খেলাপি ঋণ আদায়ে সরকারকে দেয়া প্রতিশ্রুতি রাখতে পারেনি ১৭ ব্যাংক - Alokitobarta
আজ : বৃহস্পতিবার, ২০শে নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ৫ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

খেলাপি ঋণ আদায়ে সরকারকে দেয়া প্রতিশ্রুতি রাখতে পারেনি ১৭ ব্যাংক


আলোকিত বার্তা:খেলাপি ঋণ আদায়ে সরকারকে দেয়া প্রতিশ্রুতি রাখতে পারেনি ১৭ ব্যাংক, বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান। শ্রেণিকৃত ঋণ হ্রাসকরণ, খেলাপি থেকে আদায়, অবলোপন করা ঋণ কমানো, রিট মামলা নিষ্পত্তিকরণ, অর্থঋণ আদালতের মামলা নিষ্পত্তিসহ বিভিন্ন সূচকে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের বেঁধে দেয়া সময় শেষ হয়েছে গত ডিসেম্বর।১৭টি ব্যাংক-বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অর্ধবার্ষিক কর্মসূচি মূল্যায়ন প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এসব তথ্য। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের এক বৈঠকে প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করা হয়।জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন,শুধু লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করলে তা অর্জন সম্ভব নয়। এর গভীরে পৌঁছতে হবে। কোন কারণে ঋণখেলাপি এবং অবলোপন করা হয়েছে, তা আগে খুঁজে বের করতে হবে।সাধারণত রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে প্রথমে ঋণ অনিয়ম এবং পরে খেলাপিতে পরিণত হয়। এ ধরনের পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন এখনও হয়নি। এছাড়া আদালতের স্থিতাবস্থার আদেশের মাধ্যমে বছরের পর বছর আটকে আছে অনেক ঋণ। আইনি সংস্কার ছাড়া মামলাজট খোলা সম্ভব নয়। আগে সমস্যার গোড়ায় হাত দিতে হবে। তবেই লক্ষ্য অর্জন সম্ভব হতে পারে। কাগুজে পদক্ষেপে কোনো দিন এ ধরনের খারাপ ঋণ আদায় হবে না।

অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোহাম্মদ শামস উল ইসলাম বলেন,অধিকাংশ সূচকে ভালো করেছে অগ্রণী ব্যাংক। কয়েকটি সূচক অর্জন সম্ভব হয়নি। কারণ লক্ষ্যমাত্রা বেশি নির্ধারণ করা হয়েছে। বিশেষ করে মামলায় কিছু টাকা আটকে আছে। একটা ট্রাইব্যুনাল গঠন হলে সমাধান করা সম্ভব হবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।কৃষি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আলী হোসেন প্রধানিয়া বলেন, ঋণের পরিমাণ কম, সংখ্যা বেশি। সে কারণে একটু সময় লাগছে। চেষ্টা অব্যাহত রাখছি। আশা করি, খেলাপি ও অবলোপনের টাকা আদায় করা সম্ভব হবে। প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, রাষ্ট্রায়ত্ত ৬টি ব্যাংকের মধ্যে অধিকাংশই কাঙ্ক্ষিত পরিমাণ খেলাপি ঋণ কমাতে পারেনি।বিদায়ী বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত জনতা ব্যাংকের খেলাপি ঋণ কমিয়ে ১০ হাজার কোটি টাকায় নামানোর লক্ষ্যমাত্রা ছিল। কিন্তু ২০১৯ শেষে ব্যাংকের মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৪ হাজার ৪৫৩ কোটি টাকা। অর্থাৎ ব্যাংকটি লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ ১৪৫ শতাংশ।একইভাবে রূপালী ব্যাংকের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। কিন্তু ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকটির মোট খেলাপি ৪ হাজার ২২৬ কোটি টাকায় অবস্থান করছে। লক্ষ্য অর্জনে ১১৪ শতাংশ পিছিয়ে রূপালী। খেলাপি ঋণ ৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকায় নামিয়ে আনার কথা ছিল অগ্রণী ব্যাংকের।

