দেশ থেকে বিনিয়োগ তুলে নেয়া হচ্ছে! বিনিয়োগের সুযোগ নিতে ১১ বাধা - Alokitobarta
আজ : শনিবার, ২২শে নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ৭ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

দেশ থেকে বিনিয়োগ তুলে নেয়া হচ্ছে! বিনিয়োগের সুযোগ নিতে ১১ বাধা


আলোকিত বার্তা:কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে বিভিন্ন দেশ থেকে বিনিয়োগ তুলে নেয়া হচ্ছে। বাংলাদেশ এসব বিদেশি বিনিয়োগের (এফডিআই বা ফরেন ডিরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট) নতুন গন্তব্যস্থল হতে চায়।এই লক্ষ্যে একটি কর্মকৌশল ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা প্রণয়নে কাজ শুরু করেছেন সরকারের সংশ্লিষ্টরা। তারা এ ব্যাপারে সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে একটি বৈঠক করেছেন।সেখানে মোটা দাগে ১১টি বাধা শনাক্ত করা হয়। নতুন করে বিদেশি বিনিয়োগ আনার আগেই এসব বাধা দূর করার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়। পাশাপাশি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে অর্থ মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।আরও জানা গেছে, এই মুহূর্তে বিদেশি বিনিয়োগে চিহ্নিত ১১ বাধার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে- করোনাভাইরাস প্রেক্ষাপটে স্থানান্তরিত বিনিয়োগ ধরতে দেশে কোনো ইনসেনটিভ বা প্রণোদনার ব্যবস্থা না থাকা।

এ ছাড়া আছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) থেকে ভেটিং না করে প্রকল্পের বা অন্য এজেন্সির সঙ্গে বিনিয়োগ সংক্রান্ত চুক্তি স্বাক্ষর, দেশি এবং বিদেশি কোম্পানির মধ্যে কর্পোরেট করবৈষম্য, দেশি ও বিদেশি কোম্পানির জন্য ভিন্ন বিনিয়োগ নীতি, দেশের বিনিয়োগ পরিবেশ সম্পর্কে বহির্বিশ্বে ইতিবাচক ভাবমূর্তি ও ঘাটতি, পিপিপিতে বিনিয়োগ সংক্রান্ত কর ও ভ্যাট জটিলতা, এনআরবি অ্যাকাউন্টধারী বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ ও মূলধন নিয়ে যাওয়া নিয়ে সমস্যা, ব্যাংকিং পদ্ধতিতে জটিলতা, নন-রেসিডেন্সিয়ালদের বিনিয়োগের ক্ষেত্রে উচ্চ করহার, বিদ্যমান পলিসি বাস্তবায়নে জটিলতা এবং অনলাইনে ব্যাংক হিসাব খোলার সীমাবদ্ধতা।এদিকে বৃহস্পতিবার বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি ট্রেড পলিসি নিয়ে এক কর্মশালায় উল্লিখিত বিষয় তুলে ধরেন।তিনি বলেছেন, কোভিড-১৯ প্রেক্ষাপটে স্থানান্তরিত বিনিয়োগ আনতে আশপাশের দেশগুলো যেসব সুবিধা দিচ্ছে, তা দেখে আমাদের অনেক কিছু পরিবর্তন করতে হবে। ট্যাক্স ও ভ্যাট জটিলতা দূর করতে হবে।এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সাবেক সিনিয়র অর্থ সচিব মাহবুব আহমেদ বলেন, কোভিড-১৯ প্রেক্ষাপটে জাপান, চীনসহ বেশকিছু দেশ থেকে বিনিয়োগ প্রত্যাহার হচ্ছে। এসব বিনিয়োগ ধরতে পারলে বাংলাদেশের জন্য খুবই ভালো হবে। এ জন্য বিদ্যমান আইন-বিধি আরও সংস্কার ও সহজ করতে হবে। অন্য দেশগুলো কী ধরনের পদক্ষেপ নিচ্ছে, সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে।প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকের কার্যপত্র থেকে জানা যায়, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব ড. আহমদ কায়কাউস বৈঠকে বলেছেন, বিদেশি বিনিয়োগের জন্য প্রণোদনার চেয়ে পরিবেশের ওপর বেশি জোর দিতে হবে।দেশে ১শ’টি অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলা হচ্ছে, সেদিকে নজর দিতে হবে। তিনি বলেন, জোন বা পণ্যভিত্তিক প্রণোদনা দেয়া গেলে সেটি আরও কার্যকর হবে।

