চরম নৈরাজ্যের শঙ্কা,১৪ লাখ অবৈধ ব্যাটারিচালিত রিকশা - Alokitobarta
আজ : শুক্রবার, ১৯শে সেপ্টেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ৪ঠা আশ্বিন, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

চরম নৈরাজ্যের শঙ্কা,১৪ লাখ অবৈধ ব্যাটারিচালিত রিকশা


মোহাম্মাদ আবুবকর সিদ্দীক ভুঁইয়া : ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনে নতুন করে নামছে আরো এক লাখ ই-রিকশা। বুয়েটের ডিজাইন করা এসব রিকশার বৈধতা থাকলেও রাজধানীতে চলাচলরত ১৪ লাখ অবৈধ ব্যটারিচালিত রিকশা উচ্ছেদ করা হচ্ছে না। এদিকে, আওয়ামী সরকারের আমলে উচ্চ আদালতের আদেশপ্রাপ্ত নতুন ৫ হাজার সিএনজি অটোরিকশার নিবন্ধনের জন্য সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ পাঠিয়েছে ডিটিসিএল। যদিও ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ এর বিরোধিতা করে বলেছে, দিতে হলে প্রথম ধাপে দেড় হাজার সিএনজি অটোরিকশাকে নতুন করে রেজিস্ট্রেশন দেয়া যেতে পারে। সবমিলে আগামী মাসে ঢাকার রাজপথ ক্রমে রিকশা ও সিএনজি অটোরিকশার দখলে চলে যাচ্ছে। পরিবহন খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এতে করে ঢাকার রাজপথে চরম নৈরাজ্য দেখা দেবে। বৈধ-অবৈধ রিকশার ভিড়ে ঢাকার রাস্তা কার্যত অচল হয়ে পড়বে। তাতে বাড়বে যানজট, বাড়বে দুর্ঘটনা, বাড়বে মুনষের ভোগান্তি। সরকারের উচিত ছিল আগে অবৈধ ব্যাটারি রিকশা উচ্ছেদ করে তারপর বৈধ ই-রিকশা রাস্তায় নামানো। যে যাই বলুক ই-রিকশা ও নতুন সিএনজি অটোরিকশা রাস্তায় নামলে পরিবহন সেক্টরে যতটুকু শৃঙ্খলা আছে তাও আর থাকবে না।

সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, ইতোমধ্যে সিটি কর্পোরেশনের অনুমোদন ছাড়াই কয়েক লাখ ই-রিকশা সারাদেশে চলাচল শুরু করেছে। ‘বিভাটেক’ নামক একটি কোম্পানিকে দুই সিটি কর্পোরেশন থেকে এসব ই-রিকশা তৈরির অনুমোদন দেয়া হয়েছে। ওই কোম্পানিকে শর্ত দেয়া হয়েছে, বাজারে ছাড়ার আগে বুয়েটে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর এগুলোর অনুমোদন দেয়া হবে। কিন্তু বুয়েট কর্তপক্ষ বলছে, তারা এখনও কোনো ই-রিকশার অনুমোদন দেয়নি। প্রশ্ন উঠেছে, বুয়েটে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই বিভাটেক কোম্পানি সারাদেশে তাদের ই-রিকশা বাজারজাত শুরু করলো কিভাবে? সূত্র বলছে, এক্ষেত্রে বিভাটেকের সাথে দুই সিটি কর্পোরেশনের কোটি কোটি টাকার গোপন লেনদেন হয়েছে। এ প্রসঙ্গে ঢাকা অটোরিকশা শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ হানিফ খোকন গতকাল বলেন, এক সময় বিভাটেক উত্তরায় অবস্থিত নামবিহীন একটি অবৈধ ব্যাটারি রিকশা তৈরির কারখানা ছিল। হঠাৎ করেই তারা বিভাটেক নামে কোম্পানি খুলে ই-রিকশা তৈরির জন্য দুই সিটি কর্পোরেশন থেকে অনুমোদন পায়। বুয়েটে তাদের তৈরি একটি রিকশার মডেল পাঠানো হলে বুয়েট শুধু চারটি দরজা পরিবর্তন করে। এরপরও শর্ত দেয় মার্কেটিং করার আগে বুয়েটের অনুমোদন নিতে হবে। কিন্তু তারা বুয়েটের সিদ্ধান্তকে তোয়াক্কা না করে ইতোমধ্যে কয়েক লাখ রিকশা তৈরি করে সারাদেশে বিক্রি শুরু করেছে। এটা সিটি কর্পোরেশনকে ম্যানেজ করা ছাড়া কোনোভাবেই সম্ভব নয়। এখানে নিশ্চিত একটা ঘাপলা আছে।

ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা নিয়ে অভিযোগ রাজধানীবাসীর দীর্ঘদিনের। গত কয়েক বছর এটি বন্ধের উদ্যোগ নিলেও ব্যর্থ হয় সরকার। এমনকি হাইকোর্টের নির্দেশনাও উপেক্ষা করে সড়কে চলাচল করে এসব রিকশা। কেননা বন্ধের উদ্যোগ নিলেই বাধা ও প্রতিবাদ আসে এসব রিকশার চালকদের কাছ থেকে। গত বছরের ৫ আগস্ট স্বৈরাচারী হাসিনার পতনের পর ঢাকা কার্যত বিশৃঙ্খল হয়ে পড়ে। প্রশাসন হয়ে পড়ে অচল। ওই সুযোগে ঢাকার আশপাশের জেলা থেকে হাজার হাজার ব্যাটারিচালিত রিকশা ঢাকায় ঢুকে পড়ে। ৮ লাখ থেকে ক্রমে এগুলোর সংখ্যা ১৪ লাখ ছাড়িয়ে যায়। সর্বশেষ ২০২৪ সালের ১৯ নভেম্বর হাইকোর্ট ঢাকা মহানগরীতে ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচলের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করলে প্রতিবাদ জানায় ব্যাটারিচালিত রিকশার চালকরা। পরবর্তীতে এসব রিকশার চালক-মালিকের পক্ষ থেকে দায়ের করা একটি মামলায় একই আদালত ২৫ নভেম্বর এক মাসের জন্য স্থিতাবস্থা জারি করেন। এরই প্রেক্ষিতে স্থানীয় সরকার বিভাগ ওই বছরেই ২৭ নভেম্বর বুয়েট প্রতিনিধি ও সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে ৭ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে। পরে একাধিক আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় সিটি করপোরেশনকে নিবন্ধন ও লাইসেন্স প্রদানকারী সংস্থা হিসেবে নির্ধারণ করা হয়। সেই লক্ষ্যে স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) আইন, ২০০৯ সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয় এবং সংশ্লিষ্ট অধ্যাদেশের খসড়া মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো হয়। মন্ত্রিপরিষদের অনুমোদনের পর ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের আগামী আগস্ট মাস থেকে নতুন নকশার ব্যাটারিচালিত ই-রিকশা পরীক্ষামূলকভাবে চলাচলের সিদ্ধান্ত নেয়। দুই সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে জানানো হয়, এসব রিকশাকে আনা হবে নিবন্ধনের আওতায়, চালকদেরও থাকবে লাইসেন্স। তবে বর্তমানে সড়কে চলমান ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা এখনই উচ্ছেদ করা হবে না। পুরনোগুলোর সঙ্গে চলবে নতুন ই-রিকশা। বুয়েটের দলের করা রিকশা রাস্তায় নামাতে কাজ শুরু হয়েছে বলে জানিয়েছেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ। তিনি বলেন, ‘রিকশার চালকের জন্য লাইসেন্স ও রিকশার নিবন্ধনের (রেজিস্ট্রেশন) ব্যবস্থা থাকবে। আমরা খুব দ্রুতই প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করব। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত রিকশাচালকেরা আবেদন করলে আমরা তাদের নম্বর প্লেট দেবো।

মোহাম্মদ এজাজ আরো বলেন, সরকার নির্ধারণ করে দেবে কোন কোন এলাকায় রিকশা চলতে পারবে। পুরো ঢাকা শহর ঘোরার অনুমতি দেওয়া হবে না। রিকশাভাড়াও সরকার নির্ধারণ করে দেবে। বর্তমানে চলাচলকারী ব্যাটারিচালিত রিকশাগুলোর বিষয়ে জানতে চাইলে উত্তর সিটির প্রশাসক বলেন, আমরা খুব ধীর প্রক্রিয়ায় এগুলো সরিয়ে ফেলব।

