিক্ষক বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কয়েকজন কর্মকর্তা কর্তৃক বারবার আইন ও বিধির অপব্যাখ্যা ও ভুল ব্যাখ্যার শিকার হচ্ছেন।জানা গেছে, ২০১৩ সালের ৯ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২৬ হাজার ১৯৩টি স্কুল জাতীয়করণ করেন। এতে লক্ষাধিক শিক্ষকের চাকরি তিন ধাপে জাতীয়করণ হয়েছে। এর মধ্যে প্রথম ধাপের ৬১ হাজার শিক্ষক টাইম স্কেল প্রাপ্য। এসব শিক্ষকের চাকরিও ১৯৭৪ সালের বিদ্যালয় জাতীয়করণ অধ্যাদেশ অনুযায়ী সরকারি হয়েছে।

কিন্তু অর্থ মন্ত্রণালয়ের গত বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারির এক চিঠিতে ১৯৭৫ সালে শিল্পপ্রতিষ্ঠান যে অধ্যাদেশবলে জাতীয়করণ হয়েছে, সেটি শিক্ষকদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য দেখানো হয়। অথচ ২০১৩ সালের যে অধ্যাদেশে স্কুলগুলো জাতীয়করণ হয়েছে সেটির ৯ ধারায় শিক্ষকদের ‘কার্যকর চাকরিকাল’ গণনা, জ্যেষ্ঠতা নির্ধারণ এবং টাইম স্কেল দেয়ার কথা উল্লেখ আছে। কিন্তু রহস্যজনক কারণে ১৯৭৫ সালের অধ্যাদেশ প্রযোজ্য বলা হচ্ছে। এই চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে মহাহিসাব নিরীক্ষকের কার্যালয় মাঠপর্যায়ে ইতোমধ্যে যে ৪৮ হাজার ৭২০ শিক্ষক টাইম স্কেল নিয়েছেন তা ফেরত দিতে বলেছে। পাশাপাশি আটকে থাকা টাইম স্কেল আরও অন্তত ১৩ হাজার শিক্ষক গ্রহণ করতে পারবেন না।সূত্র জানায়, টাইম স্কেল সংক্রান্ত এই জটিলতার উদ্ভব হয়েছে পুরনো সরকারি প্রাথমিক স্কুলের সহকারী শিক্ষকদের প্রধান শিক্ষকের পদে চলতি দায়িত্ব দেয়াকে কেন্দ্র করে। ২০১৭ সালে এ ধরনের প্রায় ১৮শ’ জনকে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব দেয়া হয়। তখন নতুন-পুরনো উভয় ধরনের স্কুলের সহকারী শিক্ষকদের জ্যেষ্ঠতা নির্ধারণ করে মাঠপর্যায় থেকে তালিকা পাঠানো হয়েছিল।

