সরকারের নানারকম শর্ত আরোপে সঞ্চয়পত্রের বিক্রি কমেছে
আলোকিত বার্তা:মহামারী করোনাভাইরাস সৃষ্ট অর্থনৈতিক সংকটের পাশাপাশি সরকারের নানারকম শর্ত আরোপে সঞ্চয়পত্রের বিক্রি কমেছে।বিদায়ী অর্থবছরের(২০১৯-২০) প্রথম ১১ মাসে (জুলাই-মে) সঞ্চয়পত্র বিক্রির নিট পরিমাণ ছিল ১১ হাজার ১১ কোটি টাকা।একই সময়ে আগের অর্থবছরে (২০১৮-১৯) এর পরিমাণ ছিল ৪৬ হাজার ৭১৩ কোটি টাকা। এ হিসাবে ১১ মাসে সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমেছে ৩৫ হাজার ৭০২ কোটি টাকা, যা ৭৬ শতাংশের কিছুটা বেশি। জাতীয় সঞ্চয় অধিদফতরের হালনাগাদ প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা গেছে।সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনার প্রাদুর্ভাবে অনেকে বেকার হয়েছেন। আবার অনেকের চাকরি আছে কিন্তু বেতন পাচ্ছেন না। এমতাবস্থায় সঞ্চয় তো দূরের কথা উল্টো জমানো অর্থ ভাঙছেন সব শ্রেণি-পেশার মানুষ। তারা বলেন, সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত করতে সুদহার না কমিয়ে নানা শর্ত জুড়ে দিয়েছে সরকার। এসব কারণেও সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমে গেছে।জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন,প্রধানত দুই কারণে সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমেছে। আইনগত কড়াকড়ি এবং মহামারী করোনার সংকট।
বিনিয়োগের সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে এবং আয়করের হার বাড়ানো হয়েছে। এছাড়া আরও কিছু শর্ত জুড়ে দেয়ায় সঞ্চয়পত্র ক্রয়ে অনীহা সৃষ্টি হয়েছে। এখন সহজে সঞ্চয়পত্র কেনা যায় না। করোনার আঘাতে বিপর্যস্ত অনেকে সঞ্চয় ভাঙছেন।এ প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, প্রথম দিকে সরকারের কড়াকড়ি পরে করোনায় অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছেন সঞ্চয়কারীরা। অনেকে ঢাকা ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। কেউবা আগের বাসা ছেড়ে দিয়ে অপেক্ষাকৃত কম ভাড়ায় বাসা নিচ্ছেন। এভাবে যেখানে বাসা ছেড়ে দিতে হচ্ছে সেখানে সঞ্চয়ের তো কোনো সুযোগ নেই। এসব কারণে অস্বাভাবিক হারে সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমেছে।সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) শফিকুর রহমান বলেন, মানুষের হাতে টাকা নেই। সঞ্চয় করবে কীভাবে। করোনায় মধ্যবিত্ত প্রায় শেষ। নিুবিত্ত তো করোনার প্রথম ধাক্কায় শেষ হয়ে গেছে। রাস্তায় বের হলে শুধু টু-লেট আর টু-লেট। অর্থাৎ বাসা ভাড়া দেয়ার বিজ্ঞপ্তি। এর অর্থ মানুষ বাসা ছেড়ে চলে যাচ্ছে। সাধারণ মানুষের জন্য কোনো প্রণোদনা নেই। ভবিষ্যৎ খুবই অন্ধকার।জানা গেছে, গত কয়েক বছর সঞ্চয়পত্রের অস্বাভাবিক বিক্রি বেড়ে যাওয়ায় এ খাতের ওপর বেশ কয়েকটি বিধিনিষেধ আরোপ করে সরকার। আগে সঞ্চয়পত্র কেনার জন্য কোনো ক্রেতাকে কর শনাক্ত নম্বর বা ই-টিআইএন জমা দিতে হতো না। কিন্তু এখন এক লাখ টাকার বেশি সঞ্চয়পত্র কিনতে তা বাধ্যতামূলক।এছাড়া সঞ্চয়পত্রে বড় বিনিয়োগে কঠোর হয়েছে সরকার। ভবিষ্যৎ তহবিল বা প্রভিডেন্ট ফান্ডের অর্থে সঞ্চয়পত্র কেনার সুযোগ নেই। অনলাইনে মনিটর করায় সীমার অতিরিক্ত বা একই নামে বিভিন্ন জায়গা থেকে সঞ্চয়পত্র কেনার সুযোগ নেই। এসব কারণে সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমেছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরের (জুলাই-মে) ১১ মাসে ৫৭ হাজার ৮০৪ কোটি ৯৫ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে।
এর বিপরীতে মূল পরিশোধ হয়েছে ৪৬ হাজার ৭৯৪ কোটি টাকা। মূল অর্থ পরিশোধের পর অবশিষ্ট অর্থ নিট বিক্রি হিসেবে গণ্য হয়। সেই হিসেবে আলোচিত সময়ে নিট বিক্রির পরিমাণ ১১ হাজার ১১ কোটি টাকা। একই সময়ে আগের অর্থবছরে (২০১৮-১৯) সঞ্চয়পত্র বিক্রির পরিমাণ ছিল ৬৩ হাজার ৬৩০ কোটি টাকা এবং নিট বিক্রি ছিল ৪৬ হাজার ৭১৩ কোটি টাকা।সে হিসাবে আগের অর্থবছরের তুলনায় বিদায়ী অর্থবছরে (২০১৯-২০) সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রি কমেছে ৭৬ দশমিক ৪৩ শতাংশ। আর একক মাস হিসেবে চলতি বছরের মে মাসে তিন হাজার ২২৭ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। এর মধ্যে মূল ও মুনাফা পরিশোধ করা হয়েছে দুই হাজার ৭৯৬ কোটি টাকা। ফলে মাসটিতে সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রি ৪৩০ কোটি টাকায় নেমে এসেছে।এদিকে সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমে যাওয়ায় সাত বছর পর সংশোধিত বাজেটে সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নেয়ার পরিমাণ অর্ধেকের বেশি কমিয়ে এনেছে সরকার। গত অর্থবছরে (২০১৯-২০) মূল বাজেটে সঞ্চয়পত্র খাতে ঋণ গ্রহণের লক্ষ্যমাত্রা ২৭ হাজার কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়। সংশোধিত বাজেটে এটি কমিয়ে ১১ হাজার ৯২৪ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়। অর্থাৎ ১৫ হাজার ৭৬ কোটি টাকা কাটছাঁট করা হয়।অপরদিকে চলতি অর্থবছরের (২০২০-২১) প্রস্তাবিত বাজেটে ঘাটতি ধরা হয়েছে ১ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা। বিশাল ঘাটতি মেটাতে এবার সঞ্চয়পত্র থেকে ২০ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেয়ার লক্ষ্য ঠিক করেছে সরকার।