সারা দেশে ঘরে ঘরে ডেঙ্গু-চিকুনগুনিয়া আতঙ্কিত সাধারণ মানুষ - Alokitobarta
আজ : শুক্রবার, ১৯শে সেপ্টেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ৪ঠা আশ্বিন, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

সারা দেশে ঘরে ঘরে ডেঙ্গু-চিকুনগুনিয়া আতঙ্কিত সাধারণ মানুষ


ডা:মুন্সী মুবিনুল হক:চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্তদের সারা শরীরে তীব্র ব্যথা ছাড়াও অনেকে ঠিকমতো হাঁটতেও পারছেন না। এছাড়া চিকিৎসাব্যবস্থার নানা সীমাবদ্ধতার কারণে এ রোগ সহসা চিহ্নিত করা সম্ভব হচ্ছে না।এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে।রাজধানী ঢাকা ছাড়াও সারা দেশে ঘরে ঘরে এ দুটি রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে।এ কারণে সময়মতো চিকিৎসা না হওয়ায় অনেকের ভোগান্তির পাশাপাশি চিকিৎসা ব্যয়ও বাড়ছে।করে মফস্বল এলাকায় ডাক্তাররা চিকুনগুনিয়া চিহ্নিত করতে না পেরে অনেক সময় ভুল চিকিৎসাও দিচ্ছেন। এসব কারণে ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া নিয়ে জনমনে এক ধরনের আতঙ্ক বিরাজ করছে। যুগান্তরের অনুসন্ধানে এ বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য-উপাত্ত বেরিয়ে এসেছে।এদিকে মশা নিয়ন্ত্রণে সেই আগের মতো সিটি করপোরেশনগুলোর দায়িত্বহীনতা ও ব্যর্থতার বিষয়টি সামনে আসছে। যদিও নাগরিক সেবার সরকারি এ প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মকর্তাদের দাবি, তারা তাদের দায়িত্ব পালনে বেশ সক্রিয়।

বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা : রাজধানীর মহাখালীতে রয়েছে ডিএনসিসি’র ডেডিকেটেড কোভিড-১৯ হাসপাতাল। সেখানে প্রতিদিন গড়ে ৬ থেকে ৭শ রোগী ডেঙ্গুজ্বরের উপসর্গ নিয়ে চিকিৎসার জন্য আসছেন। গত শনিবার ৭২ জন এবং রোববার দুপুর পর্যন্ত ভর্তি হন ৬০ জন। ভর্তি রোগীদের ৪০ শতাংশ পুরুষ, ৪০ শতাংশ নারী ও ২০ শতাংশ শিশু। ঢাকার বাইরে থেকেও অনেকে রোগী আসছে। হাসপাতালের চিকিৎসকরা জানান, এক হাজার শয্যার চিকিৎসাকেন্দ্রটিতে ৩৫০ শয্যা সেবা কার্যক্রম চালু রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় অর্ধেক শয্যায় ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। চিকিৎসা নিতে আসা ডেঙ্গু রোগীদের বেশির ভাগই জটিল পরিস্থিতি নিয়ে আসছে। রোববার ডেঙ্গু নিয়ে ভর্তি ছিলেন ১১০ জন রোগী। তবে তাদের মধ্যে গড়ে ৬ শতাংশ রয়েছে আইসিইউতে। বেশির ভাগ রোগী সুস্থ হচ্ছে।

কীভাবে বুঝবেন : স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার (সিডিসি) লাইন ডিরেক্টর ডা. হালিমুর রশীদ বলেন, এডিস মশার কামড়ে ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হয়। চিকুনগুনিয়ায় শরীরের জয়েন্টগুলোতে বেশি ব্যথা হয়। অন্যদিকে ডেঙ্গুজ্বরের সঙ্গে তীব্র মাথাব্যথা, চোখের পেছনে ব্যথা, হাড় বা মাংসে ব্যথা বা শরীরে মারাত্মক ব্যথা, বমি ভাব বা বমি করা ও খাবারে অরুচি দেখা দেয়। অনেকের ভাইরাল ফিভারেও এসব উপসর্গ থাকতে পারে। ডেঙ্গুজ্বর শুরুর প্রথম তিন থেকে চার দিনের মধ্যে এনএস-১ পরীক্ষা করে অ্যান্টিজেন (ভাইরাস) শনাক্ত সম্ভব। চিকুনগুনিয়ার ক্ষেত্রে জ্বরের প্রথম পাঁচ দিনের মধ্যে পিসিআর টেস্ট করতে হয়। এনএস-১ জন্য সরকারি হাসপাতালে মাত্র ৫০ টাকা। আরপিসিআর টেস্টেও বেশি খরচ লাগে না। হাসপাতালগুলো চাইলে পোস্ট ডেঙ্গু এবং পোস্ট চিকুনগুনিয়া ক্লিনিক চালু করতে পারে।

