নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান,আস্থাহীনতা কাটাতে সংস্কারের বিকল্প নেই
আলোকিত বার্তা:গভীর সংকটে থাকা নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের(এনবিএফআই)পুনর্গঠন চেয়েছে এ খাতের প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন বাংলাদেশ লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স কোম্পানিজ অ্যাসোসিয়েশন বা বিএলএফসিএ।কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে,এমডিরা চাইলে হবে না।এটা চাইতে হবে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালকদের।সংশ্লিষ্টরা বলছেন,বিষয়টি নিয়ে দীর্ঘদিন কথা চালাচালি চলছে।তবে কোনো সমাধান হচ্ছে না।উল্টো একে অপরকে দায় দিয়ে যাচ্ছে। ফলে শিগগিরই দুর্দশাগ্রস্ত নন ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সংকট কাটছে না।সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকে এ বিষয়ে একটি লিখিত প্রস্তাব দিয়েছে বিএলএফসিএ।চলতি বছরের মধ্যে অন্তত একটি রুগ্ন প্রতিষ্ঠান পুনর্গঠনের সুপারিশ করেছে সংগঠনটি। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবিরের কাছে পাঠানো প্রস্তাবের ওপর শিগগিরই একটি বৈঠক হতে পারে বলে জানা গেছে।জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন নির্বাহী পরিচালক বলেন,নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পুনর্গঠন চাইতে পারেন মালিকরা।এমডিরা চাইলে হবে না। তারা তো চাকরি করেন। সংস্কার বা পুনর্গঠন করতে অনেক বিষয় আছে,যা এমডিদের পক্ষে সমাধান করা সম্ভব হবে না।
সূত্র জানায়, বিএলএফসিএ’র পক্ষ থেকে অবসায়নের প্রক্রিয়ায় থাকা পিপলস লিজিং ছাড়াও ৫টি প্রতিষ্ঠান পুনর্গঠনের বিষয়ে বলা হয়েছে। তবে অন্য প্রতিষ্ঠানের নাম সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়নি। প্রস্তাবে বলা হয়েছে, পুনর্গঠন প্রক্রিয়ার ওই প্রতিষ্ঠানের সব আমানতকারীর টাকা ফেরত দিতে হবে। পাশাপাশি এসব প্রতিষ্ঠানে অনিয়মের জন্য দায়ীদের চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। এর মাধ্যমে বাজারে এই বার্তা দিতে হবে যে,আমানতকারীর টাকা মেরে পার পাওয়া যাবে না।বিএলএফসিএ’র চেয়ারম্যান ও আইপিডিসি ফাইন্যান্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মমিনুল ইসলাম বলেন,খারাপ অবস্থায় থাকা প্রতিষ্ঠানের একটি খসড়া সংস্কার প্রস্তাব গভর্নর বরাবর দেয়া হয়েছে। এই প্রস্তাবের ওপর আলোচনার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক শিগগিরই তাদের নিয়ে বৈঠক করবে বলে আশা করছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে আলোচনার পর এ বিষয়ে বিস্তারিত বলা যাবে।
সংশ্লিষ্টরা জানান,এমনিতেই আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচিতি কম থাকায় আমানত পেতে কষ্ট হয়। অবসায়ন প্রক্রিয়ায় থাকা পিপলস লিজিংসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের চরম খারাপ অবস্থা সামনে আসায় পুরো খাতের প্রতি সাম্প্রতিক সময়ে আস্থাহীনতা বেড়েছে। এর মধ্যে করোনাভাইরাসের ধাক্কা আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতকে চরম সংকটে ফেলেছে। এখন অনেক আমানতকারী মেয়াদপূর্তির আগেই সঞ্চয় ভেঙে ফেলছেন। ফলে অনেক প্রতিষ্ঠান তারল্য সংকটে ভুগছে। নতুন আমানত আসছে খুব সামান্য। আবার এই সময়ে ঋণ আদায় আগের মতো হচ্ছে না।বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগের একজন কর্মকর্তা বলেন,পুরো খাতের আস্থাহীনতা কাটাতে সংস্কারের বিকল্প নেই। সংস্কার প্রস্তাবের বিষয়ে মৌখিকভাবে শুনলেও লিখিত কোনো কিছু তারা পাননি। প্রস্তাব হাতে পাওয়ার পর তারা কী চান,আইনসম্মত কি না এবং আমানতকারীরা লাভবান হবেন কি না- এসব দেখে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
দেশে বর্তমানে ৩৪টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। এর মধ্যে পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস অবসায়নের উদ্যোগ চলমান রয়েছে। গত বছরের ১৪ জুলাই পিপলসের অবসায়ন চেয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আবেদন গ্রহণ করেন আদালত। অনিয়মে জড়িত পরিচালকদের কাছ থেকে ঋণের অর্থ আদায় ও প্রতিষ্ঠানটির সম্পদ বিক্রি করে আমানতকারীদের অর্থ ফেরতের জন্য অবসায়নের উদ্যোগ নেয়া হলেও এক বছরেও দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি হয়নি। আমানতকারীরা কবে টাকা ফেরত পাবেন, তা-ও নিশ্চিত করে জানে না কেউ।বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬৭ হাজার ৮০৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ৬ হাজার ৪৪১ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের সাড়ে ৯ শতাংশ। আগের বছর ৬৫ হাজার ৬৮০ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে খেলাপি ছিল ৫ হাজার ১৮৯ কোটি টাকা, যা ছিল মোট ঋণের ৭ দশমিক ৯০ শতাংশ।
চলতি বছরের জানুয়ারিতে জাতীয় সংসদে প্রকাশিত ঋণখেলাপির তালিকায় ৬টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নাম উঠে আসে। ঘুরেফিরে এই প্রতিষ্ঠানগুলোর নাম আসছে বিভিন্ন অনিয়মে। তালিকায় রয়েছে পিপলস লিজিং, বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি (বিআইএফসি), ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস, এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট, ফারইস্ট ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট এবং প্রিমিয়ার লিজিং অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট। এর মধ্যে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং, পিপলস লিজিং, এফএএস ফাইন্যান্স ও বিআইএফসির মালিকানায় ২০১৪ সালে অস্বাভাবিক পরিবর্তন আসে। এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের সাবেক এমডি প্রশান্ত কুমার হালদার নানা জালিয়াতির মাধ্যমে এসব প্রতিষ্ঠান থেকে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা বের করে নিয়ে যান বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন প্রতিবেদনে উঠে আসে।