কিন্তু নির্ধারিত সময় শেষে ৬ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে ব্যাংকটির মোট খেলাপি। লক্ষ্য অর্জনে পিছিয়ে ১০৭ শতাংশ। একই অবস্থা বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেডেরও (বিডিবিএল)। ২০১৯ সাল শেষে ব্যাংকের মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৭০০ কোটি টাকায় নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু সময় শেষে ব্যাংকটির খেলাপি দাঁড়িয়েছে ৭৬৪ কোটি টাকা। লক্ষ্য অর্জনে পিছিয়ে ১০৯ শতাংশ। তবে সোনালী ও বেসিক ব্যাংক অর্থ মন্ত্রণালয়ের নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার কাছাকাছি যেতে সক্ষম হয়েছে।
প্রতিবেদনে দেখা গেছে, শ্রেণিকৃত ঋণ থেকে আদায় একেবারেই কম। কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছতে পারেনি সরকারি খাতের কোনো ব্যাংক। সোনালী, জনতা, অগ্রণী, রূপালী, বেসিক ও বিডিবিএল ব্যাংকের আদায় যথাক্রমে ৪২, ৫২, ৩৩, ৩৪, ৮৭ ও ৩০ শতাংশ। অবলোপনকৃত ঋণ থেকে আদায়ের অবস্থাও খারাপ। উল্লিখিত ব্যাংকগুলো ২০১৯ শেষে অবলোপনকৃত ঋণ থেকে আদায় করেছে যথাক্রমে ১৮, ৪৪, ১১২, ১১, ১৮৭ ও ৭ শতাংশ।প্রাপ্ত তথ্যমতে, শুধু অগ্রণী ব্যাংক ছাড়া পরিচালন মুনাফার লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ সরকারি খাতের সব ব্যাংক। বিদায়ী বছরের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সোনালী ব্যাংকের পরিচালন মুনাফার লক্ষ্য ছিল ১ হাজার ৯০০ কোটি টাকা। কিন্তু সময় শেষে ব্যাংকটির মুনাফা ১ হাজার ২৭৬ কোটি টাকা, যা নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় কম বা ৬৭ শতাংশ।

জনতা ব্যাংকের লক্ষ্য ছিল ১ হাজার কোটি। এর বিপরীতে পরিচালন মুনাফা অর্জন হয়েছে ৬৮৮ কোটি টাকা। এছাড়া অগ্রণী, রূপালী, বেসিক ও বিডিবিএলের পরিচালন মুনাফা যথাক্রমে ১০৮, ২৯, (-২৩২৪২), ও ৩৬ শতাংশ। আলোচ্য সময়ে বেসিক ব্যাংকের পরিচালন মুনাফার লক্ষ্য ছিল মাত্র ১ কোটি টাকা। কিন্তু এই সময়ে ব্যাংকটির মুনাফা না বেড়ে উল্টো কমেছে। এই ছয় মাসে বেসিক ব্যাংক ২৩২ কোটি টাকার লোকসানে পড়েছে।লোকসানি শাখা কমানোর ক্ষেত্রেও ঋণাত্মক অবস্থানে রয়েছে বেসিক ব্যাংক। শুধু বেসিক নয়, বিডিবিএল ও অগ্রণী ব্যাংকও অর্জন করতে পারেনি লোকসানি শাখা কমানোর লক্ষ্য। ডিসেম্বর শেষে অগ্রণী ব্যাংকের মোট লোকসানি শাখা হওয়ার কথা ছিল ৬০টি। কিন্তু শাখা কার্যক্রম ভালো না হওয়ায় ৭০টিতে দাঁড়িয়েছে ব্যাংকের মোট লোকসানি শাখা।একই সময়ে বেসিক ব্যাংকের মোট লোকসানি শাখা ২৬টি। কিন্তু নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৫টিতে কমিয়ে আনা। অন্যদিকে বিডিবিএলের লোকসানি শাখা কমিয়ে ১৪টিতে নামিয়ে আনার কথা থাকলেও বছর শেষে ব্যাংকটির মোট লোকসানি শাখা দাঁড়িয়েছে ১৭টি।