কেসস্টাডি : নাম সিরাজুল ইসলাম। বয়স ৩৫। পাবনার বেড়া পৌরসভার বাসিন্দা। জুলাইয়ের মাঝামাঝি সময়ে জ্বরে আক্রান্ত হন। দুদিন পর পায়ে তীব্র ব্যথা অনুভব করেন। পরের দিন থেকে হাঁটাচলা প্রায় বন্ধ। ঢাকা থেকে যাওয়া সহযোগী অধ্যাপককে দেখান স্থানীয় ডায়াগনস্টিক সেন্টারে। তিনি চিকিৎসা দেন নিউরোলজিক্যাল সমস্যার। এমনকি রোগীর স্বজনদের তিনি জানান, হয়তো সিরাজুল ইসলাম আর কখনো হাঁটতেও পারবেন না।

ড. জিএম সাইফুর রহমান আরও বলেন, এ বছর রাজধানীসহ সারা দেশে ব্যাপক মাত্রায় ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে মানুষ। একদিকে দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলো মশক নিয়ন্ত্রণে চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে, অন্যদিকে চিকিৎসার ক্ষেত্রে বড় দুর্বলতা চিহ্নিত হয়েছে। জ্বরে আক্রান্ত ব্যক্তি ডেঙ্গু না চিকুনগুনিয়া তা চিহ্নিত করতে পারছেন না। উপসর্গ দেখে চিকিৎসা দিচ্ছেন চিকিৎসকরা। অথচ চিকিৎসকদের দায়িত্ব যেখানে পাঠালে রোগ সহজে চিহ্নিত করা যাবে, সেখানে স্যাম্পল পাঠিয়ে তা চিহ্নিত করা।

স্থানীয় সরকার বিভাগের যুগ্মসচিব আবুল খায়ের মোহাম্মদ হাফিজুল্লাহ খান বলেন,সারা দেশের সব সিটি করপোরেশন ও পৌরসভায় নিয়মিত মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। পাশাপাশি জনসচেতনতা সৃষ্টিতেও নানারকম কর্মসূচি পরিচালিত হচ্ছে।

সূত্রমতে, ২০০০ সালে বাংলাদেশে প্রথম চিহ্নিত হয় এডিস মশা। এরপর গত ২৫ বছরে ধাপে ধাপে এর সংক্রমণ বেড়েছে। সরকারের কার্যকর উদ্যোগ না থাকায় মশাবাহিত এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে সারা দেশে। প্রতিবছর আক্রান্ত হচ্ছে হাজার হাজার মানুষ এবং শত শত মানুষের জীবন কেড়ে নিচ্ছে এডিস মশা। তবুও এডিস নিয়ন্ত্রণে সরকারের কার্যকর উদ্যোগ নেই।

স্বাস্থ্য খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বিভাগ ও জেলা পর্যায়ের কিছুসংখ্যক ডেঙ্গু রোগীর তথ্য ছাড়া চিকুনগুনিয়া সংক্রমণ পরিস্থিতির কিছুই জানাতে পারছে না। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখাও (সিডিসি) আলাদাভাবে চিকুনগুনিয়ার কোনো তথ্য সংরক্ষণ করছে না। ফলে সারা দেশে প্রতিদিন কত রোগী ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছেন সে তথ্য জানা যাচ্ছে না।

এদিকে সিটি করপোরেশনগুলো বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতে এডিস মশা ও লার্ভা নিধন কার্যক্রম জোরদার না করায় ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া ঘরে ঘরে ছড়িয়ে পড়ছে। বিশ্লেষকরা মনে করেন, কোন ভাইরাসে কত রোগী আক্রান্ত হয়েছে তার সঠিক হিসাব করা না গেলে নিয়ন্ত্রণ করাও সম্ভব নয়।

