সম্পদ জব্দের ক্ষমতা পাচ্ছে ব্যাংক,অর্থঋণ আদালত আইন
আলোকিত বার্তা:খেলাপি ঋণের আদায় বাড়াতে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে খেলাপিদের স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ জব্দের ক্ষমতা দেয়া হচ্ছে।
একই সঙ্গে এ সংক্রান্ত মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য বেঁধে দেয়া হচ্ছে সময়সীমা। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তিতে আদালতকে সহায়তা দিতে ব্যর্থ হলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কর্মকর্তাদের জবাবদিহির আওতায় আনা হবে।মামলার ব্যাপারে আদালত কোনো তথ্য চাইলে তা সরবরাহে তিন দফার বেশি সময় বাড়ানোর আবেদন করা যাবে না। একইভাবে মামলার শুনানির সময়সীমা বৃদ্ধির জন্য তিন বারের বেশি আবেদন করতে পারবে না।নতুন বিধি-বিধান যুক্ত করে খেলাপি ঋণ আদায়ের আইন আরও কঠোর করা হচ্ছে।
এসব বিধান ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হবে। পরিস্থিতির কারণে যারা খেলাপি হবেন তাদের খেলাপির দুর্নাম ঘুচিয়ে বের হয়ে আসার সুযোগও রাখা হবে আইনি কাঠামোতে। সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে আদালতের অধিনে একটি আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা গঠনের কথাও বলা হয়েছে।
আদালতের নির্দেশ মোতাবেক সংস্থাটি কাজ করবে। অর্থঋণ আদালত আইন সংশোধন করে নতুন বিধিবিধান অন্তর্ভুক্ত করা হবে। আইন সংশোধনের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের উদ্যোগে আয়োজিত উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে এমন সুপারিশ করেছেন ব্যাংকার ও আইনবিদরা। সংশ্লিষ্ট সূত্র থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।এ সুপারিশের আলোকে অর্থঋণ আদালত আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের একটি করে কমিটি কাজ করছে। দুই কমিটি প্রচলিত আইনে সংশোধনী আনার সুপারিশ করবে। এ দুই কমিটির সুপারিশগুলো সমন্বয় করবে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর আহমেদ জামালের নেতৃত্বে গঠিত ১০ সদস্যের কমিটি। এতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা রয়েছেন। কমিটি ব্যাংকারদের প্রস্তাবগুলো নিয়ে পর্যালোচনা করছে। এর মধ্যে ওইসব সুপারিশের বিষয়ে তারা একমত হয়েছেন। এগুলোর পাশাপাশি আরও কিছু বিষয়েও তারা একমত হয়েছেন। এছাড়াও আরও কিছু প্রস্তাব নিয়ে তারা কাজ করছেন।