উল্লেখ্য, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে বহুবার অবৈধ ব্যাটারি রিকশা ঢাকার রাজপথ থেকে তুলে দেয়ার কথা বলা হলেও দিন দিন এগুলোর সংখ্যা বাড়ছেই। সরকারের কোনো কথাই কাজে আসেনি। পরিবহন সংশ্লিষ্টদের আশঙ্কা, ই-রিকশা আসার পর ক্রমান্বয়ে অবৈধ রিকশা তুলে দেয়ার কথা বলা হলেও কার্যত তা করতে পারবে না সরকার। এর মধ্যে নির্বাচন চলে এলে তা কোনোভাবেই আর সম্ভব নয়। অভিযোগ উঠেছে, মূলত কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার জন্যই পুরাতন অবৈধ রিকশা উচ্ছেদ না করে তড়িঘড়ি করে নতুন ই-রিকশা চালু করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে ব্র্যাকের দেয়া ৪৭ লাখ টাকায় ৩শ’ জন ট্রেইনার নিয়োগ দেয়া হয়েছে। তার ওপর ই-রিকশার জন্য স্টপেজ, যাত্রী ছাউনিসহ অন্যান্য প্রক্রিয়ার সাথেও টাকার অঙ্ক জড়িত। এতে করে মানুষের উপকারের চেয়ে অপকারই বেশি হওয়ার আশঙ্কা বেশি। এ প্রসঙ্গে ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কার্যকরী সভাপতি এম এ বাতেন বলেন,নতৃুন করে ই-রিকশা এবং সিএনজি অটোরিকশা নামলে রাস্তায় চরম বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে। সরকার যদি বৈধভাবে নতুন রিকশা নামায় তাহলে উচিত হবে আগে ঢাকার রাস্তা থেকে অবৈধ সিএনজি অটোরিকশা ও ব্যাটারি রিকশাগুলো উচ্ছেদ করা। আমার মনে হয়, ঢাকায় প্রাইভেট এবং ঢাকার বাইরের সিএনজি অটোরিকশা চলছে ২০ হাজার বা তারও বেশি। তার ওপর লাখ লাখ ব্যাটারি রিকশার যন্ত্রণায় রাস্তায় বাস চলতেই পারে না। যানজটে সিটি বাস সার্ভিসের যেমন জ্বালানির অপচয় হচ্ছে, একই সাথে যাত্রীদেরও সীমাহীন ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কার্যকরী সভাপতি বলেন, আমরা সরকারের নির্দেশে পরিবহন সেক্টরে শৃঙ্খলা ফেরানোর জন্য রাত-দিন পরিশ্রম করছি। বাস মালিকরা লোকসান দিয়ে বাস চালাচ্ছে। আমরা চেষ্টা করছি রাজধানীতে যাত্রীসেবার মান বাড়াতে নতুন নতুন মডেলের বাস নামানোর। কিন্তু সরকার যদি আমাদের কথা না ভেবে, অবৈধ ১৪-১৫ লাখ রিকশা উচ্ছেদ না করে আবার নতুন করে বৈধতা দিয়ে ই-রিকশা নামায় সেক্ষেত্রে লোকসান দিয়ে মালিকরা কেন কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করে নতুন বাস নামাবে? তিনি হতাশা নিয়ে বলেন, তাই যদি হয় তবে সিটি বাস সার্ভিসের কী দরকার? ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম না প্রকাশ করার শর্তে বলেন, সরকার সিদ্ধান্ত নিলে আমাদের কিছুই করার নেই। তবে, পুরনো অবৈধ ব্যাটারি রিকশা উচ্ছেদ না করে নতুন করে ই-রিকশা নিয়ে যতই শৃঙ্খলার কথা বলা হোক না কেন কার্যত এতে নৈরাজ্য সৃষ্টি হবেÑ তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ঢাকা রিকশা শ্রমিক ইউনিয়নের এক নেতা বলেন, নতুন করে বৈধতা নিয়ে ই-রিকশা নামলে বৈধ আর অবৈধতা নিয়ে রাস্তায় রিকশাচালকদের মধ্যে মারামারি. ঝগড়াঝাটি লেগে একের পর এক বিশৃঙ্খলা লেগেই থাকবে। একপর্যায়ে দেখা যাবে বৈধতার দাবিতে অবৈধ রিকশার চালকরা রাস্তায় আন্দোলনে নামবে, রাস্তা অবরোধ করবে। তখন সরকার কী করবে?

আরও পড়ুন...
Top