ডিএনসিসির কোভিড-১৯ হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক কর্নেল ডা. তানভীর আহমেদ বলেন, ডেঙ্গু রোগীদের মতো চিকুনগুনিয়া রোগী দ্রুত শনাক্ত সম্ভব হয় না। চিকুনগুনিয়ার ক্লিনিক্যালি ডায়াগনোসিসে টেস্ট পজিটিভ আসতে দুই থেকে তিন সপ্তাহ লেগে যায়। দেখা যায় ততদিনে রোগীর জ্বরই থাকে না। বর্তমানে তাদের হাসপাতালে ডেঙ্গুর উপসর্গ নিয়ে ভর্তি রোগীর ৩০ শতাংশই চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত। তবে ডেঙ্গুর মতো চিকুনগুনিয়া প্রাণঘাতী নয়। চিকুনগুনিয়ায় রোগীর শারীরিক অক্ষমতা বেশি দেখা যায়। অনেক সময় চলাফেরা করতেও কষ্ট হয়। অনেকে এক থেকে দুই বছরের মতো আর্থ্রাইটিসে (বাতব্যথা) ভুগতে পারে।

এদিকে পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়ায় তাকে ঢাকার মগবাজারে কমিউনিটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে চিকিৎসকরা তার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করান। এরপর রিপোর্টে জানা যায়, তিনি চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত। এরপর যথাযথ চিকিৎসায় তিনি এক সপ্তাহের মধ্যে সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরে যান।

কীটতত্ত্ববিদদের অভিমত : এ বিষয়ে কীটতত্ত্ববিদ এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্যাকাল্টি মেম্বার ড. জিএম সাইফুর রহমান বলেন, এডিস মশার কয়েকটি ধরন রয়েছে। এডিস অ্যালবোপিক্টাসের কামড়ে চিকুনগুনিয়া হয়ে থাকে। সাধারণ এসব মশার প্রজনন ঘটে ঝোপঝাড়ে। ঢাকা শহরে এই মশার প্রজনন খুব বেশি হওয়ার কথা নয়। কিন্তু এবার রাজধানীতে জ্বরে আক্রান্ত বেশির ভাগ মানুষের পরীক্ষা-নিরীক্ষায় চিকুনগুনিয়ার উপসর্গ পাওয়া গেছে।তিনি বলেন, এডিস এজিপিটাই’র কামড়ে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয় মানুষ। তবে সঠিক চিকিৎসার প্রয়োজনে দ্রুত চিহ্নিত করা দরকার। রোগী সত্যিকারার্থে কোনো উপসর্গ বহন করছে সেটি জানা জরুরি। তিনি জানান, এডিস মশা জিকা ভাইরাস ছড়ায়। এই ভাইরাস নিউরোলজিক্যাল সমস্যা তৈরি করে। এবার দেশে চিকুনগুনিয়া আক্রান্ত হয়েছে বলে যারা চিকিৎসা নিচ্ছেন তাদের নিউরোলজিক্যাল সমস্যাও দেখা যাচ্ছে। ওইসব রোগী যে জিকায় আক্রান্ত নন, সেটিও নিশ্চিত হওয়া দরকার।

এ প্রসঙ্গে কীটতত্ত্ববিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার বলেন, এ বছর শুধু ঢাকা নয়-চট্টগ্রাম, বরিশাল, পটুয়াখালী ও কক্সবাজারসহ দেশের প্রায় সব এলাকায় এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। এই দুই ভাইরাসের পাশাপাশি জিকা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীও পাওয়া গেছে। চট্টগ্রামে ৪ জনকে জিকা আক্রান্ত শনাক্ত করা হয়েছে। এর বাইরে অন্য কোথাও কেউ আক্রান্ত হয়েছে কিনা, তা যথাযথ পরীক্ষার অভাবে হয়তো চিহ্নিত হয়নি। কিন্তু মশক নিয়ন্ত্রণ এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসার জন্য উপসর্গ চিহ্নিত করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। চিকিৎসার দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলোকে এসব বিষয় নিয়ে ভাবতে হবে। তার মতে, এডিস মশাবাহিত ভাইরাসের ভয়াবহতা নভেম্বর পর্যন্ত থাকবে। ডিসেম্বরে তা অনেকাংশে কমবে। তবে তা একেবারে নির্মূল হবে না।

মশা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থার বক্তব্য : এ প্রসঙ্গে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) উপপ্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. মো. ইমদাদুল হক বলেন, এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে মৌসুমের শুরু থেকে ডিএনসিসি কার্যক্রম জোরদার করেছে। সেই তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে। তার দাবি, এ কারণে পরিস্থিতি অনেকটা নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. নিশাত পারভীন বলেন, মশক নিয়ন্ত্রণে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতাসহ বহুমুখী কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। এসব তৎপরতায় পরিস্থিতির অনেকাংশে উন্নতি হয়। তবে গত দুই সপ্তাহে থেমে থেমে বৃষ্টি হওয়ায় এডিস মশার প্রজনন আরও বেড়েছে।

Top