চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের বিরুদ্ধে জোরালো অবস্থান নিয়েছেন প্রশাসনে কর্মরত বেশিরভাগ কর্মকর্তা।
আলোকিত বার্তা:চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের বিরুদ্ধে জোরালো অবস্থান নিয়েছেন প্রশাসনে কর্মরত বেশিরভাগ কর্মকর্তা।বিশেষ করে সচিব পদে নিয়োগপ্রত্যাশী কর্মকর্তারা প্রশাসনের শীর্ষপদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ প্রজ্ঞাপন আর দেখতে চান না।তাদের সাফ কথা,একান্ত প্রয়োজন ছাড়া কেউ যেন সচিব পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ নিতে না পারেন।সত্যিকারার্থে জনস্বার্থ ছাড়া কাউকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিলে প্রশাসনে ক্ষোভ-হতাশা আরও বাড়বে।
পদোন্নতি বাধাগ্রস্ত হওয়া ছাড়াও দক্ষ,মেধাবী কর্মকর্তারা সৃষ্টিশীল কাজের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলবেন।প্রসঙ্গত,চলতি ডিসেম্বরে অবসরে যাবেন ১০ জন সচিব।এ ছাড়া ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তিন মাসে ১৯ জন সচিবের চাকরির মেয়াদ শেষ হবে।অবসরমুখী সচিবদের অনেকে গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় ও দফতরে কর্মরত।
ক্ষুব্ধ কর্মকর্তাদের অনেকে বলেন,চলতি মাসে বেশ কয়েকজন সচিবের চাকরির মেয়াদ শেষ হবে।কিন্তু অনেকে চাকরিতে বহাল থাকতে মরিয়া হয়ে মাঠে নেমেছেন।চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ চান তারা।কেউ চান পুনঃচুক্তি।এক সময় যারা চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের ঘোরবিরোধী ছিলেন,তারাও এখন ব্যক্তিস্বার্থে এ কাতারে শামিল হয়েছেন। কারও কারও তদবির সুপ্রসন্ন বলে বাজারে নানা রকম খবরও ছড়িয়েছে।তবে সাধারণ কর্মকর্তারা মনে করেন,দক্ষতা ও সফলতা বিবেচনায় নিলে ২-৩ জন ছাড়া অন্যদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের প্রত্যাশা করা অযৌক্তিক।যারা নিজের ক্যারিশমেটিক যোগ্যতা দিয়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলাসহ নিজের মন্ত্রণালয়ে অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জনে রেকর্ড গড়েছেন, শুধু তারাই চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের প্রত্যাশা করতে পারেন।সে ক্ষেত্রে তারা না চাইলেও সরকার তাদের রাখতে চাইবে। এবারও নিশ্চয় তেমন সিদ্ধান্ত উপহার দেবেন প্রধানমন্ত্রী। প্রশাসনের কর্মকর্তারাও তাদের ওয়েলকাম জানাবে।
কিন্তু চাকরির মেয়াদ শেষ হলেই গড়পড়তা সবাইকে চুক্তি দিতে হবে,না হলে প্রশাসন রসাতলে যাবে-এমনটি ভাবার কোনো কারণ নেই।মনে রাখা দরকার,চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ সরকারের তরফ থেকে পাওয়ার বিষয়,তদবির করে নেয়ার বিষয় নয়।যেসব কর্মকর্তা তদবির করে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেতে চান, তাদের দিয়ে আর যাই হোক সরকারের কোনো লাভ হবে না।এ বিষয়ে তারা প্রধানমন্ত্রীর সদয় দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন,নতুনদের দায়িত্ব দিলে প্রশাসন আরও গতিশীল হবে।সচিব পদে নিয়োগ না পেলে ওই পদে যোগ্যতা প্রমাণ করার সুযোগ থাকে না।তারা বলেন, অবসরপ্রাপ্ত সচিবরা দেশ সেবায় মনোনিবেশ করতে চাইলে তারা পৃথক একটি প্লাটফরম গড়ে তুলতে পারেন।সেখান থেকে সুসংগঠিতভাবে সরকারকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেয়ার পাশাপাশি নানা রকম ওয়েলফেয়ার কাজে তাদের সম্পৃক্ত হওয়ার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে।এতে অবসরপ্রাপ্ত সচিবদের মেলবন্ধনের বিশেষ জায়গাও তৈরি হবে।এদিকে কর্মরত সচিবদের মধ্যে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব কবির বিন আনোয়ার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের বিরুদ্ধে নিজের নৈতিক অবস্থান তুলে ধরে সম্প্রতি ফেসবুকে (কর্মকর্তাদের সংরক্ষিত গ্রুপ পেজে) স্ট্যাটাস দিয়েছেন।