এ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক কর্মকর্তা জানান,খেলাপি ঋণ আদায়ে দেশের প্রচলিত আইন ও পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর আইনি কাঠামো পর্যালোচনা করা হচ্ছে। দেশে আইন প্রয়োগে কিছু সমস্যা চিহ্নিত করা হয়েছে। সেগুলো সমাধানের জন্যও সুপারিশ করা হবে। আইন প্রয়োগের সঙ্গে জড়িত সংস্থাগুলোর ক্ষমতাও বাড়ানো হচ্ছে। যাতে ঋণখেলাপিদের কাছে একটি বার্তা যায় যে, ব্যাংক থেকে জনগণের আমানত নিয়ে ফেরত না দিয়ে বহাল তবিয়তে থাকা যাবে না।তিনি বলেন,খেলাপি ঋণ আদায় না হওয়ার একটি বড় সমস্যা হচ্ছে মামলা জট। এক্ষেত্রে আইনি জটিলতা যেমন আছে, তেমনি আছে ঋণখেলাপি ও ব্যাংকারদের অসহযোগিতা। ঋণখেলাপিদের সঙ্গে আঁতাত করে তারা মামলা ঠিকমতো পরিচালনা করেন না। ফলে মামলা নিষ্পত্তি দীর্ঘায়িত হচ্ছে। এসব সমস্যা সমাধানে মামলা পরিচালনার ক্ষেত্রে ব্যাংকারদের জবাবদিহিতার আওতায় আনা হচ্ছে। ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধেও কঠোর অবস্থান নেয়া হবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন,শুধু আইন করলে হবে না, আইন প্রয়োগ করতে হবে। এজন্য সরকারের দিক থেকে রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকতে হবে। তাহলে ব্যাংকারররা আইন প্রয়োগ করতে পারবেন। ব্যাংকাররা যদি ঋণখেলাপিদের ভয় পান তাহলে কিছুই হবে না। ঋণখেলাপিরাই যাতে রাষ্ট্রের আইন ও সমাজকে ভয় পায় সে পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। তিনি বলেন, এ আইন প্রয়োগে ব্যাংকারদের সক্ষতাও বাড়াতে হবে।সূত্র জানায়,প্রস্তাবিত ওই আইনে বড় ধরনের সংশোধনী আনা হচ্ছে। ঋণখেলাপির সম্পদ জব্দ করতে সংশ্লিষ্ট ব্যাংককে ক্ষমতা দেয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। এ ক্ষমতা প্রয়োগের আগে সংশ্লিষ্ট ব্যাংককে আলোচ্য আইনের আওতায় আদালতে মামলা করতে হবে। মামলায় গ্রাহক আইনি লড়াই চালাতে অসহযোগিতা করলে আদালতকে জানিয়ে ব্যাংক তার (গ্রাহকের) সব ধরনের বন্ধকী সম্পত্তি জব্দ করতে পারবে। বন্ধকী সম্পত্তিতে কোনো জটিলতা থাকলে বা এ সম্পত্তি দিয়ে ঋণের অর্থ আদায় হওয়ার সম্ভাবনা না থাকলে গ্রাহকের অন্য সম্পত্তিও জব্দ করতে পারবে ব্যাংক। এর মাধ্যমে সম্পত্তি নিজেদের কব্জায় নিয়ে প্রয়োজনে ব্যাংক সেগুলো নিলামও করতে পারবে। এ বিধান বাস্তবায়নে আদালতের অধীনে একটি আইন প্রয়োগকারী সংস্থা গঠনের কথাও বলা হয়েছে। আদালতের নির্দেশ মোতাবেক সংস্থাটি কাজ করবে। এ ক্ষেত্রে ঋণখেলাপি ইচ্ছা করলে আদালতে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ পাবেন। মামলা দায়েরের আগে ঋণ শোধের জন্য গ্রাহককে কমপক্ষে তিন দফা নোটিশ দিতে হবে। এ নোটিশ গ্রাহক পেয়েছেন তার দালিলিক প্রমাণ ব্যাংকের কাছে থাকতে হবে।
প্রচলিত আইনে খেলাপি ঋণ পরিশোধে তিন দফা নোটিশ দিয়েই ব্যাংক কোনো মামলা ছাড়াই বন্ধকী সম্পত্তি নিলামে তুলতে পারে। এ প্রক্রিয়ায় ঋণের অর্থ আদায় না হলে ব্যাংক যদি গ্রাহকের অন্য কোনো স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির সন্ধান পায় সেগুলো ক্রোক করার জন্য আদালতের কাছে আবেদন করতে পারে। আদালত আদেশ দিলে ব্যাংক ওইসব সম্পদ ক্রোক করার জন্য সংশ্লিস্ট কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করতে পারে। যেহেতু আদালতের আদেশ আছে সে কারণে এটি মানতে প্রতিষ্ঠানগুলো বাধ্য। ভারতসহ অনেক দেশের আইনে ঋণখেলাপিকে আটক করে জেলে পাঠানোর ক্ষমতা ব্যাংকের হাতে রয়েছে। বাংলাদেশেও এমনটি করা উচিত বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।