চলতি বছর জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ধরা হয়েছে ৮ দশমিক ২ শতাংশ। এ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হলে জিডিপির ২৫ দশমিক ৩ শতাংশ বেসরকারি বিনিয়োগ দরকার। বর্তমানে এ বিনিয়োগ হার হচ্ছে ১২ দশমিক ৭ শতাংশ। প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে এ বছর সব পূর্বাভাসকে পাস কাটিয়ে বিনিয়োগ ১২ দশমিক ৭৫ শতাংশ বাড়াতে হবে। এ জন্য সরকার এফডিআইকে বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে।এদিকে বৈদেশিক সরাসরি বিনিয়োগপ্রবাহ অস্বাভাবিক হারে কমে যেতে পারে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়ন সংস্থা আঙ্কটাড। সংস্থাটি বলছে, ২০২০-২১ অর্থবছরে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) ৩০-৪০ শতাংশ কমে যেতে পারে।বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের মূল সমস্যাগুলো কী- এ প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গত ২৪ জুন সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সঙ্গে বৈঠক করে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব আহমদ কায়কাউসের সভাপতিত্বে বৈঠকটির বিষয়বস্তু ছিল ‘বাংলাদেশে বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার বিষয়ে কৌশল নির্ধারণ’।

সেখানে দেখা যায়, বৈঠকের শুরুতেই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে প্রশ্ন তোলা হয়, কোভিড-১৯ সংক্রমণের বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে বিশ্বব্যাপী যে বিনিয়োগ স্থানান্তরিত হচ্ছে, তা বাংলাদেশে কেন আসবে না। এরপর প্রত্যেকে তুলে ধরেন নানা সমস্যার কথা।বৈঠকে বলা হয়, করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে যেসব বিনিয়োগ স্থানান্তরিত হচ্ছে তা ধরতে থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়াসহ অনেক দেশ এরই মধ্যে ইনসেনটিভ ঘোষণা করেছে। থাইল্যান্ডে নতুন শিল্প স্থানান্তরের ক্ষেত্রে ১৩ বছরের জন্য কোনো জমির ভাড়া না নেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। পাশাপাশি নতুন বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ৫ বছর জমির কোনো ভাড়া নেবে না-এমন ঘোষণা দিয়েছে ইন্দোনেশিয়া।সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশ হাইটেক পার্ক (বিএইচটিপি), বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা), বাংলাদেশ অর্থনৈতিক জোন কর্তৃপক্ষ (বেজা) এবং বাংলাদেশ রফতানি প্রক্রিয়া জোন (বেপজা) থেকে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জমি দেয়ার ক্ষেত্রে ৫ বছরের জন্য ভাড়া মওকুফ করার প্রস্তাব দিয়েছেন বিএইচটিপির ব্যবস্থাপনা পরিচালক হোসনে আরা বেগম।

এনবিআরের প্রস্তাব : বৈঠকে এনবিআরের চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম জানান, অনেক ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে- বিভিন্ন প্রকল্পের বিষয়ে বা অন্য এজেন্সির সঙ্গে চুক্তির ক্ষেত্রে স্ব-স্ব প্রতিষ্ঠান এনবিআর থেকে ভেটিং না নিয়েই চুক্তিনামা স্বাক্ষর করছেন। ওই চুক্তি নামায় বিভিন্ন ভ্যাট ও ট্যাক্স মওকুফ করার বিষয় উল্লেখ করা থাকে। তিনি বলেন, কর্পোরেট ট্যাক্সের ক্ষেত্রে দেশি ও বিদেশি কোম্পানির মধ্যে বৈষম্য আছে। এটি থাকলে দেশি কোম্পানিগুলো প্রতিযোগিতায় টিকতে পারবে না।এ জন্য দেশি ও বিদেশি কোম্পানির জন্য কর্পোরেট করহার একই হওয়া বাঞ্ছনীয়। ভ্যাটের ক্ষেত্রে তিনি বলেন, যেটুকু ছাড় দিলে বিনিয়োগ বাড়বে সে ক্ষেত্রে বিশেষ অর্ডারের মাধ্যমে মওকুফের বিষয়ে এনবিআর প্রস্তুত আছে। সাধারণ নিয়মের বাইরে গিয়ে ‘কেস-টু-কেস’ সিদ্ধান্ত নিতে হবে।বৈঠকের কার্যপত্র থেকে জানা যায়, বিনিয়োগ সংক্রান্ত কোনো ধরনের চুক্তিনামায় কর অবকাশের বিষয়ে কিছু থাকলে চুক্তির আগেই তা এনবিআর থেকে ভেটিং করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এ ছাড়া কর্পোরেট কর না কমিয়ে অঞ্চল চিহ্নিত করে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য কর মওকুফ করার সিদ্ধান্ত হয়। পাশাপাশি ভ্যাটের ক্ষেত্রে জেনারেলের কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিশেষ অর্ডারের মাধ্যমে কেস-টু-কেস ভিত্তিতে সমাধান করার কথা বলা হয়।

