মিলারদের কারসাজিতে বাজারে মোটা চালের সংকট দেখা দিয়েছে
আলোকিত বার্তা:মিলারদের কারসাজিতে বাজারে মোটা চালের সংকট দেখা দিয়েছে।রাজধানীর পাইকারি ও খুচরা বাজারে মোটা চাল নেই বললেই চলে। কিছু দোকানে মিললেও প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৪৮ টাকা। অথচ মাস দেড়েক আগেও এ চাল ৩৮ কেজি বিক্রি হয়েছে।করোনার সময় এ ধরনের চালের চাহিদা বেশি থাকায় কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে দাম বাড়ানো হচ্ছে। বেশি দামে চাল কিনতে গিয়ে প্রায় কর্মহীন নিম্ন আয়ের মানুষগুলোর দুর্ভোগ আরও বেড়েছে। অথচ গত আমন এবং সর্বশেষ বোরো মৌসুমে ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। কিন্তু এর প্রভাব বাজারে পড়েনি, কমেনি চালের দাম। দুই সপ্তাহের ব্যবধানে নতুন করে মিল পর্যায়ে প্রায় সব ধরনের চালের দাম বস্তায় (৫০ কেজি) সর্বোচ্চ ২০০ টাকা বেড়েছে।এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বাজার তদারকি সংস্থা জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের উপপরিচালক মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার বলেন, বাজার তদারকির সময় দেখেছি হঠাৎ করেই অন্যান্য চালের সঙ্গে মোটা চালের দাম বেড়েছে। পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতাদের কাছে জানতে চাইলে তারা বলেছেন, মিলাররা মোটা চালের সরবরাহ কমিয়ে দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। তাই অধিদফতরের পক্ষ থেকে মিল পর্যায় থেকে শুরু করে পাইকারি ও খুচরা বাজারে অভিযান পরিচালনা করব। ইতোমধ্যে খুচরা বাজার তদারকি করা হচ্ছে। তিনি জানান, করোনা পরিস্থিতিতে কোন পর্যায় থেকে অনৈতিকভাবে দাম বাড়ানো হয়েছে, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। কোনো ধরনের অসাধুতা পেলে কঠোর শাস্তির আওতায় আনা হবে। কাউকেই ছাড় দেয়া হবে না।
কুষ্টিয়ার মিল মালিক সিকান্দার আলী বলেন,বাজারে বর্তমানে ধানের দাম বাড়তি। বেশি দামে ধান কিনতে হচ্ছে, তাই চাল তৈরিতে খরচ বেশি। যে কারণে দাম বাড়িয়ে বিক্রি করতে হচ্ছে। তিনি বলেন, এবার করোনাকালে অনেক ব্যবসায়ী মৌসুমিভাবে ধানের ব্যবসা করছেন। তারা ধান কিনে গোডাইন ভাড়া করে রেখে দিয়েছেন। এখন দাম বাড়িয়ে অল্প অল্প করে বিক্রি করছেন। মূলত এই কারণেই এখন ধানের দাম বেশি। তবে ধানের দাম পড়ে গেলে চালের দামও কমে যাবে।এদিকে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সূত্র বলছে, এবার আমন ও বোরো মৌসুমে ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইন্সটিটিউটের (ব্রি) গবেষণায় দেখা গেছে, চালের উৎপাদন গত বছরের তুলনায় প্রায় ৩.৫৪ ভাগ বৃদ্ধি পেয়েছে। সংস্থাটি বলছে, আপাতত দেশে চালের ঘাটতির কোনো আশঙ্কা নেই। এছাড়া বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মিলাররা সব সময় চালের দাম বাড়াতে সুযোগ খোঁজে। ধানের বাম্পার ফলন হলেও তাদের কারসাজিতে দেশের মানুষ করোনা পরিস্থিতির মধ্যে কম দামে চাল কিনতে পারছে না।শনিবার সরেজমিন রাজধানীর নয়াবাজারের খুচরা পর্যায়ের ১৫টি দোকানের মধ্যে মোটা চাল পাওয়া গেছে ৩টি দোকানে। মালিবাগ কাঁচাবাজারের ২৩টি দোকান ঘুরে মোটা চাল মিলেছে ৬টি দোকানে। এছাড়া কারওয়ান বাজারে ৩১টি পাইকারি আড়তের মধ্যে মোটা চালের দেখা মিলেছে হাতেগোনা ১১টিতে। রাজধানীর বৃহৎ চালের পাইকারি আড়ত বাবুবাজারের বাদামতলীতেও মোটা চালের সরবরাহ কম।