সেখানে তিনি চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের বিরুদ্ধে দু’বছর আগে বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির ৮ম সভায় গৃহীত সিদ্ধান্তের কথা নীতিনির্ধারক মহলকে পুনরায় স্মরণ করিয়ে দেন।বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির ৮ম সভা অনুষ্ঠিত হয় ২০১৭ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর। সভায় চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের বিরুদ্ধে বিস্তর আলোচনা হয়।সভার কার্যবিবরণীর এক স্থানে বলা হয়,সভার বিবিধ আলোচনায় মহাসচিব বলেন, সম্প্রতি সরকারের বিভিন্ন পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পরিলক্ষিত হচ্ছে, এতে স্বাভাবিক পদোন্নতির ধারা ক্ষুণ্ণ হচ্ছে এবং প্রশাসনের সর্বস্তরে ক্ষোভের সৃষ্টি হচ্ছে।
আলোচনায় অংশ নিয়ে সদস্যবৃন্দ চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল এবং অতি প্রয়োজনীয় এবং বিশেষজ্ঞ ব্যতীত চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ ভবিষ্যতে না দেয়ার বিষয়ে মতামত প্রদান করেন।এ ছাড়া প্রশাসনে পদোন্নতির বিষয়টি নিয়মিত করার জন্য অনুরোধ করা হয়।এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে সভায় বলা হয়,অত্যাবশ্যকীয় কারণ ব্যতীত চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ প্রদান না করার জন্য সরকারের কাছে আবেদন করা হবে।উল্লিখিত বিষয়টি সভার কার্যবিবরণীতে বলা আছে।উল্লেখ করা যেতে পারে, কবির বিন আনোয়ার অবসরে যাবেন ২০২৩ সালের ৩ জানুয়ারি। তিনি ২০১৭ সালে অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব ছিলেন।
নিয়মানুযায়ী কোনো কর্মকর্তা অতিরিক্ত সচিব পদে এক বছর দায়িত্ব পালন করলে সরকার চাইলে তাকে ভারপ্রাপ্ত সচিব হিসেবে নিয়োগ দিতে পারে।
যদিও মেধাবী কর্মকর্তারা ভারপ্রাপ্ত সচিব নিয়োগের পরিবর্তে জ্যেষ্ঠতা ও মেধা যোগ্যতার ভিত্তিতে সচিব পদে পদোন্নতি পেতে বেশি আগ্রহী।বর্তমানে অতিরিক্ত সচিব পদে মোট কর্মকর্তার সংখ্যা ৫৯৪ জন। এর মধ্যে সর্বশেষ পদোন্নতি পেয়ে যুগ্ম সচিব থেকে অতিরিক্ত সচিব হয়েছেন ১৫৮ জন।
যাদের নিয়মিত ব্যাচ হিসেবে ১১তম ব্যাচকে বিবেচনায় নেয়া হয়।এর আগে ১০ম ব্যাচের কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে অতিরিক্ত সচিব করা হয় গত বছর ২৯ আগস্ট।অতিরিক্ত সচিব পদে এক বছরের বেশি সময় অতিবাহিত হওয়ায় নিয়মানুযায়ী তারা সচিব হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছেন। যদিও বাস্তবতা সেটি বলছে না।কেননা,তাদের ওপরে সিনিয়র হিসেবে ৮৫, ৮৬ ও ৯ম ব্যাচের বহু কর্মকর্তা সচিব হওয়ার জন্য অপেক্ষায় আছেন। সচিব হিসেবে বর্তমানে ৮৬ ব্যাচ পর্যন্ত যুক্ত করা হয়েছে।
