বাড়ছে দুর্ঘটনা, ঝরছে প্রাণ,বেপরোয়া গতিতে শত শত ট্রাক
মোহাম্মাদ মুরাদ হোসেন: ঢাকার সড়কে দিনের বেলায়ও বিভিন্ন প্রজেক্টের স্টিকার লাগিয়ে মালামালবাহী ট্রাক অবাধে চলাচল করায় পুলিশেরও কিছু করার থাকে না।রাত যত গভীর হয়, ঢাকার রাস্তায় কমতে থাকে যানবাহনের সংখ্যা। কিন্তু ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে বেপরোয়া ট্রাকগুলোর গতির কাঁটা। অল্প সময়ে গন্তব্যে পৌঁছার প্রতিযোগিতায় নামেন চালকরা।রাতের ঢাকায় বেপরোয়া গতিতে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে বালু-মাটি এবং পণ্যবাহী শত শত ট্রাক।এতে বাড়ছে দুর্ঘটনা, ঝরছে প্রাণ। এসব ট্রাকের কারণে রাতে রাজধানীর সড়কে চলাচলকারীরাও থাকেন চরম আতঙ্কে।শুধু তাই নয়, ধুলা আর কালো ধোঁয়ায় নষ্ট হচ্ছে নগরীর পরিবেশও। রাতেই নয়,এতে রীতিমতো অরক্ষিত হয়ে পড়ে রাজধানীর সড়ক। রাস্তায় যেন তাদেরই আধিপত্য চলে। ফলে রাতের সড়কে ঘটে বেশিরভাগ দুর্ঘটনা। ঝরে নিরীহ মানুষের প্রাণ।সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, প্রতিদিনই রাজধানীর কোথাও না কোথাও ঘটছে দুর্ঘটনা। রাত ৯টার পর থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত ঢাকা শহরের সড়কে থাকে ট্রাকের দাপট।
বেসরকারি একটি সংস্থার হিসাবে, এই সময়ে রাজধানীতে প্রতিদিনের মোট দুর্ঘটনায় ৫০ শতাংশের বেশি হতাহতের ঘটনা ঘটে।শুক্রবার রাত সাড়ে ১০টা। মিরপুর এক নম্বর থেকে ১০ নম্বরের দিকে বেপরোয়া গতিতে আসতে দেখা যায় বালুবাহী একটি ট্রাক। উপরে ঢাকনা না থাকায় ট্রাক থেকে উড়ে যাচ্ছিল বালু। এসব বালু বাতাসে মিশে গিয়ে পড়ছিল রিকশা এবং মোটরসাইকেল আরোহীর চোখেমুখে।মোটরসাইকেল আরোহী আব্দুর রহমান বলেন, রাত ৯টার পর থেকে এসব ট্রাকের কারণে রাস্তায় মোটরসাইকেল চালানোই কঠিন। একদিকে বেপরোয়া গতির কারণে দুর্ঘটনার ভয় থাকে, অন্যদিকে বাতাসের সঙ্গে উড়ে আসা বালু চোখের মারাত্মক ক্ষতি করে।বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) সূত্রে জানা গেছে, ঢাকায় নিবন্ধিত ট্রাক, কাভার্ডভ্যান ও পিকআপ রয়েছে ২ লাখ ৪১ হাজার ৪৩৬টি। এরমধ্যে ট্রাক ৮৩৭৮৫, পিকআপ ১১৮৮৪৪ ও কাভার্ডভ্যান ৩৮৮০৭টি। নিবন্ধন ছাড়া রয়েছে তার চেয়ে দ্বিগুণ। এছাড়াও ঢাকায় দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে ঢুকে পণ্যবাহী কয়েক হাজার ট্রাক।সাধারণত তিন হাজার কেজি ওজনের বেশি গাড়ি রাত ১০টার আগে ঢাকা শহরে ঢোকার নিয়ম নেই। তারপরও রাত ৮টার পরেই এই গাড়িগুলো ঢুকতে শুরু করে। তখনই ঢাকার প্রবেশপথগুলোতে যানজটের সৃষ্টি হয়। শুধু তাই নয়, দিনের বেলায়ও নগরীর বিভিন্ন এলাকায় পাথর, মাটি, বালু, রড, সিমেন্টসহ বিভিন্ন মালামাল নিয়ে ট্রাকগুলোকে বেপরোয়া গতিতে চলতে দেখা যায়।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান মালিক সমিতির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. হাসানুল কবির বলেন, দিনে যেসব ট্রাক চলাচল করে, এগুলো বিভিন্ন মেগাপ্রকল্পে নিয়োজিত ঠিকাদারদের। এগুলো সংশ্লিষ্ট প্রকল্পের স্টিকার লাগিয়ে চলাচল করে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীরও এসব ট্রাকের বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ থাকে না। আমরা এসব ট্রাক চলাচলের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে একাধিকবার জানিয়েছি।শুক্রবার রাত আড়াইটার দিকে যাত্রীবাহী একটি বাসের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষের পর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে মাটিবাহী একটি ট্রাক আগারগাঁওয়ে মেট্রোরেলের পি-৩৬৪ নম্বর পিলারে আঘাত করে। এ ঘটনায় ফতেহআলী পরিবহণের বাসটির চালক ও হেলপার গুরুতর আহত হন।যাত্রীবাহী বাস শাহ ফতেহ আলী পরিবহণ আগারগাঁও পাসপোর্ট অফিসের দিক থেকে আগারগাঁও ক্রসিংয়ের দিকে আসছিল। এ সময় মাটিভর্তি ডাম্প ট্রাকটি বিপরীত দিক থেকে এলে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। ট্রাকের চালক ঘটনার পরই পালিয়ে যায়।এর আগে এদিন সন্ধ্যা ৭টার দিকে খিলক্ষেত থানাধীন ৩০০ ফুট এলাকায় বেপরোয়া ট্রাকের ধাক্কায় বিল্লাল হোসেন (১৭) নামে এক কিশোর গুরুতর আহত হয়। পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ওইদিন রাত সাড়ে ১০টায় তার মৃত্যু হয়।