বন্ধকী সম্পদের ওপর ব্যাংক প্রায় সবক্ষেত্রেই নিজেদের দখল প্রতিষ্ঠা করতে পারে না। এজন্য নিলাম ডেকেও ক্রেতা মেলে না। ক্রেতা মিললেও খুব কম দামে গ্রাহক নিজেই ওইসব সম্পত্তি কিনে নেন। এতে ব্যাংকের টাকা সিকি ভাগও আদায় হয় না। এসব ক্ষেত্রে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সহযোগিতা নেয়ার জন্য আদালতের অনুমতি নিতে হয়। এ প্রক্রিয়ায় গ্রাহক উচ্চতর আদালতে রিট করে ব্যাংকের সব কার্যক্রম আটকে দেন। যে কারণে সম্পত্তি নিলামের দিকেও যেতে পারে না ব্যাংক। আইনি প্রক্রিয়ার শুরুতেই জটিল প্রক্রিয়ায় পড়ে যায় ব্যাংক। কেননা ব্যাংকের উদ্যোগের বিরুদ্ধে গ্রাহক উচ্চতর আদালতে আপিল করে সব কার্যক্রম স্থগিত রাখতে সক্ষম হন। ফলে ব্যাংক কিছুই করতে পারে না। কিছু ক্ষেত্রে ব্যাংক জোরালো ভূমিকা রেখে আদালতের রায় পেলেও সেগুলো আবার বাস্তবায়ন করতে পারে না বহুমুখী কারণে। এসব জটিলতা নিরসনে সংশোধিত আইনে আগে ঋণখেলাপির সম্পদ জব্দ করার বিধান রাখার প্রস্তাব করা হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, ব্যাংক আইনি প্রক্রিয়ায় মামলার শুরুতেই খেলাপির সম্পত্তি জব্দ করে নিলাম করতে পারলে খেলাপিরা ভয় পাবেন। খেলাপি হওয়ার পর ব্যাংক এ ধরনের উদ্যোগ নিলে তারা অন্তত সমঝোতার চেষ্টা করবেন।
এ প্রসঙ্গে বেসরকারি খাতের শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের আইন বিভাগের সিনিয়র এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট (এসএভিপি) পঙ্কজ কুমার দেবনাথ বলেন, ব্যাংক খেলাপির সম্পদ জব্দ করার ক্ষমতা ভারতের আইনে রয়েছে। তারা এটি প্রয়োগ করে বেশ সুফলও পেয়েছে। এ বিষয়টি বাংলাদেশেও আইন করে প্রয়োগ করলে সুফল পাওয়া যাবে বলে তিনি মনে করেন।সূত্র জানায়,আইনেই নিু আদালতে মামলা নিষ্পত্তি করতে সর্বোচ্চ ৩ বছর সময় দেয়ার কথা বলা হয়েছে। বর্তমানে এ ধরনের কোনো সময়সীমা নেই। ফলে ১৫-২০ বছরেও মামলা নিষ্পত্তি হয় না। উচ্চ আদালতে আপিল ও আপিল নিষ্পত্তির সময়সীমাও বেঁধে দেয়া হবে। এর মধ্যে মামলা নিষ্পত্তি করতে না পারলে বা ব্যাংক ও গ্রাহক আদালতকে সহযোগিতা না করলে তাদের জবাবদিহি করতে হবে। খেলাপি ঋণ আদায়ে মামলার পাশাপাশি খেলাপি ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের হালনাগাদ তথ্য বিভিন্ন গণমাধ্যমে নিয়মিত প্রকাশ করার বিধান করার বিষয়টি থাকছে সুপারিশে। এতে খেলাপির ওপর সামাজিক চাপ সৃষ্টি হবে। বর্তমানে এসব তথ্য প্রকাশ করার কোনো বিধান নেই।