এদিকে বাংলাদেশ হাউজবিল্ডিং ফাইন্যান্স কর্পোরেশনের (বিএইচবিএফসি) অধিকাংশ সূচক সন্তোষজনক নয়। ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগর এলাকায় ঋণ বিতরণ, সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে গৃহঋণ বিতরণ, কর্পোরেশন কর্মচারীদের মধ্যে গৃহঋণ বিতরণ, শ্রেণিকৃত ঋণ থেকে আদায় ও শ্রেণিকৃত ঋণের হার কমানের ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। আলোচ্য সময়ে শ্রেণিকৃত ঋণ থেকে লক্ষ্যমাত্রার ৪২ শতাংশ অর্জন করছে বিএইচবিএফসি।একই অবস্থা ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি)। অধিকাংশ সূচক সন্তোষজনক অবস্থানে নেই। পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রার ৩৭ শতাংশ, স্টক এক্সচেঞ্জগুলোর লেনদেনের পরিমাণ বৃদ্ধিতে ২৮ শতাংশ, নতুন বিনিয়োগকারী বৃদ্ধিতে ২২ শতাংশ, বিনিয়োগে ঋণ সহায়তায় ১৪ শতাংশ, ঋণ আদায়ে ৩৮ শতাংশ ও শ্রেণিকৃত ঋণ থেকে আদায়ে মাত্র ১০ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করেছে আইসিবি।কয়েকটি সূচকে ভালো করলেও অনেক সূচকেই লক্ষ্যে পৌঁছতে পারেনি জীবন বীমা কর্পোরেশন। বিনিয়োগ থেকে আয়, মাঠ পর্যায়ে বীমা প্রতিনিধির সংখ্যা বৃদ্ধি ও উত্থাপিত অডিট আপত্তি নিষ্পত্তিতে খুবই খারাপ অবস্থা জীবন বীমা কর্পোরেশনের। ২০১৯ সালের শেষ ছয় মাসে ৫০টি আপত্তি নিষ্পত্তি করার কথা থাকলেও একটিও নিষ্পত্তি করতে পারেনি প্রতিষ্ঠানটি।এছাড়া বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক, প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক, আনসার ভিডিপি উন্নয়ন ব্যাংক, কর্মসংস্থান ব্যাংক, মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি, সাধারণ বীমা কর্পোরেশন এবং বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব ক্যাপিটাল মার্কেটও বিভিন্ন সূচকে বেঁধে দেয়া লক্ষ্য অর্জন করতে পারেনি।সোস্যাল ইসলামী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) শফিকুর রহমান বলেন,রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলোকে দীর্ঘদিন ধরে খেলাপি ঋণ আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা দিয়ে আসছে সরকার। কিন্তু বাস্তবে আদায় কত হচ্ছে? মূলত গতানুগতিক লক্ষ্যমাত্রা নয়, দিতে হবে বাস্তবভিত্তিক লক্ষ্যমাত্রা। এতে অর্জন হলে পুরস্কার এবং ব্যর্থ হলে তিরস্কারের ব্যবস্থা রাখতে হবে। তা না হলে কোনোদিন লক্ষ্য অর্জন সম্ভব নয়।প্রসঙ্গত, সরকারি নীতি ও কর্মসূচির যথাযথ বাস্তবায়নের মাধ্যমে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন এবং সরকারি কর্মকাণ্ডে দায়বদ্ধতা নিশ্চিতকরণের জন্য ২০১৪-১৫ অর্থবছর থেকে সরকারি কর্মসম্পাদন ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি চালু করা হয়। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনে দেয়া হয় কিছু দিকনির্দেশনা। ২০১৯ সালে এ সংক্রান্ত একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের অধীন সংস্থাগুলোর সঙ্গে। সে চুক্তিরই ছয় মাসের নানা দিক পর্যালোচনা করা হয়।

Top