কিন্তু ডিপিই’র তৎকালীন শীর্ষ কর্মকর্তারা জেলা শিক্ষা কর্মকর্তাদের ডেকে ২০১৩ সালের ১ জানুয়ারি থেকে চাকরিকাল ধরে জাতীয়করণকৃত স্কুলের শিক্ষকদের জ্যেষ্ঠতার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে মৌখিক নির্দেশ দেন। ফলে জাতীয়করণ শিক্ষকরা জ্যেষ্ঠতায় পিছিয়ে পড়েন। এতে চলতি দায়িত্বে সব পদই দখল করে নেন পুরনো স্কুলের সহকারী শিক্ষকরা। এই নির্দেশনাও ২০১৩ সালের বিদ্যালয় জাতীয়করণ অধ্যাদেশের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। কেননা এটির ৯ নম্বর ধারায় বেসরকারি চাকরিজীবনের অর্ধেক সময় ‘কার্যকর চাকরিকাল’ হিসেবে ধরার নির্দেশনা আছে।শিক্ষক নেতারা বলছেন, এ ঘটনার পর উচ্চ আদালতে মামলা ও শিক্ষকরা আন্দোলন শুরু করেন। তখন অধ্যাদেশে সুস্পষ্ট বর্ণনা থাকা সত্ত্বেও সময়ক্ষেপণের লক্ষ্যে জ্যেষ্ঠতার ইস্যুতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে মতামত চায় প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় চলতি বছরের ২৩ ফেব্রুয়ারি জানিয়ে দেয় যে, জাতীয়করণ শিক্ষকদের ‘কার্যকর চাকরিকাল’ গণনা করে জ্যেষ্ঠতা নির্ধারণ বিধিসম্মত হয়নি। শিক্ষক নেতারা আরও বলছেন, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এই চিঠি আবার কে বা কারা পৌঁছে দেয় মহাহিসাব নিরীক্ষকের দফতরে।এরপর শুরু হয় তাদের গৃহীত টাইম স্কেলের বৈধতা সংক্রান্ত জটিলতা। গত ১১ মার্চ মহাহিসাব নিরীক্ষকের দফতর অর্থ মন্ত্রণালয়ে টাইম স্কেলের ব্যাপারে চিঠি পাঠায়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ১২ আগস্ট অর্থ মন্ত্রণালয় ফিরতি চিঠি পাঠায়।অর্থ মন্ত্রণালয়ের উপসচিব হায়াত মো. ফিরোজ স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে বলা হয়, কার্যকর চাকরিকাল কেবল ২০১৩ সালের বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষক (চাকরি শর্তাদি নির্ধারণ) বিধিমালার ১০ নম্বর ধারায় উল্লিখিত শুধু পেনশন গণনার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। ২০১৪ সালের ৫ জুন টাইম স্কেল গণনার ব্যাপারে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিপত্র বিধিসম্মত নয়। এতে শিক্ষকদের গ্রহিত টাইম স্কেলের অর্থ ‘আদায়যোগ্য’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। পাশাপাশি ৪৮ হাজার ৭২০ শিক্ষককে উপজেলা পর্যায়ের যেসব হিসাবরক্ষণ অফিস থেকে টাইম স্কেল দিয়েছে সেসব দফতরের সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতেও বলা হয়েছে।0শিক্ষক নেতা আমিনুল ইসলাম বলেন, একটি স্বার্থান্বেষী মহলের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে প্রশাসনের কিছু দুষ্ট ব্যক্তি জাতীয়করণকৃত শিক্ষকের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছেন। এক্ষেত্রে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং ডিপিই’র একশ্রেণির কর্মকর্তাও আছেন। কেননা প্রায় আট বছর হতে চলল, কিন্তু আজ পর্যন্ত জাতীয়করণের গোটা কাজ শেষ হয়নি। বরং নতুন নতুন জটিলতা তৈরি করা হচ্ছে। তিনি দৃষ্টান্ত দিয়ে বলেন, মন্ত্রণালয় ও ডিপিই যদি ২০১৭ সালের ১৮ ডিসেম্বর মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো গ্রেডেশন নিষ্পত্তি ও বকেয়া টাইম স্কেল প্রাপ্তির চিঠি এনডোর্স করে সারা দেশে পাঠিয়ে দিতেন, তাহলে উপজেলা-জেলা শিক্ষা ও হিসাবরক্ষণ অফিস নতুন জটিলতা তৈরি করতে পারত না।এই শিক্ষক নেতা মনে করেন, এর মাধ্যমে চক্রটি প্রধানমন্ত্রীর ভালো কাজের সুফল নষ্ট করার চক্রান্তে লিপ্ত আছে। এই চক্রান্তের বিরুদ্ধে তারা একযোগে রাজপথে আন্দোলন, সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা এবং আইনি লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। কেননা চক্রের অপকর্মের কারণে শিক্ষকরা কেবল জ্যেষ্ঠতা আর পদোন্নতিবঞ্চিত হচ্ছেন না, পাশাপাশি প্রত্যেককে অবসরকালে টাইম স্কেল বাবদ গৃহীত ৫-৬ লাখ টাকা করে ফেরত দিতে হবে।এসব বিষয়ে জানতে চাইলে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব আকরাম-আল-হোসেন বলেন, জাতীয়করণকৃত শিক্ষকদের কিছু সমস্যা তিনি দায়িত্ব গ্রহণের আগেই সৃষ্টি হয়েছে। সমাধানে যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন তিনি। আইন ও বিধিবিধান পর্যালোচনা করে সমস্যাগুলো সমাধানের উদ্যোগ নেয়া হবে।

Top