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী ১৫ ডিসেম্বর অবসরে যাবেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম,৩০ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব মো.নজিবুর রহমান,৩১ ডিসেম্বর মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সিনিয়র সচিব মো.সোহরাব হোসাইন,একই তারিখে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব বেগম জুয়েনা আজিজ, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিব ফয়েজ আহম্মদ,২০ ডিসেম্বর খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব শাহাবুদ্দিন আহমেদ,৩১ ডিসেম্বর মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. রইছউল আলম মন্ডল এবং ৯ ডিসেম্বর ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের সচিব অশোক কুমার বিশ্বাস।এ ছাড়া চুক্তিভিত্তিক নিয়োজিত তথ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব আবদুল মালেকের মেয়াদ শেষ হবে ৩০ ডিসেম্বর এবং একই তারিখে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব আখতার হোসেন ভূঁইয়া।অপরদিকে ৫ জানুয়ারি অবসরে যাবেন জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগের সিনিয়র সচিব আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম, ৩১ জানুয়ারি ভূমি আপিল বোর্ডের চেয়ারম্যান মো. আবদুল হান্নান, ১০ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব সাজ্জাদুল হাসান এবং ৫ জানুয়ারি বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মহিবুল হক।
এ ছাড়া চুক্তিতে নিয়োজিত জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান মো.মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়ার মেয়াদ শেষ হবে ২ জানুয়ারি।২৮ ফেব্রুয়ারি অবসরে যাবেন নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিব মো.আবদুস সামাদ,২২ ফেব্রুয়ারি মনোয়ার আহমেদ,১৫ ফেব্রুয়ারি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব এসএম আরিফ উর রহমান,৯ ফেব্রুয়ারি জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নির্বাহী চেয়ারম্যান(সচিব)মো.ফারুক হোসেন।সূত্র জানায়,সিনিয়র সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম মন্ত্রিপরিষদ সচিব হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন গত ১৩ অক্টোবর।এ জন্য ১৫ ডিসেম্বর তার অবসর প্রস্তুতিমূলক ছুটিতে যাওয়ার কথা থাকলেও তার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পাওয়ার বিষয়টি অনেকটা প্রাসঙ্গিক।
এ ছাড়া তদবির না করলেও ৮৫ ব্যাচের দু’জন সচিবের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।অপরদিকে এই ব্যাচের একজন সচিবের চাকরির মেয়াদ শেষ হবে জানুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে।কিন্তু তিনি নিজ থেকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ চান না।ভবিষ্যতে নিজ এলাকা থেকে তার নির্বাচন করার গুঞ্জন রয়েছে।সে জন্য সময় থাকতে সব প্রস্তুতি গুছিয়ে নিতে চান তিনি।এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবের গুরুত্বপূর্ণ পদটি শূন্য হবে ৩০ ডিসেম্বর।
ওই পদে বিদ্যুৎ বিভাগের সিনিয়র সচিব ড.আহমদ কায়কাউস নিয়োগ পেতে পারেন।৯ম ব্যাচ থেকেও সরকারের গুডবুকে থাকা একজনকে গুরুত্বপূর্ণ পদে ভারপ্রাপ্ত সচিবের দায়িত্ব দেয়া হতে পারে।নির্ভরযোগ্য সূত্রগুলো এমনটিই আভাস দিয়েছে।এ ছাড়া স্বল্পসময়ের ব্যবধানে প্রশাসনের শীর্ষ পর্যায়ে বেশকিছু পদ খালি হওয়াকে কেন্দ্র করে কয়েকজন সচিবের দফতর রদবদল হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।সে ক্ষেত্রে ইতিমধ্যে যারা দৃশ্যমান দক্ষতার প্রমাণ দিতে সমর্থ হয়েছেন,এমন কয়েকজন সচিবকে অপেক্ষাকৃত গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়/বিভাগে পদায়ন করা হতে পারে।এসব বিষয়ে করণীয় নির্ধারণে আগামীকাল সোমবার সরকারের উচ্চপর্যায়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের সম্ভাবনা রয়েছে।