এ দিন রাজধানীর কারওয়ান বাজার, নয়াবাজার, মালিবাগ কাঁচাবাজার ও রামপুরা বাজারের খুচরা বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মোটা চালের মধ্যে স্বর্ণা জাতের চাল প্রতি কেজি বিক্রি হয়েছে ৪৮ টাকা। যা দুই সপ্তাহ আগে বিক্রি হয়েছে ৪৪-৪৫ টাকা। আর দেড় মাস আগে বিক্রি হয়েছে ৩৮-৪০ টাকা। দেড় মাসের ব্যবধানে খুচরা পর্যায়ে মোটা চালের দাম বেড়েছে কেজিতে ১০ টাকা। এছাড়া এদিন প্রতি কেজি সরু চালের মধ্যে মিনিকেট বিক্রি হয়েছে ৫৫-৫৭ টাকা। যা দুই সপ্তাহ আগে বিক্রি হয়েছে ৫০-৫২ টাকা। মাঝারি আকারের চালের মধ্যে বিআর-২৮ ও পাইজাম চাল মানভেদে প্রতি কেজি বিক্রি হয়েছে ৫০-৫২ টাকা। যা দুই সপ্তাহ আগে বিক্রি হয়েছে ৪৫-৪৬ টাকা।রাজধানীর নয়াবাজারে চাল কিনতে আসা ভ্যানচালক মো.হাবিবুল্লাহ বলেন,করোনাকালে আয় নেই।তার মধ্যে চাল কিনতে বাড়তি টাকা খরচ হয়ে যাচ্ছে। এতে পরিবার নিয়ে প্রতিনিয়ত হিমশিম খেতে হচ্ছে। দেখার কেই নেই।মালিবাগ কাঁচাবাজারে চাল কিনতে আসা পিঠা বিক্রেতা আমেনা বেগম বলেন, করোনা পরিস্থির আগে পিঠা বিক্রি করে ভালোই আয় হতো। এখন কেউ পিঠা কিনে না। তাই আয় নাই। এর মধ্যে বাজারে বাড়তি দরে চাল কিনতে বেশি কষ্ট হচ্ছে। আগে মোটা চাল ৩৮ টাকা কেজিতে পাওয়া যেত এখন কিনতে ৪৫ টাকার ওপরে ব্যয় হচ্ছে।মালিবাগ কাঁচাবাজারের খালেক রাইস এজেন্সির মালিক ও খুচরা চাল বিক্রেতা মো. দিদার হোসেন বলেন,ধানের বাম্পার ফলনেও চালের দাম কমেনি। মিলাররা সব ধরনের চালের দাম বাড়িয়েছে। এর মধ্যে মোটা চালের দাম বেশি বাড়িয়েছে। তিনি বলেন, করোনা পরিস্থিতির মধ্যে অনেকেই ত্রাণ দিতে মোটা চাল কিনছেন। ফলে বাজারে চাহিদা তৈরি হয়েছে। আর এই সুযোগে মিলাররা অন্যান্য চালের মতো মোটা চালও বেশি দামে বিক্রি করছে। এছাড়া তারা বাজারে মোটা চাল কম ছাড়ছে। ফলে খুচরা পর্যায়েও এ ধরনের চালের সংকট দেখা দিয়েছে। যা মিলারদের এক ধরনের কারসাজি।
অন্যদিকে রাজধানীর চালের সর্ববৃহৎ পাইকারি আড়ত বাদামতলী ও কারওয়ান বাজারের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মোটা জাতের চালের মধ্যে স্বর্ণা চাল প্রতি বস্তা বিক্রি হয়েছে ২১০০ টাকা। যা দুই সপ্তাহ আগে বিক্রি হয়েছে ১৯০০ টাকা। মাঝারি আকারের চালের মধ্যে বিআর-২৮ জাতের চাল প্রতি বস্তা বিক্রি হয়েছে ২২০০ টাকা। যা দুই সপ্তাহ আগে বিক্রি হয়েছে ২০৫০ টাকা। এছাড়া সরু চালের মধ্যে মিনিকেট প্রতি বস্তা বিক্রি হয়েছে ২৫০০ টাকা। যা দুই সপ্তাহ আগে বিক্রি হয়েছে ২৩৫০ টাকা।কারওয়ান বাজারের আল্লাহর দান রাইস এজেন্সির মালিক ও পাইকারি চাল ব্যবসায়ী সিদ্দিকুর রহমান বলেন,মিলাররা চালের দাম বাড়িয়েই যাচ্ছে। ধানের দাম বাড়তি, সঙ্গে বন্যার অজুহাতে দিচ্ছে। আসলে এসব তাদের কারসাজি। তারা দাম বাড়ানোর জন্য সুযোগ খুঁজতে থাকে। সুযোগ বুঝে চালের দাম বাড়িয়ে বেশি মুনাফা করে। তিনি জানান, মিলে চালের কোনো সংকট নেই। করোনা পরিস্থিতিতে চাহিদা বাড়ায় তারা কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে মোটা চালের দাম বাড়িয়েছে। এই চাল কিনতে নিম্ন আয়ের মানুষের কষ্ট হচ্ছে।অন্যদিকে কুষ্টিয়া ও বগুড়ার চাল কল বা মিল মালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সাত দিন আগে মিল পর্যায়ে মোটা চালের মধ্যে প্রতি বস্তা স্বর্ণা চাল বিক্রি হয়েছে ১৯৫০ টাকা। যা গত বৃহস্পতিবার মিলাররা নতুন রেট দিয়েছে ২১০০ টাকা। সাত দিন আগে বিআর-২৮ প্রতি বস্তা বিক্রি হয়েছে ২০০০ টাকা। যা সাত দিন পর মিলাররা নতুন রেট দিয়েছে ২২০০। আর সাত দিন আগে প্রতি বস্তা মিনিকেট বিক্রি হয়েছে ২৪০০ টাকা। যার নতুন করে দাম বাড়িয়ে গত বৃহস্পতিবার রেট দেয়া হয়েছে ২৫৫০ টাকা।দাম বাড়ানো প্রসঙ্গে বাদামতলীর পাইকারি চাল বিক্রেতা মো.খায়রুল ইসলাম বলেন,বর্তমানে আমরা যে চাল এনেছি তা ১৫-১৬ দিন আগের কেনা। বর্তমানে মিলাররা চালের যে রেট দিয়েছে, তা আমরা এখন পাইকারি পর্যায়ে বিক্রি করছি। আড়তের চাল শেষ হলে আমাদের নতুন করে বাড়তি দরে চাল কিনতে হবে। এতে কেনা দাম বেশি হওয়ায় পাইকারি পর্যায়ে চালের দর আরও একবার বাড়বে। এর প্রভাব পড়বে খুচরা বাজারেও।