শুধু এ দুটি ঘটনাই নয়, রাজধানীতে বেপরোয়া ট্রাকের কারণে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটছে। রাত ১০টার পর অধিক সংখ্যক ভারী গাড়ি ঢুকে নগরীতে। কাউকে পরোয়া করেন না ট্রাকচালকরা। পরদিন ভোর পর্যন্ত সড়ক থাকে এসব ভারী গাড়ির দখলে। ঢাকায় প্রতি মাসে গড়ে অন্তত ৪০ জন নিহত হন। এরমধ্যে রাতের দুর্ঘটনার শিকার বেশি।বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক বলেন, রাজধানীতে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনার একটি বড় অংশ ঘটে রাতে বেপরোয়া ট্রাকের চলাচলের কারণে। তিনি বলেন, আমরা যেসব পরিসংখ্যান প্রকাশ করি তার চেয়ে বহুগুণ বেশি দুর্ঘটনা ঘটে। যা অনেকেরই নজরে আসে না। এই ভয়াবহ পরিস্থিতি এড়াতে স্মার্ট ট্রাফিকিং ব্যবস্থা চালু করার পরামর্শ দেন তিনি।
এদিকে ডিএমপির মিরপুর জোনে দায়িত্বপালনকারী একজন ট্রাফিক সার্জেন্ট জানান, রাতের ঢাকায় দায়িত্বপালনকারী ট্রাফিক পুলিশ সদস্যরাও থাকেন বেপরোয়া ট্রাক আতঙ্কে। গভীর রাতে ট্রাকচালকরা নিয়মনীতির পরোয়া করেন না। ট্রাক চলাচলে সরকারের বেঁধে দেওয়া গতিসীমা না মেনে দ্রুতগতিতে ছোটেন তারা। বেপরোয়া গতিতেই রাজধানীর বিভিন্ন মোড় পার হয় ট্রাকগুলো। তখন অনেক ঝুঁকি নিয়ে ট্রাফিক পুলিশকে দায়িত্ব পালন করতে হয় বলে জানান তিনি।বাংলাদেশ ট্রাক-কাভার্ডভ্যান ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের হিসাবে, ঢাকা আশপাশের এলাকায় প্রায় ২০ হাজার ট্রাক বালু, ইট, সিমেন্ট, নির্মাণ এলাকার মাটি, পাইলিংয়ের কাদা-মাটি, রেডিমিক্স কংক্রিট পরিবহণ করে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রতি রাতেই এসব ট্রাক গাবতলী, আমিনবাজার, মোহাম্মদপুর, বছিলা, আবদুল্লাহপুর, শ্যামপুর, পোস্তগোলা, ডেমরা, সারুলিয়া, কাঁচপুরসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে বালু ও অন্যান্য নির্মাণসামগ্রী নিয়ে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় চলাচল করে।এসব খোলা ট্রাকে মালামাল পরিবহণের সময় কোনো ঢাকনা দেওয়া হয় না। অনেক সময় ট্রাকের ফাঁকফোকর দিয়ে সড়কে পড়ে ধুলা ও অন্যান্য নির্মাণসামগ্রী। তাছাড়া মালামাল খালাসের পর পানি না ছিটিয়েই চলে যায় ট্রাকগুলো। যাওয়ার সময় ট্রাকের গায়ে লেগে থাকা ধুলাবালি-ক্ষুদ্র কণা ছড়িয়ে পড়ে রাস্তায়, বাতাসে।ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান সম্প্রতি ঢাকার রাস্তায় ট্রাফিক শৃঙ্খলা ফেরানোর পাশাপাশি মাটি ও বালুবাহী বেপরোয়া ট্রাকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশনা দেন। এ বিষয়ে ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগ সূত্র জানায়, ৮ মে ডিএমপি সদর দপ্তর থেকে ৮টি ট্রাফিক বিভাগকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। ওই চিঠিতে ঝুঁকিপূর্ণ যানবাহনের মালিকের নামসহ তালিকা দিতে বলা হয়েছে।ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার (অ্যাডমিন অ্যান্ড রিসার্চ) মো. জাহাঙ্গীর আলম শনিবার বিকালে বলেন, ট্রাফিক বিভাগের নির্দেশিত ছক অনুযায়ী ৮টি ট্রাফিক বিভাগ থেকে ব্যাটারি চালিত অবৈধ রিকশা, অবৈধ যানবাহন, মাটি ও বালু বহনকারী ট্রাক ও হকারদের তালিকাও সংগ্রহ করা হচ্ছে। সেই তালিকা পাওয়ার পর পরে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।