বিডা : দেশে বিনিয়োগ পলিসি দেশি ও বিদেশি কোম্পানির জন্য ভিন্ন। অনেক সময় কেস-টু-কেস ভিত্তিতে পলিসি করা হয়, যা বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মধ্যে বিরূপ প্রভাব ফেলে।এমন তথ্য তুলে ধরে বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান মো. সিরাজুল ইসলাম ওই বৈঠকে বলেন, ‘কেস-টু-কেস’ মানেই বৈষম্যমূলক নীতি, যা রাখা উচিত হবে না। আর দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও আশা করেন যে, নীতি সবার জন্য একই রকম হবে এবং একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য হবে। সে ক্ষেত্রে জাতীয় পলিসির আলোকে একটি নীতিমালা থাকবে যেটি সবার (দেশি ও বিদেশি) জন্য প্রযোজ্য হবে।এ ছাড়া ‘ওয়ানস্টপ সার্ভিস’ বাস্তবায়নে পৃথক টাস্কফোর্স গঠন, কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য এসএমই খাতকে সহায়তা প্রদান এবং জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কাউন্সিলকে বেসরকারি খাতের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে কাজ করতে হবে।ওই বৈঠকে এসএমই খাত নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির বলেন, বেকারত্ব রোধে এসএমই বিশাল অবদান রাখছে। সে জন্য তাদের টিকিয়ে রাখতে হবে। এসএমইর জন্য মোট ৩০ হাজার কোটি টাকার প্যাকেজ নিয়ে কাজ চলছে বলে জানান তিনি।

বেপজা : কোভিড-১৯ প্রেক্ষাপটে স্থানান্তরিত বিদেশি বিনিয়োগ দেশে আনতে তিনটি প্রস্তাব বৈঠকে দিয়েছেন বেপজার নির্বাহী চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল এসএম সালাহ উদ্দিন ইসলাম। প্রস্তাবে বলা হয়, বেজা, বেপজা, বিডা ও বিএইচটিপির আওতাধীন শিল্পপ্রতিষ্ঠানের জন্য বৈষম্যহীন সমান সুযোগ ও প্রণোদনার ব্যবস্থা করতে হবে।ইপিজেডগুলোয় স্থাপিত ও স্থাপিতব্য শিল্পপ্রতিষ্ঠানের জন্য শুল্কমুক্ত ২/৩টি গাড়ি আনার সুযোগ এবং সব শ্রেণির শিল্পকারখানাকে সরকারের প্রদত্ত নগদ সহায়তা ও প্রণোদনার আওতায় নিয়ে আসা।

বেজার প্রস্তাব : বিদেশি বিনিয়োগকারীদের এ দেশে বিনিয়োগের জন্য বিশেষ প্রণোদনা ঘোষণার প্রস্তাব দেয়া হয় বেজার পক্ষ থেকে। সংস্থার নির্বাহী চেয়ারম্যান পবন চৌধুরী বৈঠকে বলেন, থাইল্যান্ড ও ইন্দোনেশিয়ার আলোকে বাংলাদেশকে প্রণোদনা ঘোষণা করতে হবে।আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ : বৈঠকে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের অনলাইনে দেশের ভেতর ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলার সমস্যার কথা তুলে ধরা হয়।সেখানে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব মো. আসাদুল ইসলাম জানান, দেশের অনিবাসী বাংলাদেশি হিসাবধারী বিনিয়োগকারীরা তাদের লভ্যাংশ বা মূলধন খুব সহজে ফেরত নিয়ে যেতে পারবেন কি না, তা নিয়ে সন্দিহান থাকেন। এখানে যে পলিসি বা আইন রয়েছে সেটি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে জোর দেয়া উচিত। যদিও আইনে তেমন বাধা নেই।তবে ব্যাংকের যে ওয়ার্কিং প্রসেস রয়েছে সেগুলো খুব জটিল। এসব আরও সহজ করা, ব্যাংকিং পদ্ধতিতে আরও যুগোপযোগী ও আধুনিক করে গড়ে তুলতে হবে।

পিপিপি কর্তৃপক্ষের প্রস্তাব : বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে কর-ভ্যাটের জটিলতা তুলে ধরেছে পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) কর্তৃপক্ষ। সেখানে বলা হয়, নন-রেসিডেন্সিয়াল কেউ বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে চাইলে বা তাদের যদি কোনো কোম্পানি থাকে সে ক্ষেত্রে ভ্যাট দিতে হয় ২০ শতাংশ। আবার পৃথকভাবে বিনিয়োগ করতে চাইলে তাদের ভ্যাট দিতে হয় ৩০ শতাংশ। এ ক্ষেত্রে কর অব্যাহতির সুবিধা দেয়া হলে বিদেশি বিনিয়োগ আরও বাড়বে।

Top